৪ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত খোশমেজাজ ও সদলবলে গলফ খেলে দিনটি কাটিয়েছেন; চেহারায় টেনশনের ছাপমাত্র নেই। টর্নেডোয় দেশের নানা প্রান্তে লন্ডভন্ড ঘরবাড়ি-গাড়ি আর স্টক মার্কেটে চরম মন্দার আশঙ্কার মধ্যেও কেন তিনি গলফ খেলতে গেলেন—এ নিয়ে তাঁর দেশে হইহল্লা নেই, আপত্তি-তিরস্কার নেই!

মার্কিন পুঁজিবাদ এতটাই শক্তিধর, দুর্যোগকালেও প্রেসিডেন্টের গলফ খেলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার এবং অসংবেদনশীলতারও কিছু হয়নি—জনমনে এমন ধারণা পুঁতে দিতে পেরেছে। তাই দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দুঃখী-দুঃখী চেহারা দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট অভিনয় করে বলবেন, টর্নেডোয় দেশ বিপর্যস্ত, তাই আজকের গলফ খেলা ক্যানসেল করেছি—এ রকম সংবেদনশীলতার স্তর মার্কিন পুঁজিবাদ তিরিশের মহামন্দা থেকে মুক্তির পরই পেরিয়ে এসেছে।

দরিদ্র দেশগুলো এখনো অর্থনীতিতে অনেক পেছানো বলেই এ রকম সংবেদনশীলতা দেশগুলোতে এখনো প্রত্যাশিত। কারণ, অনুন্নত দেশে ‘সংবেদনশীলতা’ সামাজিক অর্থনীতির দরকারি অনুষঙ্গও বটে। ভাবুন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এ রকম সময়ে গলফ খেলতে গেলেন, জনগণ তাঁকে আস্ত রাখত?

২.

মহাশক্তিধর পুঁজিবাদ আর পুঁজিবাদের ছিটেফোঁটা আঁকড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টারত দেশগুলোকে এক পাল্লায় মেপে বাণিজ্যযুদ্ধকে পাঠ করাটা সঠিক হবে না। মাত্র মাস দুয়েক আগে অল্প কয়েক দিনের দাবানলে শুধু লস অ্যাঞ্জেলেসেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের কাম্য বাৎসরিক গড় বৈদেশিক রিজার্ভের ১০ গুণ বেশি। ট্যারিফ ঘোষণার মাত্র দুই দিনের মাথায় পুঁজিবাজারের ক্ষতির পরিমাণ ছয় ট্রিলিয়ন ডলার। মধ্য এপ্রিল নাগাদ এই অঙ্ক ১০ ট্রিলিয়নে গড়ানোর পূর্বাভাস আছে। আরও পূর্বাভাস হচ্ছে, আগামী বছর মার্কিন জিডিপির হার ২ শতাংশ কমবে। চার সদস্যের খানাভিত্তিক সাধারণ জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে গড়পড়তা অতিরিক্ত চার হাজার ডলার।

এদিকে ট্রাম্প প্রতিদিনই বলছেন, ট্যারিফ আরোপ খুব ভালো কাজ করছে। ভয়ের কিছুই নেই। এটা ‘শর্ট টার্ম পেইন’। কিছুটা কষ্ট সয়ে নিতে বলছেন জনগণকে। কারণ, তারপরই আসবে ‘লং টার্ম গেইন’। তিনি বলছেন, মার্কিন অর্থনীতিতে সাময়িক টালমাটাল অবস্থা, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়া, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি কাটিয়ে দ্রুতই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়াবে আমেরিকা। আমেরিকার সব রকম সম্পদই আছে। কারও মুখাপেক্ষী হওয়ার দরকার নেই। এখন অসংখ্য–অজস্র কলকারখানা ও শিল্প গড়ে উঠবে, চাকরি ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

মার্কিন পুঁজিবাদের ক্রীড়নকেরা জানে কীভাবে জনগণকে ঠান্ডা রাখতে হয়। মার্চ শেষেই খবর হলো, দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাতশিল্প গড়ে দেবে। বিনিয়োগের অঙ্ক চার ট্রিলিয়ন ডলার। স্থানীয় বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু হুমকি থেকে রক্ষাই এই বিনিয়োগের গোপন উদ্দেশ্য। অনেকের সন্দেহ এরপর চীনের হুমকি থেকে মুক্ত থাকতে তাইওয়ান বিনিয়োগ করতে পারে। ন্যাটোকে টিকিয়ে রাখতে হয়তো ইউরোপও বিনিয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ উদ্দেশ্য শতভাগ অর্থনৈতিক নয়, ভূরাজনৈতিক। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আশা করছেন, এরপর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ধনী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বিনিয়োগ করবে।

এপ্রিলের ৫ তারিখের খবর—মার্চ ও এপ্রিল প্রান্তিকে ২ লাখ ২৮ হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা গত চার বছরে সর্বোচ্চ। জনগণ ভাবছে লক্ষণ তো ভালোই! গত মাসে ঘোষণা হয়েছে, স্বল্প ও মধ্য আয়ের পরিবারপ্রতি ৫০০০ ডলার প্রণোদনা দেওয়া হবে সাময়িক অর্থনৈতিক ঝড়ঝাপটা মোকাবিলার জন্য। ইউএসএআইডিসহ অন্যান্য অসংখ্য ‘মাথাভারী’ সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বেদরকারি অপচয় রোধ করে বাঁচানো অর্থভান্ডার হতে প্রণোদনাটি দেওয়া হবে। জনগণের বড় অংশ এতেই উল্লসিত। ইতিমধ্যে জানা গেল যাঁরা চাকরি থেকে অবসরে যাবেন, কিন্তু স্টক মার্কেট বিপর্যয়ের কারণে স্টকে লগ্নি করা পেনশনে টান পড়েছে, তাঁদের পেনশনের সঙ্গে অতিরিক্ত দুই বছরের চাকরির পেনশনের সমান প্রণোদনা যুক্ত করা হবে।

বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ শুনছিলাম। ২ লাখ ২৮ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের তথ্যে অনেক ফাঁক ও ফাঁকি আছে। এই সংখ্যার অর্ধেকসংখ্যক জনবলকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেসব শূন্যস্থান পূরণের পর নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা নেমে আসবে ঘোষিত সংখ্যার অর্ধেকে। আরও ফাঁকির বিষয় হচ্ছে, চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই উচ্চতর যোগ্যতার। তাঁদের কোনো কোনো ব্যক্তির বার্ষিক আয়ের সমপরিমাণ অর্থে নতুন ১০ জনের চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে। ঘোষিত চাকরিগুলোর সিংহভাগই ন্যূনতম মজুরি ও কর্মজীবন শুরুর প্রান্তিক পর্যায়ের আয়কাঠামোর।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী নব্য উদারতাবাদী অর্থনীতির আলোচকদের বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, গত পাঁচ দশকে প্রতিষ্ঠা পাওয়া উদার অর্থনীতির প্রাসাদের গায়ে অতিরক্ষণশীল ‘ট্রাম্পোনমিকসের’ হাতুড়ির বাড়ি আমেরিকাকে সামনে এগিয়ে নেবে, নাকি পেছনে ফেরাবে।

৩.

বাংলাদেশের ওপরও ‘ট্রাম্পোনমিকসের’ খড়্গ নেমেছে। অনেকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে দেখতে পাচ্ছি, মার্কিন বাণিজ্যঘাটতি সমন্বয়ের চেষ্টার পরিসংখ্যানগত একটি সমীকরণেই জোর দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষণ এ রকম: যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলো (হার্টল্যান্ড) থেকে সয়াবিন, গম, ভুট্টাসহ যেসব পণ্য আমাদের লাগবেই, সেগুলোর আমদানি বাড়িয়ে মার্কিন বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনা যায়।

কিন্তু এসব বিশ্লেষণ ‘বাণিজ্যঘাটতি’র বাইরে ট্রাম্পোনমিকসের দুটি অন্যতম লক্ষ্যকে আমলেই নিচ্ছে না। সেই দুটির প্রথমটি ‘নেগোসিয়েশন’। ট্রাম্প মনে লুকিয়ে না রেখে খোলাখুলিই বলেছেন, ট্যারিফের চাপ সব রাষ্ট্রকে আমেরিকার অধীন সমঝোতার টেবিলে বসতে বাধ্য করবে। চীন এই কৌশলকে বলেছে ‘ইউনিল্যাটার‍্যাল বুলিং’ বা ‘একতরফা মাস্তানি’।

বাণিজ্যঘাটতিকেই মূল বিষয় ধরে বিশ্লেষণ ‘বিপজ্জনক’। ধরুন, বাংলাদেশ কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানির ব্যাপক পঠন-পাঠন-গবেষণা শেষে বাণিজ্যঘাটতি নিরসন পরিকল্পনা নিয়ে সমঝোতার টেবিলে বসতে গেল। আমেরকি বলল, ‘তোমাদের লম্বা-চওড়া পরিকল্পনাটি অসাধারণ। কিন্তু এত দীর্ঘসূত্রী যন্ত্রণার বদলে তোমরা দুটি এফ-৩২ জঙ্গি বিমান কিনে নাও। তাহলেই আর ঘাটতি থাকে না।’ অথবা বলতে পারে, ‘৫টি কার্গো বিমান কিনে নাও। আমরা পরিকল্পনা দিচ্ছি কীভাবে বিমানবহর তোমাদের অর্থনীতিকে আকাশ ছুঁইছুঁই করে তুলবে।’ তখন কী করবে বাংলাদেশ? বাংলাদেশ কি যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই দর–কষাকষির শক্তি, সামর্থ্য বা সাহস দেখাতে পারবে?

ট্রাম্পোনমিকসের দ্বিতীয় লক্ষ্য, ‘ম্যানুফ্যাকচারিংকে বিদেশ থেকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা’। ফরিদ জাকারিয়াসহ অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, মার্কিন অর্থনীতি নিত্যদিনের ভোগ্যপণ্য উৎপাদনবান্ধব নয়। মার্কিন অর্থনীতি কাঠামোর গড়ন-গঠনই এমন: ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন হবে ১০ থেকে ১১ শতাংশ, বাকি প্রায় ৯০ শতাংশই হবে সেবা, জ্ঞানবিজ্ঞান-গবেষণা, কৃৎকৌশল ও ভারী শিল্পনির্ভর। দুনিয়া জানে দেশটির অর্থনীতির আরেক নাম ‘ওয়্যার ইকোনমি’। সেই একই দেশ কি সত্যি সত্যিই গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, রুমাল উৎপাদনে যাবে?

যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো ম্যানুফ্যাকচারিং বিষয়টি প্রায় পুরোটাই আউটসোর্স করে দিয়েছিল বিশ্বময়। সে জন্য সত্তরের দশক থেকে সারা পৃথিবীময় বয়ানও তৈরি করা হয়েছিল নব্য উদার মুক্তবাজার অর্থনীতির। পরামর্শ—‘বাজার খুলে দাও, বাণিজ্যের সব বাধা সরাও, প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি গড়ো, সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক ভাবনা ঝেড়ে ফেলো’।

ফলে গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিকস, জুতা, স্পোর্টসওয়্যার, খেলনা, সফটওয়্যার ইত্যাদি হেন কোনো ম্যানুফ্যাকচারিং নেই, যা বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনামসহ আরও অসংখ্য উন্নয়নশীল দেশে আউটসোর্স করা হয়নি। বাজার অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিয়ে গেছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার গ্যাট-১৯৯৪ ও নাফটা চুক্তি।

এই সত্য এখন অর্থনীতির স্কুলছাত্ররাও জানে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন করতে গেলে একটি ক্যালভিন ক্লেইনের শার্টের দাম পড়বে প্রায় ৩০০ ডলার। অথচ আউটসোর্সিংয়ের সুযোগে ডিজাইনসহ শার্টটির সেলাই, সুতা, বোতামের স্পেসিফিকেশনের ডিটেইল ই–মেইলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও’ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। কোনো ঝক্কি-ঝামেলা, নিয়মকানুনের যন্ত্রণা নেই। বাংলাদেশ ১০ ডলার খরচে শার্টটি তৈরি করবে। পাঠানোসহ খরচ পড়বে ১২ ডলার। লাভ নেবে ১ ডলার। সাকল্যে ১৩ ডলার বাংলাদেশি বিক্রেতাকে দিয়ে ক্যালভিন ক্লেইন আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে পাইকারি বিক্রি করবে ২৫ ডলারে। একটি শার্টেই ১২ ডলার লাভ!

 একই ‘পুটিং আউট’ ইকোনমিক সিস্টেম প্রযোজ্য ইলেকট্রনিকস, জুতা, খেলনা, সফটওয়্যার ইত্যাদি সবকিছুরই বেলায়। এগুলো ‘অ্যাসেম্বলি লাইন জব’। এভাবেই গড়ে উঠেছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন অর্থনীতি। শত/হাজার শ্রমিক লাগে না, ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে হয় না; তিন-চার রুমের একটি অফিসে কয়েকটি কম্পিউটার আর হাতে গোনা কয়েকজন কর্মচারী থাকলেই হয়।

আরও দুটি প্রশ্ন উঠছে। এক. অনভ্যস্ত মার্কিনরা উদয়াস্ত রক্ত-ঘাম ঝরানো, স্বাস্থ্য ও জীবনমান হানিকর ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কাজ করতে চাইবে কি? কায়িক শ্রমের কাজগুলো মূলত বৈধ–অবৈধ অভিবাসীরাই করতেন। বর্তমানে অভিবাসীরাই তো বিপন্ন। শ্রমঘন কাজ তাহলে কারা করবেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ শ্রমিকদের অতি উন্নতমানের দক্ষতা, মনোযোগ, প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনশীলতা কীভাবে মার্কিন শ্রমজীবীদের মধ্যে প্রতিস্থাপন সম্ভব? উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমসমাজ অতুলনীয় দক্ষতা অর্জন করেছে তিন-চার দশকের একাগ্র চেষ্টায়। মার্কিন শ্রমদাতাদের দক্ষতা একই মানে পৌঁছানো কি রাতারাতি সম্ভব?

ট্রাম্পের পরামর্শকেরা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কৃৎকৌশলে এতটাই আগুয়ান, এসব আপাতসীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে দেশটির মোটেই সময় লাগবে না। বিশ্বের তথ্যভান্ডার যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। ‘অ্যাসেম্বলি লাইন ইকোনমি’ নিয়ে হাজার হাজার গবেষণা হয়েছে। অসংখ্য প্রশিক্ষণের ম্যানুয়াল রয়েছে। এগুলোর সবই ইলন মাস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতের মুঠোয়। তথ্যগুলো ফিড করে প্রশিক্ষক রোবট তৈরি করা হবে, যেগুলো নতুন শ্রমশক্তিকে মানুষের চেয়েও বহুগুণ বেশি দ্রুততায় প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারবে।

৪.

আগের মেয়াদে ট্রাম্প ‘ব্যালান্সিং দ্য বুকস’ জার্গনটি ব্যবহার করেছিলেন। বালাম বইয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশের গরমিল তাড়ানোর ধারণা সেটি। তিনি এবার সোজা চলে গেছেন ‘ট্রেড ডেফিসিট রিকভারি’ শব্দবন্ধে। পাঠ্যবইয়ের তুলনা দিয়ে বললে বলতে হয়, তিনি তাঁর প্রথম টার্মে বুককিপিং অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং (হিসাববিদ্যা) বই পড়েছেন। এবার ফিন্যান্স (অর্থবিদ্যা) আর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস (আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) পড়ছেন। গভীরভাবে ভাবলে বলা যায়, তাঁর এই পাঠ্যক্রম ঠিকই আছে। তিনি এরপর পাঠ করবেন ইকোনমিকস (অর্থনীতি, ম্যাক্রো ইকোনমিকস অবশ্য); সবশেষে ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা) বই।

আমাদের অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা মোটাদাগে বিষয়টিকে দেখছেন ‘বাণিজ্যঘাটতি’ সমন্বয়ের চেষ্টা হিসেবে। ‘যত কিনব, তত কেনাব’—ট্রাম্পের নীতি যেন শুধুই সেটি। রিপাবলিকানরা বলছে তারা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিন্ড’ তৈরি করছে। ‘উইন-উইন’ বা ‘ফিফটি-ফিফটি’ স্বার্থ মিলতে হবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ৭৪ শতাংশ, বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ২৬ শতাংশ। এটা বিশাল বড় বাণিজ্য-বৈষম্য!

যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ ঠকাচ্ছে; ঠকানো বন্ধ হবে যখন আমরা আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করব এবং বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও আট বিলিয়ন না হোক, কাছাকাছি অঙ্কের পণ্য কিনব। খুব সহজ করে বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট রাখতে হলে আমাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। এখন আমরা কীভাবে খুঁজব কী আমদানি করলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ হবে?

কিন্তু আসলেই কি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ উদ্দেশ্য? ট্রাম্পের অর্থপরিকল্পকেরা কি বোঝেন না মার্কিন অর্থনীতিকে ডাইনোসরের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে হাস–মুরগির সমান। ডাইনোসর নিশ্চয়ই হাস–মুরগিকে বলবে না, ‘তুমিও দেশ, আমিও দেশ, সমান সমান। আমি তোমার কাছ থেকে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনি, অথচ তুমি আমার কাছ থেকে কিনছ মাত্র সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের।’

৫.

‘ট্রেড ডেফিসিট’ বা বাণিজ্যঘাটতি আলোচনা চীন, কানাডা, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন করুক, বাংলাদেশিরা না করুক। কমনসেন্স ব্যবহার করুক বাংলাদেশ। বাণিজ্যে কখনোই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ হওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যাশার তুলনায় লাভ বেশি করছি, নাকি কম করছি—সেটাই মুখ্য। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কোনো বাণিজ্যের খেলায় হারেনি, হারবেও না।

বর্তমান অর্থনৈতিক মোচড়টি আসলে ব্র্যান্ড নিউ ক্যাপিটালিজমের (নয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা) পথে যাত্রা। এটাকে যুক্তরাষ্ট্র ধ্রুপদি অর্থনীতির আলোকে দেখাতে চাইলেও বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর একই চোখে দেখা ঠিক হবে না। দেখতে হবে রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোকে। যুক্তরাষ্ট্রের সব দেশকে চাপে রাখার কৌশলটি অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মতো দেখালেও উদ্দেশ্য হয়তো ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব অথবা অপ্রথাগত ব্যবসার বাজার সম্প্রসারণ।

বিশ্বের প্রায় সব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের করায়ত্ত এবং দেশটির নজর মঙ্গলে উপনিবেশ গড়ার দিকে। নব্বইয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর একটি নতুন একমেরু বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। ৩৫ বছরের মাথায় নব্য বিশ্বব্যবস্থা-উত্তর রাজনৈতিক অর্থনীতি নির্মিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয় নিরীক্ষাধর্মী অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে। এমনও হতে পারে, এই নিরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলা হবে পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার পাটাতন।

হেলাল মহিউদ্দীন ভিজিটিং প্রফেসর, মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি, নিউ জার্সি, যুক্তরাষ্ট্র।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক গলফ খ ল ব যবস থ আম র ক ন কর ম আমদ ন এ রকম রকম স বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

নড়াইলে সরকারি গাছ বিক্রির অভিযোগে চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ ইউনিয়নে সড়কের পাশে সরকারি গাছ চুরি করে বিক্রির অভিযোগে মামলা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে শাহবাদ ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মশিউর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় মামলাটি করেন।

মামলায় ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানসহ ১৩ জন আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন প্রশিকা নড়াইল উন্নয়ন এলাকা ব্যবস্থাপক শাহাব উদ্দিন ও প্রশিকার গঠিত সংগঠন প্রভাতী যুব সংঘের সভাপতি নড়াইল সদর উপজেলার তুজরডাঙ্গা এলাকার মুজিবুর রহমান, সদস্য একই এলাকার জরিনা বেগম, রজব আলী, মো. আজিবর, মো. ইলিয়াছ, ইমান আলী, মো. ওমর, মো. হায়দার, আবু সাঈদ, মো. এনামুল ও মো. শরিফুল।

এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকালে নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি গাছ চুরি করে বিক্রির অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মামলার এজহারে বাদী অভিযোগ করেছেন, গত ২৯ এপ্রিল নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ বাজার থেকে হাজির বটতলা পর্যন্ত সরকারি রাস্তার জায়গা থেকে গাছ কাটা ও চুরি করে বিক্রির সংবাদ পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। উপস্থিত হয়ে দেখেন, কাটা গাছবোঝাই একটি ট্রাক এবং নছিমন জব্দ করেছেন নড়াইল সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার দেবাশীষ অধিকারী। তখন ঘটনাস্থলে শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ ও খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মামলার আসামিরা কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই খাসজমি থেকে গাছ কেটে বিক্রি করেছেন। এর আগেও একবার তাঁরা ওই জমি থেকে গাছ বিক্রি করেছিলেন। জব্দ করা গাছের লগ, ডালপালা এবং আগে কাটা গাছের অবশিষ্ট ভূমিসংলগ্ন গুঁড়ি পর্যবেক্ষণ করে বোঝা গেছে, ওই স্থান থেকে আনুমানিক পাঁচ লাখ টাকার অধিক গাছ চুরি করে কাটা ও বিক্রি হয়েছে।  

প্রশিকা নড়াইল উন্নয়ন এলাকার ব্যবস্থাপক শাহাব উদ্দিন বলেন, ২০০৯ সালে প্রশিকা, ইউনিয়ন পরিষদ ও প্রভাতী যুব সংঘের যৌথ উদ্যোগে একটি চুক্তির মাধ্যমে সড়কের পাশে গাছগুলো রোপণ করেছিল। সে সময় সড়কটি খাস খতিয়ানভুক্ত ছিল না। বর্তমানে তা সরকারের আওতায় পড়ায় গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে ইউএনওর কাছে আবেদন করা হয়েছিল, তবে প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।  কিছুদিন আগে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম তাঁকে ফোনে জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের কাটা ডালপালা বিক্রি করতে চান চেয়ারম্যান। বিদ্যুৎ বিভাগের কাটা ডালপালাগুলো পড়ে থেকে নষ্ট হবে ভেবে তিনি বিক্রিতে সম্মতি দেন। পরে গাছ কীভাবে বা কারা কেটেছে, তা তিনি জানেন না।

মামলা করার আগে অবৈধভাবে গাছ কাটার অভিযোগের ব্যাপার জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, প্রশিকার সঙ্গে চুক্তির একটি পক্ষ ছিল ইউনিয়ন পরিষদ। সেই হিসেবে গাছ কাটার অনুমতি নিতে ইউএনও বরাবর প্রশিকার আবেদন তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে সুপারিশ করেছিলেন। তবে গাছ কেটেছে প্রশিকা আর তাদের সংগঠন। এখানে চেয়ারম্যান-মেম্বরের কিছু নেই।

নড়াইল সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেবাশীষ অধিকারী বলেন, প্রশিকার চুক্তির সময় সড়কটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ছিল, পরে ২০১৫ সালে এটি খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। খাসজমি থেকে গাছ কাটা বেআইনি। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ