সামাজিকসহ নানা কারণে সদ্যোজাত শিশুকে ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন মা কিংবা বাবা। উদ্ধার হওয়া এই নবজাতকদের অধিকাংশই থাকে মৃত। আর অসুস্থ হয়ে পড়ায় জীবিত পাওয়া নবজাতকদেরও বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। নির্মম এসব ঘটনা এড়াতে ‘নিউবর্ন হাব’ তৈরির সুপারিশ এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ করা হয়েছে। ‘বিশ্ব পথশিশু দিবস ২০২৫’ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ‘ডা.
চিকিৎসাবিজ্ঞানে জন্ম থেকে ২৮ দিন বয়সী শিশুই নবজাতক। এই বয়সী শিশুর মৃত্যুঝুঁকি সব দেশেই বেশি। বাংলাদেশে এক হাজার শিশু জন্ম নিলে ২০টির মৃত্যু হচ্ছে বয়স ২৮ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই। এই বয়সের শিশুকে রাস্তাঘাটে বা অন্যত্র ফেলে গেলে মৃত্যুঝুঁকি আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
ফেলে যাওয়া এমন শিশুদের নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছেন রাজধানীর মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক মো. মুজিবুর রহমান। কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের উদ্ধার, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে তিনি গড়ে তুলেছেন ডা. মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশন। ১০ বছরে বিভিন্ন জনের কুড়িয়ে পাওয়া ৪১টি নবজাতককে তিনি চিকিৎসা দিয়েছেন এবং ৪১টি সচ্ছল পরিবারের হাতে তাদের তুলে দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘কতটা নৃশংস ও পাশবিক হলে একটি সদ্যোজাত শিশুকে ফেলে দেওয়া যায়। এটা দুঃখজনক, মর্মান্তিক। কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তবতা।’ তিনি আরও বলেন, সামাজিক মর্যাদা, পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক পরিচয়, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মা ও বাবা নবজাতককে ফেলে দেওয়ার মতো অপরাধ করে ফেলেন।
সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এটা নিশ্চিত, দেশের বিভিন্ন জেলায় এমন ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। যে নবজাতকের পরম আদরে মায়ের কোলে থাকার কথা ছিল; তাকে পাওয়া যায় ফুটপাতে, ঝোপঝাড়ে, ডাস্টবিন বা ময়লার ভাগাড়ে, ধানখেতে, সেতুর নিচে বা নদীনালার পাড়ে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নবজাতকসহ বিভিন্ন বয়সী শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার পথশিশুর সন্ধান মিলেছে। তাদের মধ্যে ৮০০ ছিল নবজাতক। ২০২৪ সালে ৯৪টি নবজাতক উদ্ধার হয়। এর মধ্যে ৬৪টি নবজাতক ছিল মৃত। সে হিসাবে ফেলে যাওয়া নবজাতকদের ৬৮ শতাংশ উদ্ধার হচ্ছে মৃত অবস্থায়।
ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া নবজাতকের স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক উল্লেখ করে মুজিবুর রহমান বলেন, এদের ‘কোল্ড স্ট্রেস’ দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পোকামাকড় বা মশার কামড়ে নবজাতকের শরীরে নানা ধরনের সংক্রমণও দেখা দেয়। এদের জন্য দরকার হয় বিশেষায়িত চিকিৎসার। দরকার হয় নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ)।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মো. জিয়াউল করিম বলেন, নবজাতক উদ্ধার ও চিকিৎসা, তাদের নিরাপদ আশ্রয়—এসব ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বেশি।
নবজাতককে ফেলে দেওয়া একটি অপরাধ, একটি সমস্যা। তবে এই সমস্যার সমাধান জানা নেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকদের। তবে তাঁদের কিছু দাবি আছে সরকারের কাছে। প্রথমত, তাঁরা একটি ‘নিউবর্ন হাব’ তৈরির অনুমতি চান। এটা এমন একটি স্থান যেখানে নবজাতকদের রেখে যাওয়া যাবে। মা-বাবার পরিচয় গোপন রাখা হবে। রাস্তায় ফেলে দেওয়ার চেয়ে এটি ভালো বিকল্প মনে করছেন তাঁরা।
এ ছাড়া মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এ ধরনের শিশুদের জন্য ‘পথনবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র’ করা প্রয়োজন বলে আয়োজকেরা জানান। পাশাপাশি একটি ‘মিল্ক ব্যাংক’ গড়ে তুলতে চান তাঁরা।
সংবাদ সম্মেলনের পর এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন জনসেবামূলক সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। এই প্রতিষ্ঠানেও কুড়িয়ে পাওয়া মৃত নবজাতকের তথ্য আছে। প্রতিষ্ঠানের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুরতহাল শেষে পুলিশ আমাদের কাছে যে লাশ দেয়, আমরা সেগুলো দাফন করি। ২০২৪ সালে ৪৯টি নবজাতকের লাশ দাফন করা হয়েছিল।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম জ ব র রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
দহন থেকে জংলি
‘আমি নিয়মিত অনেক চিত্রনাট্য পাচ্ছি। নিয়মিত সেসব সিনেমা করলে প্রচুর টাকা কামাতে পারব। ফিন্যান্সিয়ালি জায়গাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দর্শক আমাকে যেভাবে দেখতে চাচ্ছেন, তেমন গল্প পাচ্ছি না। দর্শক-প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কিছু দিতে চাই। যখন সামগ্রিক চিন্তা করি, তখন ভাবতে হয় আমি কতটা আয় করলাম তার চেয়েও দর্শকের সামনে কীভাবে আসছি, সেটি মুখ্য। এটি একটি প্যাকেজ। মাঝে একটি-দুটি গল্প পছন্দ হয়। সেসব টিমের যে অবস্থা, বাজেট সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে ভালো গল্প তুলে আনা কঠিন হবে। তখন আমি না করে দিই। আমি চাইছি নিজের মতো করে কাজ করতে। জীবনে অনেক সিনেমা করতে হবে, এমন চিন্তা নেই। আমার মতো করে অল্প কিছু কাজ করে যেতে চাই।’ বলছিলেন সিয়াম আহমেদ।
গেল ঈদে মুক্তি পেয়েছে সিয়াম আহমেদ অভিনীত সিনেমা ‘জংলি’। যে সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নায়কের আবেগ ও পরিশ্রমের দীর্ঘ গল্প। সিনেমাটি করতে একচুলও ছাড় দেননি সিয়াম। ফলাফল হিসেবে পেয়েছেন দর্শকের অবারিত ভালোবাসা। জংলি মুক্তির পর তাই গল্পটি হয়ে উঠেছে সবার। দর্শকরা হলে গিয়ে কেঁদেছেন, গল্পে বুঁদ হয়ে থেকেছেন। করেছেন সিয়াম ও তাঁর টিমের প্রশংসা।
সিয়াম বললেন, ‘এ সিনেমায় আমি দীর্ঘ সময় দিয়েছি। সিনেমার জন্য চুলদাড়ি বড় করেছি। একটি সিনেমার জন্য আমার পাগলামি নিয়ে মা-বাবার মনে হয়তো প্রশ্ন ছিল, ছেলেটি চুল-দাড়ি বড় করে কী করছে? কী করেছি, এটি তো তাদের বোঝানো যায় না। তবে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সিনেমাটি মুক্তির পরে গল্পটি তাদের টাচ করবে। কারণ, গল্পটিই এমন, এটি প্রথম যদি কাউকে টাচ করে, সেটি সন্তানের মা-বাবাদের। যে কারণে তাদের একসঙ্গে হলে নিয়ে কাছ থেকে অনুভূতি জানার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত মা-বাবার কাছ থেকে সেরা ফিডব্যাক পেয়েছি। বাবা-মেয়ের গল্পটি দেখে তারা ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু আমার বাবা-মা নন, অন্য মা-বাবাদের কাছেও গল্পটি নিজেদের হয়ে উঠেছে। তারা সিনেমাটি দেখে কেঁদেছেন। হল রিঅ্যাকশনের সেসব ভিডিও সবাই দেখেছেন। সব মিলিয়ে আমরা সফল। আমাদের জংলি সফল।’
মুক্তির পর থেকে ‘জংলি’ সিনেমার এগিয়ে যাওয়ার গ্রাফ দেখলে শুধু দর্শকের ভালোবাসায় সফল নয়, ব্যবসায়িকভাবেও সিনেমাটি যে সফল তার চিত্র বিদ্যমান। মাত্র ৮টি শো দিয়ে শুরু হওয়া সিনেমাটি ঈদের এতদিন পরও মাল্টিপ্লেক্সে ত্রিশটির মতো শো নিয়ে দাপিয়ে চলছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও জংলি হয়ে উঠেছে দর্শকদের সিনেমা।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টাইগার মিডিয়ার কর্ণধার জানিয়েছেন, জংলি প্রায় ছয় কোটির (গ্রস) ক্লাবে প্রবেশ করেছে।
ঈদে মুক্তির পর থেকে ক্রমশ দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘জংলি’। এমনকি, দেশের সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে কানাডা, আমেরিকা ও ইউকে’র ৪০টি থিয়েটারে মুক্তি পেয়েছে ‘জংলি’। গত ২৫ এপ্রিল থেকে স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো-এর পরিবেশনায়, ঈদের সিনেমাগুলোর মধ্যে দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি থিয়েটারে একযোগে মুক্তি পেয়েছে এ সিনেমাটি। কানাডা ও আমেরিকার বক্স অফিসে প্রথম ৩ দিনের গ্রস ৩৫,০০০ ডলার আয় করে শুভসূচনা করেছে ‘জংলি’।
ঈদে আরও অনেক ছবি মুক্তি পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে জংলি বিশেষ হয়ে উঠেছে কেবল বাবা-মেয়ের গল্পের কারণে। সঙ্গে সিয়ামের নজরকাড়া অভিনয়। নৈঋতার পাখি হয়ে ওঠার দারুণ চেষ্টা। দিমিত্রি থে স্টোনহার্ট নামে এক মনীষী বলেছেন, ‘একজন বাবা বলেন না যে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন; বরং তিনি দেখিয়ে দেন যে, তিনি তোমাকে ভালোবাসেন’ জংলি সিনেমায় সিয়াম সেটি বোঝাতে পেরেছেন। ফলে সিনেমাটি হয়ে উঠেছে সবার।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন– ‘পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে, কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে।’
সিয়াম তাঁর জীবনের সেই দৈত্যকে জাগাতে পেরেছেন। পেরেছেন বলেই হয়তো আজ তিনি সাধারণ সিয়াম থেকে নায়ক সিয়াম হয়ে উঠেছেন। সিয়ামের যাত্রাটা শুরু বেশ আগে হলেও পুরোপুরি শুরু হয় ‘দহন’ সিনেমার মাধ্যমে। রায়হান রাফী পরিচালিত এ সিনেমাটির মাধ্যমে সিয়াম নাটক থেকে পুরোপুরি চলচ্চিত্রের মানুষ হয়ে ওঠেন। সে যাত্রা এখনও চলছে। প্রথম সিনেমায় যে সিয়ামকে সবাই দেখেছেন, জংলির সেই সিয়াম যেন আকাশ-পাতাল। তখন সিয়াম ছিলেন তরুণ, এই সিয়াম এখন বাবা। পর্দায় ও বাস্তবে দুই জায়গাতে দারুণ এক বাবা হয়ে উঠেছেন তিনি। নিজের অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে আগামী পরিকল্পনা কী? প্রশ্ন রাখলে নায়ক বলেন, ‘আমি নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাই। যারা আমার আগের কাজ দেখেছেন, তারা যেন বলেন, আগের কাজকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি। আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া কঠিন।’