এক চিমটি পরম্পরা ও সংস্কৃতির স্যালাইন
Published: 13th, April 2025 GMT
গিমা শাকের বহু নাম। তিতা গিমা, গিমাই, গিমে, মাইটাখুদরি। দেশি ধানের জমিন, জমির আইল, রাস্তার কিনার, গ্রামীণ বন, খোলা প্রান্তর ও মাঠে এই শাক জন্মে। মুখের রুচি বাড়াতে, পেটের নানা সমস্যা মেটাতে, খোস-পাঁচড়া ও ব্যথা কমাতে এই শাক উপকারী। জ্বর, হাড়ের ব্যথা, চোখের সমস্যা, কাশি, পেট ফাঁপাসহ নানা সমস্যায় কাজে লাগে এই শাক। বসন্তের শেষে বর্ষাকালের আগ পর্যন্ত এই শাকের ব্যবহার বেশি। কিন্তু বর্তমানে গিমা শাক বিরল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উপকূল এবং হাওরাঞ্চলে। একে তো লুণ্ঠিত হচ্ছে জমিন, প্রাণ-প্রকৃতি হচ্ছে খুন, এর ওপর আবার জলবায়ু পরিবর্তনের বিষফোড়া। গিমা শাক খুব বেশি গরম সহ্য করতে পারে না। তীব্র তাপদাহে শুকিয়ে যায়, এমনকি বীজদানাও মরে যায়। গ্রামের প্রবীণ ও কিশোর নারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি, আগের মতো গিমা শাক এখন দেখা যায় না। গিমা শাকের ঝাঁঝালো তিতা স্বাদ অনেক কমে গেছে। আগের মতো ঝোপালো গিমা এখন কম দেখা যায়। তো চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলাদেশের সমতল জনপদে গিমা শাক খাওয়া হয়। কেবল গিমা নয়; মিশ্র তিতা শাক ও সবজি ছাড়া বাঙালি কি আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় কৃত্য হয় না। নাইল্যা, দণ্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা, বাসক, ঘৃতকাঞ্চন, শেফালি, কলমি, হেলেঞ্চা, ঘুম, আদাবরুণ, পিপুল, গন্ধভাদালি, কাঁটাখুদি, ক্ষেতপাপড়া এমন ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। পাহাড়ে চাকমারা তিতকরলা, তিত্তুলগুলো, হনাগুলো, বনআলু, কচু, বাঁশকোড়লসহ নানা পাহাড়ি সবজি দিয়ে রান্না করেন ‘পাজন’ নামে খাবার। প্রায় ৩০ থেকে ১০৭ রকমের মিশ্র সবজির এই রান্নাকে চাক ভাষায় বলে ‘কাইনবোং’, মারমারা বলেন ‘হাং-র’ এবং ত্রিপুরারা বলেন ‘মৈজারবং’। গিমা শাক যেমন কমছে সমতলে, তেমনি পাহাড়ে উধাও হচ্ছে হনাগুলো বা কানাইডিঙ্গা গাছ। তাহলে চৈত্রসংক্রান্তি, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, চানক্রান, সাংগ্রাইং আয়োজন হবে কী দিয়ে? নাকি পান্তা-ইলিশের মতো কোনো উটকো বিশৃঙ্খলা ‘সংস্কৃতি’ হিসেবে গেলানো হবে? তারপর পেট খারাপ আর বদহজম। সুশীল শহুরে শিক্ষিতজনেরা এই পেট খারাপ চান না। তাই এক চিমটি ‘পরম্পরার’ ছিটা দিয়ে ‘সংস্কৃতির স্যালাইন’ জারি রাখেন। রাষ্ট্র, এজেন্সি, করপোরেট, মিডিয়া, বিদ্যায়তন সবাই সম্মতি জানায়। শহরে বা যারে ‘জাতীয় সংষ্কৃতি’ বলা হইতেছে, সেখানে এইসব চলতেছে। সংস্কৃতির স্যালাইন। এখানে গিমা শাকের আলাপ নাই, ভাতজরা ফুল বা কাইনকো ফুলের আলাপ নাই। শোভাযাত্রার নাম, শোভাযাত্রার মোটিফ কিংবা বর্ষবরণের ন্যারেটিভ কে ওলটপালট আর কর্তৃত্বে রাখতে পারে সেটাই মুখ্য বিষয়। এখানে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের বিবরণ নাই। তাহলে এত যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ আর আঘাত সয়ে কীভাবে জেগে আছে আমাদের কৃত্য-পরবেরা? কী তার শক্তি? স্যালাইনগিরি থেকে কে আমাদের বর্ষবিদায় ও বরণের পরবকে মুক্ত রাখছে? কৃত্য-পরবের মূলশক্তি হলো প্রকৃতি ও সংস্কৃতির জটিল সন্ধি। আর গ্রামীণ নিম্নবর্গের লোকায়ত বীক্ষা এবং পরম্পরাই সকল বাহাদুরির বিরুদ্ধে জাগ্রত রেখেছে সংস্কৃতির লড়াই। তো গিমা শাক তোলা কিংবা হনাগুলোর ফল সিদ্ধ করার বিশেষ কৌশল আছে। শিশুরা পরিবার ও সমাজ থেকেই এগুলো শিখে বড় হয়। দাদি, নানি, মা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের সঙ্গে শিশু-কিশোরেরা এই শাকলতা সংগ্রহ করে। ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানে। পরব আয়োজন, গীতবাদ্য পরিবেশন বিষয়ে জানে। আমাদের গ্রামীণ জনপদে এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লোকায়ত সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও জীবনদর্শন বহমান থাকে। কৃত্য-পরবের মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলিকে আড়াল করে বারবার যারা কোনো রেজিমের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া তাদের কাছে পরম্পরার কোনো মর্যাদা নাই। এক চিমটি পরম্পরা দিয়া তারা সংস্কৃতির স্যালাইন জনগণের ওপর চাপিয়ে রাখতে চান। কিন্তু তেভাগা, নানকা, টংক, মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান এই কর্তৃত্ববাদকে জানবাজি রেখে প্রশ্ন করছে। জনআকাঙ্ক্ষার দাবির ভেতর সাংস্কৃতিক দরবার ও পরম্পরাকে সামনে আনছে। পরম্পরার মর্যাদা ও মান সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।     
 প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণ, শুরু ও শেষকে মানুষের সমাজ কৃত্য-পরবের ভেতর দিয়ে মান্য করেছে। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার সমষ্টিগত বার্তা দেয় আমাদের বর্ষবিদায় ও বরণের পরবগুলো। এটাই চলমান নিওলিবারেল ব্যবস্থার জন্য প্রচণ্ড হুমকি। বৈশাখে ভাটিপরব, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কর্মাদি, শ্রাবণে করন্ডি, ভাদ্রে কারাম, আশ্বিনে দাসাই, কার্তিকে জালাবর্ত, অগ্রহায়ণে ওয়ান্না, পৌষে পুষরা, মাঘে বাঘাই শিরনি, ফাল্গুনে ঘাটাবান্ধা আর চৈত্রে চইতপরব বা চৈত্রসংক্রান্তি। একেক ঋতুতে প্রকৃতি নানা প্রাণের ভেতর দিয়ে তার সমাপনী ও শুরুর নির্দেশনা জানায়। প্রকৃতির নয়া শস্য ফসল গ্রহণ ও ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রার্থনা ও আশীর্বাদের তরে নানা সমাজ আয়োজন করে নানা কৃত্য। প্রতিটি ঋতু বেশ কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসে। প্রকৃতির নির্দেশনা। গ্রামীণ নিম্নবর্গ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির এসব নির্দেশনা মান্য করেছে, করে তুলেছে জীবনের আরাধ্য। বিকশিত হয়েছে বর্ষবিদায় ও বরণের মতো বহু কৃত্য এবং উৎসব। আজকের তরুণ প্রজন্ম কি এই ঋতুচক্র ও ব্যাকরণে বেড়ে উঠতে পারছে? তাহলে আমরা এইসব মৌলিক জিজ্ঞাসাকে কেন এতদিনেও আমাদের রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে হাজির করিনি? রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে এসব নিয়ে কোনো মৌলিক রূপরেখা নাই। তাহলে পরম্পরার গণিত টিকিয়ে রাখা কি কেবল পাহাড় ও সমতলের গ্রামীণ নিম্নবর্গের দায়িত্ব? চিহ্নিত সুশীল নাগরিক সমাজের দায় ও দায়িত্ব কোথায়? 
 চৈত্রসংক্রান্তির সর্বাধিক পরিচিত চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন, দেল, নীল বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরী সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। গ্রামে গ্রামে এখনও শিশুরা কিশোর-তরুণ-প্রবীণের দলের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। এদের গরিষ্ঠভাগই গরিব ভূমিহীন বর্গাচাষি পরিবারের। কিংবা জেলে, বনজীবী, কামার, কুমার, তাঁতি পরিবারের। এরা সবাই স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারে না। বড় হয়ে এরা দিনমজুর, কৃষক, জেলে, বর্গাচাষি, গৃহকর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিক, ইট ভাটার শ্রমিক হয়। কিন্তু এরাই শ্রম-ঘামে-জ্ঞান ও অনুশীলনে এখনও দেশের ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্যময় কৃত্য-পরবগুলো জাগিয়ে রেখেছে। এরা গ্রামে গ্রামে মাগন তোলে, এলিট ভাষায় ‘গণচাঁদা’। এখনও এরাই সমষ্টির সংহতিতে সংস্কৃতির বিকাশের জন্য লড়াই করে। কোনো বিষাক্ত পানীয় কোম্পানি বা নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বিক্রয়কারী কোম্পানি থেকে বিজ্ঞাপন নিয়ে এক চিমটি পরম্পরা গুলিয়ে সংস্কৃতির স্যালাইন বানায় না। এরা কখনোই শিল্পী বা সংস্কৃতিকর্মী বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠক– কোনো সামাজিক বর্গীয় পরিচয়ে সম্মানিত বা পরিচিত হয়ে ওঠে না। দেশের এই গরিষ্ঠভাগ গ্রামীণ নিম্নবর্গ, যারা উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তারা বর্ষবিদায় বা বরণের কৃত্য-পরবকে তার যাপিত জীবনের অংশ হিসেবেই দেখে। কোনো বহিরাগত এলিয়েন ইনভ্যাসিভ চাপানো বিশৃঙ্খলা হিসেবে নয়। তাই এই কৃত্য-পরবের টিকে থাকবার শক্তি এত প্রখর ও প্রবল।
আমরা পরম্পরা বহন করছি। এই পরম্পরা কোন পরম্পরা? কিছু বাইনারি বিভাজন, কলোনিয়াল ন্যারেটিভ আর এজেন্সির হেজমনি কিংবা মব-বাহাদুরি আমাদের পরম্পরাকে নিদারুণভাবে কোণঠাসা এবং অপর করে দেয়। সমাজের নানা স্তর ও বর্গের ক্ষমতাকাঠামো এবং অপরায়নকে প্রশ্ন না করে জোর করে কারও অবদানও খারিজ করতে চায়। বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-পরব জনআকাঙ্ক্ষার আওয়াজে বিকশিত হওয়ার জন্য আমি বা আমরা নিজেরা কতটা প্রস্তুত? কারণ আমাদের সকল কৃত্য-পরব একেকটি বিশেষ বাস্তুতন্ত্র এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে। এখানে আছে কৃষিকাজের মতো উৎপাদন সম্পর্কের বিজ্ঞান। প্রতিটি কৃত্য-পরব-উৎসবের সঙ্গে নানা গাছ, পাখি, মাছ, নদী, পাহাড়, বন প্রাণ-প্রকৃতি জড়িত। সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়ানো মানে প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়ানো। আমাদের কি সেই দায় ও দরদ আছে? চৈত্রসংক্রান্তি বা চানক্রান পরব টিকে থাকবে কেবল এই দায় ও দরদের পরম্পরার ভেতর। যদি আমরা মনে ও মগজে আমাদের কৃত্য-পরবের দর্শন এবং কারিগরি ধারণ করি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেই সম্ভাবনা এবং স্বপ্ন দেখিয়েছে। দেশজুড়ে গ্রাফিতির ভেতর দিয়ে পরম্পরার জনআকাঙ্ক্ষাই তুলে ধরেছে জেন-জি তরুণ প্রজন্ম। আমরা বিশ্বাস রাখি এই প্রজন্মের ভেতর দিয়েই সুরক্ষিত থাকবে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-পরব-উৎসবের ধারাবাহিকতা। কোনো এক চিমটি পরম্পরার স্যালাইন নয়, যাপিত জীবনের লড়াই-সংগ্রাম হয়েই টিকে থাকবে কৃত্য-পরব সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে জানান, ‘.                
      
				
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স স ক ত চর চ স স ক ত র স য ল ইন গ র ম ণ ন ম নবর গ চ ত রস ক র ন ত ক ত য পরব র র ক ত য পরব প রজন ম ব যবস থ আম দ র র জন য এই শ ক
এছাড়াও পড়ুন:
জাতির স্বার্থে খোলামেলা আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারসহ সব পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শফিকুর রহমান।
জাতীয় নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা সময়মতো ঘোষণা করা হবে বলে বলেও জানান তিনি। এছাড়া, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, জামায়াতের তালিকা কবে ঘোষণা করা হবে জানতে চাইলে দলের আমির বলেন, “তারাও (বিএনপি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭ টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আবার এটিও চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।”
“আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরো অনেককে আমরা ধারণ করব, দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।”
আসন্ন নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে জামায়াতের আমির বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই।”
মতানৈক্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: রাজনীতিতে মতানৈক্য কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”
“আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই” বলেন তিনি।
খোলামেলা আলোচনার আহ্বান:
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি ও গণভোটের বিষয়ে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি দিয়ে দিয়েছি।”
সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, উনারা সময় বেঁধে দেই নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে। সরকার ভালো কথাই বলেছে।”
তিনি বলেন, “আমরাই সবার আগে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে জাতির স্বার্থে একটা সমাধানে পৌঁছি। আমরা আশা করি, অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন।”
এর আগে গতকাল সোমবার জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি:
আবারো দলের আমির নির্বাচত হওয়া প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, “আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার ওপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য, আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়।”
বিদেশ সফরের কথা তুলে ধরে শফিকুর রহমান বলেন, “আপনারা হয়ত জানেন গত মাসের ১৯ তারিখ আমি ওমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে ওমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে সেখানে পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখা করার সুযোগ হয়েছে।”
“সেখান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আর আমরা বলেছি, প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথমবারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে।”
ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এর বাইরে যে সব শর্ত তা যেন শিথিল করে দেয়।”
তুরস্ক সফর সফল হয়েছে জানিয়ে দলটির আমির বলেন, “তুরস্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সঙ্গে আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছে জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি।”
তিনি বলেন, “দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং ইকিউয়িটির ভিত্তিতে।”
সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ভোরে ঢাকায় ফেরেন।
এ সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দলের সিনিয়র নেতারা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
দলের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলালসহ কেন্দ্রীয় আরো অনেক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা