গিমা শাকের বহু নাম। তিতা গিমা, গিমাই, গিমে, মাইটাখুদরি। দেশি ধানের জমিন, জমির আইল, রাস্তার কিনার, গ্রামীণ বন, খোলা প্রান্তর ও মাঠে এই শাক জন্মে। মুখের রুচি বাড়াতে, পেটের নানা সমস্যা মেটাতে, খোস-পাঁচড়া ও ব্যথা কমাতে এই শাক উপকারী। জ্বর, হাড়ের ব্যথা, চোখের সমস্যা, কাশি, পেট ফাঁপাসহ নানা সমস্যায় কাজে লাগে এই শাক। বসন্তের শেষে বর্ষাকালের আগ পর্যন্ত এই শাকের ব্যবহার বেশি। কিন্তু বর্তমানে গিমা শাক বিরল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উপকূল এবং হাওরাঞ্চলে। একে তো লুণ্ঠিত হচ্ছে জমিন, প্রাণ-প্রকৃতি হচ্ছে খুন, এর ওপর আবার জলবায়ু পরিবর্তনের বিষফোড়া। গিমা শাক খুব বেশি গরম সহ্য করতে পারে না। তীব্র তাপদাহে শুকিয়ে যায়, এমনকি বীজদানাও মরে যায়। গ্রামের প্রবীণ ও কিশোর নারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি, আগের মতো গিমা শাক এখন দেখা যায় না। গিমা শাকের ঝাঁঝালো তিতা স্বাদ অনেক কমে গেছে। আগের মতো ঝোপালো গিমা এখন কম দেখা যায়। তো চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলাদেশের সমতল জনপদে গিমা শাক খাওয়া হয়। কেবল গিমা নয়; মিশ্র তিতা শাক ও সবজি ছাড়া বাঙালি কি আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায় কৃত্য হয় না। নাইল্যা, দণ্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা, বাসক, ঘৃতকাঞ্চন, শেফালি, কলমি, হেলেঞ্চা, ঘুম, আদাবরুণ, পিপুল, গন্ধভাদালি, কাঁটাখুদি, ক্ষেতপাপড়া এমন ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। পাহাড়ে চাকমারা তিতকরলা, তিত্তুলগুলো, হনাগুলো, বনআলু, কচু, বাঁশকোড়লসহ নানা পাহাড়ি সবজি দিয়ে রান্না করেন ‘পাজন’ নামে খাবার। প্রায় ৩০ থেকে ১০৭ রকমের মিশ্র সবজির এই রান্নাকে চাক ভাষায় বলে ‘কাইনবোং’, মারমারা বলেন ‘হাং-র’ এবং ত্রিপুরারা বলেন ‘মৈজারবং’। গিমা শাক যেমন কমছে সমতলে, তেমনি পাহাড়ে উধাও হচ্ছে হনাগুলো বা কানাইডিঙ্গা গাছ। তাহলে চৈত্রসংক্রান্তি, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, চানক্রান, সাংগ্রাইং আয়োজন হবে কী দিয়ে? নাকি পান্তা-ইলিশের মতো কোনো উটকো বিশৃঙ্খলা ‘সংস্কৃতি’ হিসেবে গেলানো হবে? তারপর পেট খারাপ আর বদহজম। সুশীল শহুরে শিক্ষিতজনেরা এই পেট খারাপ চান না। তাই এক চিমটি ‘পরম্পরার’ ছিটা দিয়ে ‘সংস্কৃতির স্যালাইন’ জারি রাখেন। রাষ্ট্র, এজেন্সি, করপোরেট, মিডিয়া, বিদ্যায়তন সবাই সম্মতি জানায়। শহরে বা যারে ‘জাতীয় সংষ্কৃতি’ বলা হইতেছে, সেখানে এইসব চলতেছে। সংস্কৃতির স্যালাইন। এখানে গিমা শাকের আলাপ নাই, ভাতজরা ফুল বা কাইনকো ফুলের আলাপ নাই। শোভাযাত্রার নাম, শোভাযাত্রার মোটিফ কিংবা বর্ষবরণের ন্যারেটিভ কে ওলটপালট আর কর্তৃত্বে রাখতে পারে সেটাই মুখ্য বিষয়। এখানে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের বিবরণ নাই। তাহলে এত যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ আর আঘাত সয়ে কীভাবে জেগে আছে আমাদের কৃত্য-পরবেরা? কী তার শক্তি? স্যালাইনগিরি থেকে কে আমাদের বর্ষবিদায় ও বরণের পরবকে মুক্ত রাখছে? কৃত্য-পরবের মূলশক্তি হলো প্রকৃতি ও সংস্কৃতির জটিল সন্ধি। আর গ্রামীণ নিম্নবর্গের লোকায়ত বীক্ষা এবং পরম্পরাই সকল বাহাদুরির বিরুদ্ধে জাগ্রত রেখেছে সংস্কৃতির লড়াই। তো গিমা শাক তোলা কিংবা হনাগুলোর ফল সিদ্ধ করার বিশেষ কৌশল আছে। শিশুরা পরিবার ও সমাজ থেকেই এগুলো শিখে বড় হয়। দাদি, নানি, মা, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের সঙ্গে শিশু-কিশোরেরা এই শাকলতা সংগ্রহ করে। ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানে। পরব আয়োজন, গীতবাদ্য পরিবেশন বিষয়ে জানে। আমাদের গ্রামীণ জনপদে এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লোকায়ত সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও জীবনদর্শন বহমান থাকে। কৃত্য-পরবের মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলিকে আড়াল করে বারবার যারা কোনো রেজিমের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া তাদের কাছে পরম্পরার কোনো মর্যাদা নাই। এক চিমটি পরম্পরা দিয়া তারা সংস্কৃতির স্যালাইন জনগণের ওপর চাপিয়ে রাখতে চান। কিন্তু তেভাগা, নানকা, টংক, মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান এই কর্তৃত্ববাদকে জানবাজি রেখে প্রশ্ন করছে। জনআকাঙ্ক্ষার দাবির ভেতর সাংস্কৃতিক দরবার ও পরম্পরাকে সামনে আনছে। পরম্পরার মর্যাদা ও মান সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।     
প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণ, শুরু ও শেষকে মানুষের সমাজ কৃত্য-পরবের ভেতর দিয়ে মান্য করেছে। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষার সমষ্টিগত বার্তা দেয় আমাদের বর্ষবিদায় ও বরণের পরবগুলো। এটাই চলমান নিওলিবারেল ব্যবস্থার জন্য প্রচণ্ড হুমকি। বৈশাখে ভাটিপরব, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কর্মাদি, শ্রাবণে করন্ডি, ভাদ্রে কারাম, আশ্বিনে দাসাই, কার্তিকে জালাবর্ত, অগ্রহায়ণে ওয়ান্না, পৌষে পুষরা, মাঘে বাঘাই শিরনি, ফাল্গুনে ঘাটাবান্ধা আর চৈত্রে চইতপরব বা চৈত্রসংক্রান্তি। একেক ঋতুতে প্রকৃতি নানা প্রাণের ভেতর দিয়ে তার সমাপনী ও শুরুর নির্দেশনা জানায়। প্রকৃতির নয়া শস্য ফসল গ্রহণ ও ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রার্থনা ও আশীর্বাদের তরে নানা সমাজ আয়োজন করে নানা কৃত্য। প্রতিটি ঋতু বেশ কিছু নির্দেশনা নিয়ে আসে। প্রকৃতির নির্দেশনা। গ্রামীণ নিম্নবর্গ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির এসব নির্দেশনা মান্য করেছে, করে তুলেছে জীবনের আরাধ্য। বিকশিত হয়েছে বর্ষবিদায় ও বরণের মতো বহু কৃত্য এবং উৎসব। আজকের তরুণ প্রজন্ম কি এই ঋতুচক্র ও ব্যাকরণে বেড়ে উঠতে পারছে? তাহলে আমরা এইসব মৌলিক জিজ্ঞাসাকে কেন এতদিনেও আমাদের রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে হাজির করিনি? রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে এসব নিয়ে কোনো মৌলিক রূপরেখা নাই। তাহলে পরম্পরার গণিত টিকিয়ে রাখা কি কেবল পাহাড় ও সমতলের গ্রামীণ নিম্নবর্গের দায়িত্ব? চিহ্নিত সুশীল নাগরিক সমাজের দায় ও দায়িত্ব কোথায়? 
চৈত্রসংক্রান্তির সর্বাধিক পরিচিত চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন, দেল, নীল বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরী সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। গ্রামে গ্রামে এখনও শিশুরা কিশোর-তরুণ-প্রবীণের দলের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। এদের গরিষ্ঠভাগই গরিব ভূমিহীন বর্গাচাষি পরিবারের। কিংবা জেলে, বনজীবী, কামার, কুমার, তাঁতি পরিবারের। এরা সবাই স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারে না। বড় হয়ে এরা দিনমজুর, কৃষক, জেলে, বর্গাচাষি, গৃহকর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিক, ইট ভাটার শ্রমিক হয়। কিন্তু এরাই শ্রম-ঘামে-জ্ঞান ও অনুশীলনে এখনও দেশের ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্যময় কৃত্য-পরবগুলো জাগিয়ে রেখেছে। এরা গ্রামে গ্রামে মাগন তোলে, এলিট ভাষায় ‘গণচাঁদা’। এখনও এরাই সমষ্টির সংহতিতে সংস্কৃতির বিকাশের জন্য লড়াই করে। কোনো বিষাক্ত পানীয় কোম্পানি বা নিষিদ্ধ প্লাস্টিক বিক্রয়কারী কোম্পানি থেকে বিজ্ঞাপন নিয়ে এক চিমটি পরম্পরা গুলিয়ে সংস্কৃতির স্যালাইন বানায় না। এরা কখনোই শিল্পী বা সংস্কৃতিকর্মী বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠক– কোনো সামাজিক বর্গীয় পরিচয়ে সম্মানিত বা পরিচিত হয়ে ওঠে না। দেশের এই গরিষ্ঠভাগ গ্রামীণ নিম্নবর্গ, যারা উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তারা বর্ষবিদায় বা বরণের কৃত্য-পরবকে তার যাপিত জীবনের অংশ হিসেবেই দেখে। কোনো বহিরাগত এলিয়েন ইনভ্যাসিভ চাপানো বিশৃঙ্খলা হিসেবে নয়। তাই এই কৃত্য-পরবের টিকে থাকবার শক্তি এত প্রখর ও প্রবল।

আমরা পরম্পরা বহন করছি। এই পরম্পরা কোন পরম্পরা? কিছু বাইনারি বিভাজন, কলোনিয়াল ন্যারেটিভ আর এজেন্সির হেজমনি কিংবা মব-বাহাদুরি আমাদের পরম্পরাকে নিদারুণভাবে কোণঠাসা এবং অপর করে দেয়। সমাজের নানা স্তর ও বর্গের ক্ষমতাকাঠামো এবং অপরায়নকে প্রশ্ন না করে জোর করে কারও অবদানও খারিজ করতে চায়। বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-পরব জনআকাঙ্ক্ষার আওয়াজে বিকশিত হওয়ার জন্য আমি বা আমরা নিজেরা কতটা প্রস্তুত? কারণ আমাদের সকল কৃত্য-পরব একেকটি বিশেষ বাস্তুতন্ত্র এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে। এখানে আছে কৃষিকাজের মতো উৎপাদন সম্পর্কের বিজ্ঞান। প্রতিটি কৃত্য-পরব-উৎসবের সঙ্গে নানা গাছ, পাখি, মাছ, নদী, পাহাড়, বন প্রাণ-প্রকৃতি জড়িত। সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়ানো মানে প্রকৃতির পক্ষে দাঁড়ানো। আমাদের কি সেই দায় ও দরদ আছে? চৈত্রসংক্রান্তি বা চানক্রান পরব টিকে থাকবে কেবল এই দায় ও দরদের পরম্পরার ভেতর। যদি আমরা মনে ও মগজে আমাদের কৃত্য-পরবের দর্শন এবং কারিগরি ধারণ করি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেই সম্ভাবনা এবং স্বপ্ন দেখিয়েছে। দেশজুড়ে গ্রাফিতির ভেতর দিয়ে পরম্পরার জনআকাঙ্ক্ষাই তুলে ধরেছে জেন-জি তরুণ প্রজন্ম। আমরা বিশ্বাস রাখি এই প্রজন্মের ভেতর দিয়েই সুরক্ষিত থাকবে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য-পরব-উৎসবের ধারাবাহিকতা। কোনো এক চিমটি পরম্পরার স্যালাইন নয়, যাপিত জীবনের লড়াই-সংগ্রাম হয়েই টিকে থাকবে কৃত্য-পরব সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে জানান, ‘.

..মানুষ সৃষ্টির শেষ সন্তান বলেই মানুষ সৃষ্টির মধ্যে সকলের চেয়ে প্রাচীন। সৃষ্টির যুগযুগান্তরের ইতিহাসের বিপুল ধারা আজ মানুষের মধ্যে এসে মিলেছে। মানুষের নিজের মনুষ্যত্বের মধ্যে জড়ের ইতিহাস, উদ্ভিদের ইতিহাস, পশুর ইতিহাস সমস্তই একত্রে বহন করছে। প্রকৃতির কত লক্ষ কোটি বৎসরের ধারাবাহিক সংস্কার ভার তাকে আশ্রয় করেছে।’ আমরা আদতেই জানি না, আমরা কোন পরম্পরা কীভাবে বহন করে চলেছি। আমাদের শরীরের জিনলিপি কিংবা আমাদের সংস্কৃতির দিনলিপিতে? নিয়ানডার্থাল, ডেনিসোভান, ইরেকটাস, ফ্লোরিয়েনসিস মানুষের সাংস্কৃতিক পরম্পরাও আমরা বহন করি। ভূগোল, জাতি, শ্রেণি-বর্গ ভিন্নতায় কত বিস্ময়কর আমাদের পরম্পরা। মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই অভ্যুত্থান জনগণের সাংস্কৃতিক পরম্পরা বিকাশের আওয়াজ উঠেছে। কোনো বার্তা, বিবৃতি, বাইনারি, বাহাদুরি, বাকশালি কিংবা বলপ্রয়োগে এই আওয়াজ নিভবে না। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স স ক ত চর চ স স ক ত র স য ল ইন গ র ম ণ ন ম নবর গ চ ত রস ক র ন ত ক ত য পরব র র ক ত য পরব প রজন ম ব যবস থ আম দ র র জন য এই শ ক

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ