চীন-যুক্তরাষ্ট্র শুল্কযুদ্ধে বিশ্ববাণিজ্য ঝুঁকিতে
Published: 11th, April 2025 GMT
শুল্কযুদ্ধের হুঙ্কার দিয়ে মাঠে নামলেও এক সপ্তাহের মাথায় পিছু হটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পুঁজিবাজারে ব্যাপক পতন, ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ এবং এমনকি ঘনিষ্ঠজনের চাপের পরও পাল্টা শুল্ক নিয়ে অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে মার্কিন সরকারি বন্ড বাজারে তীব্র পতনের পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রেসিডেন্টের কৌশলের অর্থনৈতিক প্রভাব সম্ভাব্যভাবে বিপর্যয়কর এবং তাঁর উপদেষ্টাদের পূর্বাভাসের চেয়েও খারাপ হতে পারে। এ অবস্থায় বন্ড বাজার নিয়ে ট্রেজারি বিভাগের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ট্রাম্পকে পাল্টা শুল্ক স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে। বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত তিনজন সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমঝোতায় এলেও চীনের ওপর ব্যাপক ক্ষেপেছেন ট্রাম্প। তিনি চীনা পণ্যে কয়েক ধাপে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর কারণ হলো, চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করেছে, যা আগে ছিল মাত্র ৩৪ শতাংশ। তবে তাত্ত্বিকভাবে এই বাণিজ্যযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের ওপরই বেশি প্রভাব ফেলবে। যদিও এর আগে চীনা পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্কের কথা বলা হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্ক বেড়ে ১২৫ শতাংশ নয় বরং ১৪৫ শতাংশ হয়েছে। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলেন, ১২৫ শতাংশ মূলত পাল্টা শুল্ক। এর সঙ্গে দেশটির ওপর আগে থেকেই আরোপ করে রাখা ২০ শতাংশ শুল্কও যুক্ত হবে। ফলে চীন আসলে প্রায় ১৪৫ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরেই রিপাবলিকান ও ব্যবসায়ীরা ট্রাম্পকে পাল্টা শুল্ক আরোপ বন্ধের তাগিদ দিচ্ছিলেন। তারা আশঙ্কা করছিলেন, এই নীতি তুমুল বাণিজ্যযুদ্ধ, বৈশ্বিক বাজারের পতন, বিশ্বব্যাপী মন্দার আবির্ভাব ঘটাতে পারে। এতকিছুর পরও ট্রাম্প বলছিলেন, তিনি তাঁর এই নীতি থেকে কখনোই সরে আসবেন না। তবে বন্ড বাজারে অস্থিরতা তাঁকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করে। এর সঙ্গে বাকি উদ্বেগগুলোও এতে রসদ জুগিয়েছে। পরে অবশ্য ট্রাম্প বিষয়টি স্বীকারও করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বন্ড বাজার খুবই জটিল, আমি এটা দেখছিলাম। এখন বন্ড বাজার সুন্দর। তবে গত রাতে আমি দেখেছি, মানুষ একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল।
সিএনএন জানায়, ট্রাম্পের হঠাৎ উল্টো পথে হাঁটার অন্যতম কারণ হলো, বন্ডের সুদহার এবং বন্ড বিক্রির চাপ বেড়ে যাওয়া। মার্কিন বন্ডের সুদহার গতকাল ৪ দশমিক ৫ শতাংশে উঠে যায়। সেই সঙ্গে বিক্রির চাপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিপ্রণেতাদের চিন্তায় ফেলে দেয়। এমনকি অর্ধশত বিলিয়ন ডলারের বন্ডের নিলামের নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়। সেটা হলে দেউলিয়া হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। সম্ভবত এই চাপেই ট্রাম্প শেষমেশ নতিস্বীকার করেন।
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পেডেন অ্যান্ড রাইগেলের প্রধান অর্থনীতিবিদ জেফরি ক্লিভল্যান্ড বিবিসিকে বলেন, বাস্তবতা হলো, বিপদ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এই অনিশ্চয়তার কারণে আগামী তিন মাস বিশ্ব অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে যাবে। মন্দা এড়ানো গেলেও প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে। হঠাৎ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যেতে পারে।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক তিন মাস স্থগিতের ঘোষণায় বিশ্ববাজারে স্বস্তি ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি এশিয়া ও ইউরোপের পুঁজিবাজারে ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা দেয়। শুল্ক স্থগিতের ঘোষণায় বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি– এনভিডিয়া, অ্যাপল, টেসলা, মাইক্রোসফট, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ও অ্যামাজন। গত বুধবার এই সাত কোম্পানির শেয়ারের দর এক লাফে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে এক দিনেই তাদের সম্মিলিত বাজারমূল্য দেড় ট্রিলিয়ন ডলার বাড়ে।
গত ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ পুরো পৃথিবীর সামনে নতুন এক নেতিবাচক পরিস্থিতি হাজির হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ধস নামতে শুরু করে। ডলারের বিনিময় হার কমে যায়, তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। বাজার অর্থনীতিতে রীতিমতো কাঁপন শুরু হয়ে যায়।
এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে শুরু করে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছে। অর্থাৎ, সবাই আপাতত নির্ভার হয়েছে। কিন্তু এখনই উদযাপন করার কিছু নেই।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাল্টা শুল্ক স্থগিত হলেও এখনও বেজলাইন বা ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক রয়ে গেছে। তার সঙ্গে আছে আগের আরোপিত শুল্ক। তাছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের পণ্যে ব্যাপক শুল্কও রয়ে গেছে। ফলে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য এখনই স্বাভাবিক হচ্ছে না। এশিয়া অঞ্চলের অনেক দেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। এই দেশগুলো দেশটির রপ্তানিমুখী শিল্পের সংযোগ শিল্প হিসেবে কাজ করে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমে গেলে এসব দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চীনা শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব পড়বে
গত বছর চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রি করেছে। এটি চীনে মার্কিন রপ্তানির প্রায় তিন গুণ। এই হিসাব ইঙ্গিত দেয়, উচ্চ শুল্ক চীনা ব্যবসা-বাণিজ্যকে আরও বড় ক্ষতির মুখে ফেলবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডিস অ্যানালিটিকসের সারাহ ট্যান বলেন, ৮৪ শতাংশ চীনা শুল্ক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। চীনের পাল্টা পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব খাত বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে, তার মধ্যে অন্যতম কৃষি।
১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপকে কীভাবে দেখছে চীন
মাত্র এক সপ্তাহ আগেও চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। সেটা এখন বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে ১৪৫ শতাংশে। তবে পিছু না হটার ইঙ্গিত দিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, তাদের সরকার উস্কানিকে ভয় পায় না। এরই মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ করেছে চীন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের উচ্চ হারের শুল্ক আরোপ করা হলে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে লাভ করা প্রায় অসম্ভব। আবার এই শুল্কহার চলমান থাকলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের আরও অবমূল্যায়ন হতে পারে। বৃহস্পতিবার গত ১৯ মাসের মধ্যে ডলারের বিপরীতে ইউয়ান সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।
এদিকে, পুঁজিবাজারে লেনদেন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘোষণা দিয়েছে ডেমোক্র্যাট শিবির। সিনেটর অ্যাডাম শিফ বলেছেন, কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতার পর অভ্যন্তরীণ লেনদেনের তদন্ত শুরু করবেন।
বুধবার ট্রাম্প শুল্ক স্থগিতের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে নিজের মিডিয়া গ্রুপ ডিজেটির শেয়ার কিনতে উৎসাহিত করেছিলেন। এ নিয়ে শিফ বলেন, তাহলে প্রশ্ন হলো– পাল্টা শুল্ক তুলে নেওয়ার বিষয়টি ট্রাম্প ছাড়া কে কে জানত? প্রেসিডেন্টের আশপাশের লোকজন কি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শেয়ার বিক্রি করেছিলেন?
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প বন ড ব জ র ব ষয়ট র ওপর ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে
দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।
বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’
কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি।
এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়।
মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন।
বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।
শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ
রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে।
প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।