ভাইরাল ভিডিও: শিশু শোষণের নতুন মাধ্যম নিয়ে ভাবতে হবে
Published: 19th, April 2025 GMT
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর দৌরাত্ম্যে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, অভিভাবকেরা নানাভাবে শিশুদের ব্যবহার করছেন কনটেন্ট তৈরির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে। কখনো শিশুর কান্না, কখনো তার হাসি, কখনো অপ্রত্যাশিত কোনো মন্তব্য—এগুলো ভাইরাল কনটেন্টে রূপ নিচ্ছে। ভাইরাল ভিডিও যেন পরিণত হয়েছে মা-বাবার সফলতার মাপকাঠি হিসেবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রবণতার পেছনে অভিভাবকদের মনস্তাত্ত্বিক তাগিদ কী? সমাজ ও আইন এ বিষয়কে কীভাবে দেখছে?
অনেক অভিভাবক নিজেরা হয়তো ক্যামেরার সামনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, কিন্তু শিশুরা সহজেই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি হয় বলে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের সামনে আনেন। এই জনপ্রিয়তা কিংবা স্বীকৃতি অর্জনের বাসনা থেকেই অনেকেই না ভেবে শিশুদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেন।
শিশুর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এই জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশু-কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারে গাইডলাইন প্রণয়ন করা প্রয়োজনএ অবস্থাকে প্যারেন্টাল নার্সিসিজম বলে চিহ্নিত করছেন অনেক মনোবিজ্ঞানী। এ ধরনের অভিভাবকেরা সন্তানের জীবনের একেকটি দিক ব্যবহার করছেন নিজের সামাজিক পরিচিতি গড়তে। এখানে সন্তান নয়, বরং সন্তানের জনপ্রিয়তাই হয়ে উঠছে অভিভাবকের আত্মতৃপ্তির উৎস। আবার অন্য যেসব শিশুর ভিডিও দেখেন অভিভাবকেরা, তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়। আরেকজনের সন্তান তারকা, আমার সন্তান তারকা নয়, এমন ভাবনা মনে আসে অনেক মা-বাবার।
শিশুর ব্যক্তিগত মুহূর্ত যেমন ঘুমানোর সময়, কান্নার সময়, গোসলের মুহূর্ত—এসব অনেক সময়ই ভিডিও আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। এটি শিশুর গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শামিল। শিশু বড় হয়ে যখন এসব ভিডিও দেখবে, তখন তার মধ্যে লজ্জা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বা সামাজিক বঞ্চনার অনুভব তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করা অভিভাবকের প্রধান দায়িত্ব। শিশু আইন ২০১৩ এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, কোনো শিশুর মানসম্মান, মর্যাদা বা গোপনীয়তা বিঘ্নিত হয়, এমন কিছু করা আইনসিদ্ধ নয়। বাংলাদেশে এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে নির্দিষ্ট আইন খুব শক্তিশালী নয়, কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা এ ধরনের কনটেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, যদি এতে শিশু শোষণের উপাদান থাকে।
বাস্তবে দেখা যায়, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির এ বিষয়ে আইন প্রয়োগ তুলনামূলক দুর্বল। কোনো ভিডিওতে শিশুর প্রতি অবমাননাকর আচরণ বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপন থাকলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলেও সাধারণ কনটেন্টের ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। তাই এ ক্ষেত্রে সরকার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
শিশুকেন্দ্রিক কনটেন্ট অনেক সময় ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিশুদের কনটেন্ট অনেক বেশি দর্শকপ্রিয় হওয়ায় একশ্রেণির অভিভাবক এটিকে ‘বাণিজ্যিক পণ্য’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। অথচ এই আয়ের ভাগ শিশুর নামে রাখা হচ্ছে না, কিংবা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে না। শিশুশ্রমের একধরনের আধুনিক রূপ হয়ে উঠছে এই ডিজিটাল এক্সপ্লয়টেশন। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা কিংবা গ্রামেও শিশুদের ভিডিও দিয়ে আয় করাটা এখন অনেক পরিবারে আয় বা পেশার একটি অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই অর্থে শিশুর কোনো অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
শিশুর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এই জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশু-কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারে গাইডলাইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর উচিত বয়সভিত্তিক কনটেন্টে নির্দিষ্ট ফিল্টার এবং মনিটরিং সিস্টেম চালু করা।
প্রেস কাউন্সিল, আইসিটি মন্ত্রণালয় ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা কমিশনের সম্মিলিত উদ্যোগে শিশুর ডিজিটাল সুরক্ষা নিয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে। ডিজিটাল অভিভাবকতার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এখনই গ্রহণ করা উচিত; নাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের হয়তো এর মূল্য দিতে হবে দীর্ঘ সময় ধরে।
● জাহিদ হোসাইন খান গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচির সাবেক কর্মী
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কনট ন ট ত র করছ ন ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।