সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর দৌরাত্ম্যে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, অভিভাবকেরা নানাভাবে শিশুদের ব্যবহার করছেন কনটেন্ট তৈরির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে। কখনো শিশুর কান্না, কখনো তার হাসি, কখনো অপ্রত্যাশিত কোনো মন্তব্য—এগুলো ভাইরাল কনটেন্টে রূপ নিচ্ছে। ভাইরাল ভিডিও যেন পরিণত হয়েছে মা-বাবার সফলতার মাপকাঠি হিসেবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রবণতার পেছনে অভিভাবকদের মনস্তাত্ত্বিক তাগিদ কী? সমাজ ও আইন এ বিষয়কে কীভাবে দেখছে? 

অনেক অভিভাবক নিজেরা হয়তো ক্যামেরার সামনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, কিন্তু শিশুরা সহজেই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি হয় বলে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের সামনে আনেন। এই জনপ্রিয়তা কিংবা স্বীকৃতি অর্জনের বাসনা থেকেই অনেকেই না ভেবে শিশুদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেন। 

শিশুর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এই জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশু-কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারে গাইডলাইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন

এ অবস্থাকে প্যারেন্টাল নার্সিসিজম বলে চিহ্নিত করছেন অনেক মনোবিজ্ঞানী। এ ধরনের অভিভাবকেরা সন্তানের জীবনের একেকটি দিক ব্যবহার করছেন নিজের সামাজিক পরিচিতি গড়তে। এখানে সন্তান নয়, বরং সন্তানের জনপ্রিয়তাই হয়ে উঠছে অভিভাবকের আত্মতৃপ্তির উৎস। আবার অন্য যেসব শিশুর ভিডিও দেখেন অভিভাবকেরা, তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়। আরেকজনের সন্তান তারকা, আমার সন্তান তারকা নয়, এমন ভাবনা মনে আসে অনেক মা-বাবার। 

শিশুর ব্যক্তিগত মুহূর্ত যেমন ঘুমানোর সময়, কান্নার সময়, গোসলের মুহূর্ত—এসব অনেক সময়ই ভিডিও আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। এটি শিশুর গোপনীয়তা লঙ্ঘনের শামিল। শিশু বড় হয়ে যখন এসব ভিডিও দেখবে, তখন তার মধ্যে লজ্জা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বা সামাজিক বঞ্চনার অনুভব তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করা অভিভাবকের প্রধান দায়িত্ব। শিশু আইন ২০১৩ এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, কোনো শিশুর মানসম্মান, মর্যাদা বা গোপনীয়তা বিঘ্নিত হয়, এমন কিছু করা আইনসিদ্ধ নয়। বাংলাদেশে এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে নির্দিষ্ট আইন খুব শক্তিশালী নয়, কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা এ ধরনের কনটেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে, যদি এতে শিশু শোষণের উপাদান থাকে।

বাস্তবে দেখা যায়, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির এ বিষয়ে আইন প্রয়োগ তুলনামূলক দুর্বল। কোনো ভিডিওতে শিশুর প্রতি অবমাননাকর আচরণ বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপন থাকলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলেও সাধারণ কনটেন্টের ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। তাই এ ক্ষেত্রে সরকার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। 

শিশুকেন্দ্রিক কনটেন্ট অনেক সময় ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিশুদের কনটেন্ট অনেক বেশি দর্শকপ্রিয় হওয়ায় একশ্রেণির অভিভাবক এটিকে ‘বাণিজ্যিক পণ্য’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। অথচ এই আয়ের ভাগ শিশুর নামে রাখা হচ্ছে না, কিংবা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে না। শিশুশ্রমের একধরনের আধুনিক রূপ হয়ে উঠছে এই ডিজিটাল এক্সপ্লয়টেশন। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা কিংবা গ্রামেও শিশুদের ভিডিও দিয়ে আয় করাটা এখন অনেক পরিবারে আয় বা পেশার একটি অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই অর্থে শিশুর কোনো অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না।

শিশুর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এই জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশু-কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারে গাইডলাইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর উচিত বয়সভিত্তিক কনটেন্টে নির্দিষ্ট ফিল্টার এবং মনিটরিং সিস্টেম চালু করা। 

প্রেস কাউন্সিল, আইসিটি মন্ত্রণালয় ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা কমিশনের সম্মিলিত উদ্যোগে শিশুর ডিজিটাল সুরক্ষা নিয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে। ডিজিটাল অভিভাবকতার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এখনই গ্রহণ করা উচিত; নাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের হয়তো এর মূল্য দিতে হবে দীর্ঘ সময় ধরে। 

জাহিদ হোসাইন খান গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচির সাবেক কর্মী

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কনট ন ট ত র করছ ন ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ