ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সাম্প্রতিক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের গত ৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক নিন্দা জ্ঞাপনের ঘটনায় বিগত সরকারের সময় করা একটি প্রতিশ্রুতির কথা সামনে এসেছে। ২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জেনোসাইড কনভেনশনের কিছু প্রবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে মামলা করে। এ মামলা করার ১৬ দিন পর অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক প্রেস স্টেটমেন্ট দিয়ে জানায়, বাংলাদেশ এ মামলায় ‘ইন্টারভেনশন’ করতে আগ্রহী। এর আগে ১৩টি রাষ্ট্র এ মামলায় ইন্টারভেনশন করতে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে বিগত দেড় বছর নীরব থেকেছে। গাজায় সহিংসতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার দাবি রাখে।

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকার এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বাধ্যবাধকতাকে উল্লেখ করে আসছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ অনুসারে বাংলাদেশ ‘সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ এর আগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে প্যালেস্টাইন সংক্রান্ত চারটি অ্যাডভাইজরি অপিনিয়নের কার্যপ্রণালিতে অংশগ্রহণ করেছে। তা ছাড়া ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া ও জিবুতির সঙ্গে যৌথভাবে প্যালেস্টাইন ইস্যুকে আইসিসির কাছে তদন্তের আহ্বান করে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন এতদিন ধরে তার ইন্টারভেনশনের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে নীরব– তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।

আইসিজেতে সাম্প্রতিক বেশ কিছু জেনোসাইড কনভেনশন সম্পর্কিত মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলা ও ইউক্রেনীয় জেনোসাইড অভিযোগ মামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্র ইন্টারভেনশনের আগ্রহ দেখিয়েছে। গাজা জেনোসাইড মামলাতেও বেশ কিছু রাষ্ট্র ইন্টারভেনশন করবে বলে অনুমান করা হচ্ছিল। তাই ১৩টি রাষ্ট্রের ইন্টারভেনশনের ইচ্ছা প্রকাশ মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়।
এর আগে আইসিজের কোনো মামলায় ইন্টারভেনশন করেনি। রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলায় ইন্টারভেনশন করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগ হাতছাড়া করে। তাই গাজা জেনোসাইড মামলায় বাংলাদেশের প্রকৃতি ও বিস্তার কী হবে, সে সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। তবে আইসিজের আইনি কাঠামো ও ইন্টারভেনশন-সংক্রান্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের নজির এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইন্টারভেনশন বুঝতে সাহায্য করতে পারে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে রিজার্ভেশন প্রদান করায় বাংলাদেশের ইন্টারভেনশনের বিষয় একটু জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশ জেনোসাইড কনভেনশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যতীত সব অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইন্টারভেনশন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রিলিমিনারি অবজেকশনসের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আইসিজে এ মামলার প্রভিশনাল মেজারস আদেশে প্রাথমিকভাবে আদালতের এখতিয়ার নির্ধারণ করেছেন। অন্যদিকে এ মামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলার সাদৃশ্য থাকায় এবং উক্ত মামলায় মিয়ানমারের দাখিলকৃত প্রিলিমিনারি অবজেকশনস খারিজ হওয়ায় আইসিজে ইসরায়েলের প্রিলিমিনারি অবজেকশনসকে ইতিবাচকভাবে রায় দেবেন বলে ধারণা করা বাস্তবসম্মত নয়। তবে ইসরায়েল যদি প্রিলিমিনারি অবজেকশনস দায়ের করে, বাংলাদেশ এই ইন্টারভেনশন দায়ের করার জন্য দুই বছর অতিরিক্ত সময় পাবে। কিন্তু গাজা জেনোসাইড মামলার রাজনৈতিক ও আইনি গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বাংলাদেশ সরকারকে অতি সত্বর ইন্টারভেনশন করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা উচিত।

একই সঙ্গে বাংলাদেশকে তার ইন্টারভেনশনের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বিষয়াদি নির্ধারণ করতে হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগগুলো জেনোসাইড কনভেনশনের প্রথম চারটি অনুচ্ছেদ-সংক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আইসিজেতে ইন্টারভেনশন করার অনুমতি পেতে সমর্থ হলে আইসিজে বাংলাদেশকে এ মামলা-সংক্রান্ত সব গোপনীয় ও অপ্রকাশ্য নথি প্রদান করতে দায়বদ্ধ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ইন্টারভেনশনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যেহেতু বেশ কিছু রাষ্ট্র এ মামলায় ইন্টারভেনশন করবে; বাংলাদেশকে এমনভাবে ইন্টারভেনশন করা উচিত যাতে এই মামলায় উক্ত ইন্টারভেনশন প্রভাব ফেলতে পারে। 

গাজা উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রিলিমিনারি অবজেকশনসকে এক পাশে রেখে বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব ইন্টারভেনশন করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা উচিত। যদিও আইসিজে ৬৩ নম্বর অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত ইন্টারভেনশনের আবেদনের বৈধতা নিরীক্ষা করে; তবে এ পর্যন্ত অধিকাংশ আবেদন গৃহীত হয়েছে। যেহেতু ইতোমধ্যে ১৩টি রাষ্ট্র গাজা জেনোসাইড মামলায় ইন্টারভেনশন করার আবেদন করেছে; বাংলাদেশকে প্রিলিমিনারি অবজেকশনসের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা সমুচিত হবে না। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ববর্তী সরকারের ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতাকে পুনর্ব্যক্ত করে আইসিজের কাছে ইন্টারভেনশনের আবেদন জমাদানের সময়সীমা ঘোষণা করা উচিত।

কাজী ওমর ফয়সাল: আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) আইনের প্রভাষক
foysal.

quazi@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল দ শ সরক র র অন চ ছ দ ইসর য় ল উল ল খ আইস জ

এছাড়াও পড়ুন:

অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে বাসের নিচে, দুই বন্ধু নিহত

রাজধানীতে অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে বাসের নিচে পড়ে দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার বনশ্রীর এফ ব্লক সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এদিন মতিঝিলের ফকিরাপুল মোড়ে প্রাইভেট কারের চাপায় আব্দুল মতিন (৩৬) নামে এক রিকশাচালক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন।

বনশ্রীতে নিহত দু’জন হলেন– আব্দুল্লাহ আল নোমান (২১) ও পাভেল মিয়া (২০)। নোমানের মামা আব্দুল হামিদ জানান, নিহতরা পরস্পর বন্ধু। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে ঢাকায় ঘুরতে যাওয়ার সময় দু’জন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তারা রূপগঞ্জের নামারমুসুরি এলাকায় থাকতেন। নোমান মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পাভেল তেমন কিছুই করতেন না। এ ঘটনায় নোমানের পরিবারের পক্ষ থেকে সড়ক নিরাপত্তা আইনে খিলগাঁও থানায় মামলা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী মোটরসাইকেল চালক টিপু সুলতান বলেন, সড়কটি যানবাহনে ঠাসা ছিল। এ কারণে গাড়ি চলছিল ধীরগতিতে। হঠাৎ একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাশ থেকে এসে নোমানের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে দু’জন সড়কের ওপর ছিটকে পড়েন। পরে মিয়ামি পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। নোমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। মোটরসাইকেল আরোহী পাভেলকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

খিলগাঁও থানার ওসি দাউদ হোসেন জানান, বাসটি জব্দ করা হয়েছে। চালক ও তার সহকারী পালিয়ে গেছে। অটোরিকশা চালককেও আটক করা যায়নি। মরদেহ দুটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফকিরাপুল মোড়ে প্রাইভেটকারের চাপায় প্রাণ হারান রিকশাচালক আব্দুল মতিন। তাঁর বাড়ি রংপুরে। তিনি মুগদার মাণ্ডা এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজে থাকতেন। মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাইমিনুল ইসলাম জানান, প্রাইভেটকারের চালক আল আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়েছে। ময়নাতন্ত শেষে পরিবারের কাছে মতিনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে বিমানবন্দর থানার সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার গেটের (সি-টাইপ) সামনের ফুটপাত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। বিমানবন্দর থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, ওই যুবকের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। মরদেহ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে।

সড়কে ঝরল আরও ছয় প্রাণ
খুলনার ডুমুরিয়ায় তেলবাহী লরির চাপায় দুই নারী নিহত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের নরনিয়া মহিলা মাদ্রাসার কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন– রোকেয়া বেগম (৫৫) ও রশিদা বেগম (৪৫)।

গতকাল সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছে সেলফি পরিবহনের বাসের ধাক্কায় শামসুল হক নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরে গণস্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। সাভার থেকে অবসরের পাওনাদি নিয়ে ফেরার পথে তিনি প্রাণ হারান। শামসুলের বাড়ি চাঁদপুরে। ঘটনার পর গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মচারীরা সেলফি পরিবহনের পাঁচটি বাস আটক করেন।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অটোরিকশা ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নয়ন মিয়া (৩৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০ জন। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া ইউনিয়নের রতনদী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে শান্ত ইসলাম (১৮) নামে এক তরুণ নিহত হয়েছেন। গতকাল উপজেলার কুষ্টিয়া-প্রাগপুর সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শান্ত মথুরাপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের রিপন মণ্ডলের ছেলে। 

রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী বাজারে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে ছিটকে পড়ে স্বপন শীল নামে এক স্যালুন ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। গতকাল ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র বিলি করতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ