যুক্তরাষ্ট্রের ১০৪% জবাবে চীনের ৮৪% শুল্ক আরোপ, টালমাটাল বিশ্ব
Published: 9th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১০৪ শতাংশ করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। আগের ঘোষিত ৩৪ শতাংশের সঙ্গে আরও ৫০ যোগ করে নির্ধারণ করা এ শুল্কহার বুধবার থেকেই কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া আগের আরোপিত শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্য আমদানিতে আগের ৩৪ শতাংশের সঙ্গে বৃহস্পতিবার থেকে ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। আকাশচুম্বী এ শুল্কহারে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এটি পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিশ্বের বিভিন্ন পুঁজিবাজারে পতন দেখা দিয়েছে এবং জ্বালানি তেলের দাম কমে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে। খবর সিএনএন, রয়টার্স ও বিবিসির।
চীনা পণ্য আমদানিতে আগের ২০ শতাংশের সঙ্গে আরও ৩৪ শতাংশ শুল্ক গতকাল বুধবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তবে এই হার কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই তা বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করা হয়। ফলে এখন চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ১০৪ শতাংশে। গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার দু’দিনের মাথায় ৪ এপ্রিল চীনও সমান হারে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে।
হোয়াইট হাউস জানায়, চীনে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় তারা দেশটির বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। ট্রাম্প আগেই বলেছিলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহার না করলে দেশটির ওপর আরও ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হবে। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি আগেই সতর্ক করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি কোনো দেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তবে তারা সঙ্গে সঙ্গে নতুন ও অনেক বেশি হারে শুল্কের মুখোমুখি হবে।’
এই প্রতিক্রিয়ায় বেইজিং বলেছে, চীনকে চাপ বা হুমকি দিয়ে কখনোই লাভ হবে না। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও সাফ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়বে তারা এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘ব্ল্যাকমেইলিং আচরণ’ তারা কখনোই মেনে নেবে না।
এর পরই পাল্টা হিসেবে মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরও ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশে উন্নীত করেছে চীন। বৃহস্পতিবার থেকেই এ শুল্ক কার্যকর হবে। বুধবার দেওয়া দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেইজিংয়ের প্রয়োজনীয় পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শেষ পর্যন্ত লড়াই করার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা এবং প্রচুর উপায় রয়েছে। ইতিহাস এবং তথ্য প্রমাণ দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি তার নিজস্ব সমস্যার সমাধান করবে না। পরিবর্তে এটি আর্থিক বাজারে তীব্র ওঠানামার কারণ হবে, মার্কিন মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দেবে, শিল্প ভিত্তিকে দুর্বল করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই বাণিজ্যযুদ্ধ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। এশিয়ার শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হতেই বড় ধরনের পতন হয়। একই অবস্থা দেখা দেয় ইউরোপের শেয়ারবাজারেও।
যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ১০০ প্রতিষ্ঠানের সূচক এফটিএসই ১০০ কমেছে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যেখানে জার্মানির ডিএক্স সূচক ২ দশমিক ৯২, ফ্রান্সের সিএসি ৪০ সূচক ৩, বেলজিয়ামের বিইএল ২০ সূচক ৩ দশমিক ৪৯, সুইজারল্যান্ডের সুইস মার্কেট ইনডেস্ক ৪ দশমিক ৩৭ এবং ইউরোপের শীর্ষ ৫০ প্রতিষ্ঠানের সূচক ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমেছে। তবে শুল্কযুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন পুঁজিবাজারগুলোয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কোনো কোনো খাতের সূচকে পতন হলেও কয়েকটি খাতে বাড়তেও দেখা গেছে।
একই সঙ্গে দাম কমেছে জ্বালানি তেলের। চাহিদা পতনের শঙ্কায় ব্রেন্ট ও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ক্রুডের দাম ৬ শতাংশেরও বেশি কমে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৫৮ দশমিক ৮০ ডলার এবং ডব্লিউটিআইর ক্রুডের দাম ৫৫ দশমিক ৫৫ ডলারে নেমে এসেছে। দর কমেছে ডলারেরও। বিশ্বের বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দামে পতন হয়েছে। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা একটি ‘সম্ভাব্য পরিণতি’ বলে অভিহিত করেছেন বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান চেজের সিইও জেমি ডিমন। তিনি বুধবার ফক্স বিজনেসকে বলেন, ট্রাম্পের আরোপিত ব্যাপক শুল্ক সম্ভবত মন্দা এবং ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি করে তুলবে। শুল্কের অস্থিরতা ‘গুরুতর’ এবং বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্য হওয়া উচিত বাণিজ্য অংশীদারদের শক্তিশালী করা, দুর্বল নয়।
এবার ওষুধ আমদানিতেও শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ন্যাশনাল রিপাবলিকান কংগ্রেশনাল কমিটির (এনআরসিসি) নৈশভোজে অংশ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ ঘোষণা দেন। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শিগগির ওষুধ আমদানিতে নতুন শুল্ক ঘোষণা করবে। নতুন এই শুল্ক ওষুধ কোম্পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের কার্যক্রম স্থানান্তর করতে উৎসাহিত করবে।
এদিকে ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁরই উপদেষ্টা ইলন মাস্ক। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি মাস্ক এ নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছেন। এ ঘটনার পর শুল্কনীতি নিয়ে ট্রাম্প শিবিরে গৃহদাহের ইঙ্গিত পাচ্ছেন অনেকে। ইলন মাস্ক মঙ্গলবার ট্রাম্পের বাণিজ্যবিষয়ক প্রধান পরামর্শক পিটার নাভারোকে সরাসরি ‘নির্বোধ’ ও ‘অকাট মূর্খ’ বলে আক্রমণ করেন। নাভারো সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মাস্ককে ‘গাড়ি সংযোজনকারী’ আখ্যা দেন। তিনি বলেন, মাস্ক যা কিছু করেন, সবই তাঁর ‘নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার’ জন্য। পরে কড়া ভাষায় এর প্রতিক্রিয়া জানান মাস্ক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র শ ল ক আর প আমদ ন ত ক র যকর দশম ক র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।
মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?
তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।
সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?
সরকারের পক্ষ থেকে রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন, সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!
এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]