বুয়েনস এইরেসে গত মার্চে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে ব্রাজিলকে ৪–১ গোলে বিধ্বস্ত করে আর্জেন্টিনা। সেদিন মাঠে আলভারেজ–ফার্নান্দেজদের কাছে ভিনিসিয়ুস–রাফিনিয়ারা অপদস্ত তো হয়েছেনই, মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া ব্রাজিল সমর্থকেরাও অপমানিত হন।

ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ম্যাচ চলাকালে আর্জেন্টাইনরা তাঁদের উদ্দেশ করে ঘৃণা ও বর্ণবাদী স্লোগান দিয়েছেন। সমর্থকদের দাবি আমলে নিয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ) আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) বিরুদ্ধে ফিফায় অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস। ব্রাজিলিয়ানদের এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা দল।

টিওয়াইসি স্পোর্টসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেদিন ম্যাচের সময় ব্রাজিলিয়ান সমর্থকেরা স্টেডিয়ামে এক আর্জেন্টাইন সমর্থককে বানরের অনুকরণ করতে এবং নানা ধরনের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে দেখেছেন। এ ধরনের আচরণ ও অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ফুটেজও ব্রাজিলিয়ানদের কাছে আছে। সিবিএফের কর্মকর্তারা সেটির ওপর ভিত্তি করে ফিফার কাছে অভিযোগ করার কথা ভাবছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা একাধিকবার স্টেডিয়ামে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে চড়াও পর্যন্ত হতে হয়েছে। এতে রক্তপাতের মতো ঘটনাও ঘটেছে। দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা (কনমেবল) এ ধরনের ঘটনায় অনেক দিন হলো কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে রেষারেষি ঠেকানো যাচ্ছে না।

ফিফার কাছে সিবিএফ অভিযোগ জানালেই এএফএকে নতুন করে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। গত বছর নিজেদের মাঠে ইকুয়েডর ও উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচের সময় আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা বৈষম্যমূলক স্লোগান দেওয়ায় এএফএকে শাস্তি দেয় ফিফার শৃঙ্খলা কমিটি।

শাস্তিস্বরূপ মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে ধারণক্ষমতার ৭৫ শতাংশ দর্শক নিয়ে আর্জেন্টিনাকে খেলতে হয়। একই সঙ্গে ফিফা এই বলে এএফএকে সতর্কবার্তা দেয় যে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে দর্শক ধারণক্ষমতা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ থেকে সবার আগে ২০২৬ বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে আর্জেন্টিনা। নিজেদের মাঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের পরের ম্যাচ আগামী ৯ জুন কলম্বিয়ার বিপক্ষে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর জ ন ট ন ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।

নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।

মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।

ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।

শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।

চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।

কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।

পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।

ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।

এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ