অতীতকে পুনর্লিখন করতে পারবেন না, ওয়াক্ফ আইনের শুনানিতে ভারতের প্রধান বিচারপতি
Published: 16th, April 2025 GMT
ভারতে ওয়াক্ফ সংশোধিত আইন নিয়ে শুনানিতে ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। একই সঙ্গে তিনি পাবলিক ট্রাস্টকে ওয়াক্ফ বোর্ডের মাধ্যমে অধিগ্রহণের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। গতকাল বুধবার ওই আইনে করা আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ে মামলার পরবর্তী শুনানি আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। অন্যদিকে, বিরোধীদের পক্ষ থেকে কপিল সিব্বাল ও অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান বিচারপতি শুনানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘১০০ বা ২০০ বছর আগের পাবলিক ট্রাস্টকে আপনি ওয়াক্ফ বোর্ডের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করতে পারেন না। অতীতকে এভাবে পুনর্লিখন করতে পারবেন না।’
ওয়াক্ফ সংশোধিত আইনের বিধানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক আবেদনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট আবেদনকারী ও কেন্দ্র উভয়ের কাছেই একাধিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন প্রধান বিচারপতি।
প্রথম দিনের শুনানিতে সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের ওপর স্থগিতাদেশও জারি করেছেন শীর্ষ আদালত। এর মধ্যে অন্যতম হলো, কেন্দ্রীয় ওয়াক্ফ সংসদ ও ওয়াক্ফ পর্ষদগুলোতে অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তি। এ বিষয়ে শীর্ষ আদালত সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করেছেন, হিন্দুদের কোনো ধর্মীয় পরিষদ বা ট্রাস্টে কেন্দ্রীয় সরকার কি কোনো মুসলমানকে সদস্য হওয়ার অনুমতি দেবে? এক্ষেত্রে আদালতের বার্তা খুবই স্পষ্ট। যদি কোনো মুসলিম হিন্দু ধর্মীয় ট্রাস্টের সদস্য হতে পারেন, তাহলে ওয়াক্ফ বোর্ডেও অমুসলিম সদস্য হতে পারবেন। কোনো মুসলিমকে হিন্দু ট্রাস্টের সদস্য হওয়ার অনুমতি না থাকলে কোনো অমুসলিমও ওয়াক্ফ বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন না।
এছাড়াও শুনানিতে ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে গলদ রয়েছে কিনা, সংশোধিত আইনে জেলা প্রশাসকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এবং আদালত কর্তৃক ওয়াক্ফ সম্পত্তিকে বাতিল ঘোষণা করার বিধানের ওপরেও স্থগিতাদেশ জারি করেন সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি খান্না উল্লেখ করেন, আইন সংশোধনী নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা হয়েছে তা খুবই গর্হিত কাজ। এদিকে সংশোধিত ওয়াক্ফ আইন নিয়ে পাকিস্তানের মন্তব্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার পাকিস্তানের নেই। ইসলামাবাদের উচিত সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় নিজের নিকৃষ্টতর রেকর্ড খতিয়ে দেখা। সম্প্রতি পাকিস্তানে পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র অভিযোগ তোলেন, ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের মাধ্যমে মুসলিমদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ভারত।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, ওয়াক্ফ সংশোধনী আইন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়া অশান্তি পূর্বপরিকল্পিত। গতকাল কলকাতার নেতাজি ইনডোরে ইমাম-মুয়াজ্জেম-বুদ্ধিজীবীদের সভায় তিনি এ কথা বলেন।
পশ্চিমবঙ্গে অশান্তির জন্য সরাসরি বিজেপি তথা কেন্দ্রের সরকারকে দায়ী করে মমতা বলেন, মুর্শিদাবাদে সম্প্রতি যে ধর্মীয় অসন্তোষ ও অশান্তির ঘটনা ঘটেছে তা পরিকল্পিত ঘটনা। এ সময় তিনি বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে নরেন্দ্র মোদি ও ড.
গত ৩ এপ্রিল মধ্যরাতে ভারতের সংসদ বিতর্কিত ওয়াক্ফ আইনের সংশোধনী বিলটি পাস করে। এর মাধ্যমে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের দান করা কোটি কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি পরিচালনার পদ্ধতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয়।
মুসলিম নেতা ও বিরোধী দলগুলো এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক এবং ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার লঙ্ঘনের চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে। ভারত সরকারের দাবি, বিলটির লক্ষ্য ওয়াক্ফ (মুসলিম সম্পত্তি) ব্যবস্থাপনা আরও স্বচ্ছ করা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় সরক র কর ছ ন প রব ন আইন র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।
অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।
সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আরো পড়ুন:
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।
রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।
‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।
একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’
তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।
‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।
‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’
একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।
‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’
জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’
তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’
বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তারা//