গাজা জেনোসাইড মামলায় বাংলাদেশের ‘ইন্টারভেনশন’
Published: 13th, April 2025 GMT
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সাম্প্রতিক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের গত ৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক নিন্দা জ্ঞাপনের ঘটনায় বিগত সরকারের সময় করা একটি প্রতিশ্রুতির কথা সামনে এসেছে। ২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জেনোসাইড কনভেনশনের কিছু প্রবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে মামলা করে। এ মামলা করার ১৬ দিন পর অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক প্রেস স্টেটমেন্ট দিয়ে জানায়, বাংলাদেশ এ মামলায় ‘ইন্টারভেনশন’ করতে আগ্রহী। এর আগে ১৩টি রাষ্ট্র এ মামলায় ইন্টারভেনশন করতে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে বিগত দেড় বছর নীরব থেকেছে। গাজায় সহিংসতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকার এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বাধ্যবাধকতাকে উল্লেখ করে আসছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ অনুসারে বাংলাদেশ ‘সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ এর আগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে প্যালেস্টাইন সংক্রান্ত চারটি অ্যাডভাইজরি অপিনিয়নের কার্যপ্রণালিতে অংশগ্রহণ করেছে। তা ছাড়া ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া ও জিবুতির সঙ্গে যৌথভাবে প্যালেস্টাইন ইস্যুকে আইসিসির কাছে তদন্তের আহ্বান করে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন এতদিন ধরে তার ইন্টারভেনশনের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে নীরব– তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
আইসিজেতে সাম্প্রতিক বেশ কিছু জেনোসাইড কনভেনশন সম্পর্কিত মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলা ও ইউক্রেনীয় জেনোসাইড অভিযোগ মামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্র ইন্টারভেনশনের আগ্রহ দেখিয়েছে। গাজা জেনোসাইড মামলাতেও বেশ কিছু রাষ্ট্র ইন্টারভেনশন করবে বলে অনুমান করা হচ্ছিল। তাই ১৩টি রাষ্ট্রের ইন্টারভেনশনের ইচ্ছা প্রকাশ মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়।
এর আগে আইসিজের কোনো মামলায় ইন্টারভেনশন করেনি। রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলায় ইন্টারভেনশন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগ হাতছাড়া করে। তাই গাজা জেনোসাইড মামলায় বাংলাদেশের প্রকৃতি ও বিস্তার কী হবে, সে সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। তবে আইসিজের আইনি কাঠামো ও ইন্টারভেনশন-সংক্রান্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের নজির এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইন্টারভেনশন বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রিজার্ভেশন প্রদান করায় বাংলাদেশের ইন্টারভেনশনের বিষয় একটু জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশ জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যতীত সব অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইন্টারভেনশন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রিলিমিনারি অবজেকশনসের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আইসিজে এ মামলার প্রভিশনাল মেজারস আদেশে প্রাথমিকভাবে আদালতের এখতিয়ার নির্ধারণ করেছেন। অন্যদিকে এ মামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলার সাদৃশ্য থাকায় এবং উক্ত মামলায় মিয়ানমারের দাখিলকৃত প্রিলিমিনারি অবজেকশনস খারিজ হওয়ায় আইসিজে ইসরায়েলের প্রিলিমিনারি অবজেকশনসকে ইতিবাচকভাবে রায় দেবেন বলে ধারণা করা বাস্তবসম্মত নয়। তবে ইসরায়েল যদি প্রিলিমিনারি অবজেকশনস দায়ের করে, বাংলাদেশ এই ইন্টারভেনশন দায়ের করার জন্য দুই বছর অতিরিক্ত সময় পাবে। কিন্তু গাজা জেনোসাইড মামলার রাজনৈতিক ও আইনি গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ সরকারকে অতি সত্বর ইন্টারভেনশন করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা উচিত।
একই সঙ্গে বাংলাদেশকে তার ইন্টারভেনশনের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বিষয়াদি নির্ধারণ করতে হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগগুলো জেনোসাইড কনভেনশনের প্রথম চারটি অনুচ্ছেদ-সংক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আইসিজেতে ইন্টারভেনশন করার অনুমতি পেতে সমর্থ হলে আইসিজে বাংলাদেশকে এ মামলা-সংক্রান্ত সব গোপনীয় ও অপ্রকাশ্য নথি প্রদান করতে দায়বদ্ধ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ইন্টারভেনশনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যেহেতু বেশ কিছু রাষ্ট্র এ মামলায় ইন্টারভেনশন করবে; বাংলাদেশকে এমনভাবে ইন্টারভেনশন করা উচিত যাতে এই মামলায় উক্ত ইন্টারভেনশন প্রভাব ফেলতে পারে।
গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রিলিমিনারি অবজেকশনসকে এক পাশে রেখে বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব ইন্টারভেনশন করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা উচিত। যদিও আইসিজে ৬৩ নম্বর অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত ইন্টারভেনশনের আবেদনের বৈধতা নিরীক্ষা করে; তবে এ পর্যন্ত অধিকাংশ আবেদন গৃহীত হয়েছে। যেহেতু ইতোমধ্যে ১৩টি রাষ্ট্র গাজা জেনোসাইড মামলায় ইন্টারভেনশন করার আবেদন করেছে; বাংলাদেশকে প্রিলিমিনারি অবজেকশনসের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা সমুচিত হবে না। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ববর্তী সরকারের ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতাকে পুনর্ব্যক্ত করে আইসিজের কাছে ইন্টারভেনশনের আবেদন জমাদানের সময়সীমা ঘোষণা করা উচিত।
কাজী ওমর ফয়সাল: আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) আইনের প্রভাষক
foysal.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল দ শ সরক র র অন চ ছ দ ইসর য় ল উল ল খ আইস জ
এছাড়াও পড়ুন:
মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।
মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?
তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।
সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?
সরকারের পক্ষ থেকে রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন, সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!
এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]