বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাবে আমাদের বাণিজ্য ব্যবস্থা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কনটেইনারে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা মালয়েশিয়ার বন্দরগুলোর ওপর নির্ভরতা শুধু সময় ও ব্যয় বাড়ায়নি, আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকেও সীমিত করে রেখেছে। এ প্রেক্ষাপটে মাতারবাড়ী ঘিরে যে গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের বাণিজ্য ও শিল্প খাতে এক নতুন যুগের সূচনা করবে বলে আশা করা যায়। 


বিদ্যুৎকেন্দ্রের কল্যাণে মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্পের গভীর চ্যানেল তৈরি হয়েছে অনেক আগেই। কয়লা নিয়ে জাহাজও ভিড়ছে জেটিতে। তবে বন্দরের মূল জেটি নির্মাণের কার্যক্রম ছিল শুধু কাগজ-কলমে। এবার নির্মাণ কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাপানের বিখ্যাত দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্যাকেজ-১ তথা সিভিল ওয়ার্কস ফর পোর্ট কনস্ট্রাকশন কাজের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হচ্ছে। 
প্রথম ধাপে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ হলে একসঙ্গে একটি সাধারণ পণ্যবাহী ও একটি কনটেইনারবাহী মাদার ভেসেল ভিড়তে পারবে। এসব টার্মিনাল পরিচালনায় থাকবে উন্নত প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো। মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য ইতোমধ্যে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ গভীর চ্যানেল এবং ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বর্তমানে কয়লাবাহী জাহাজ ভিড়তে পারছে। এমন সক্ষমতা আগে কোনো বাংলাদেশি বন্দরের ছিল না। 
মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্পের প্রথম ধাপে বন্দরে মূল অবকাঠামো নির্মাণ হবে। এর মধ্যে রয়েছে বন্দরের দুটি জেটি, সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ নানা অবকাঠামো। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা এবং নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী ২০২৯ সালের মধ্যে প্রথম ধাপের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। 


বাংলাদেশ বর্তমানে বছরে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। মাতারবাড়ীর বড় সুবিধা হবে এখানে আট হাজার টিইইউস ধারণক্ষমতার কনটেইনারবাহী জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে আড়াই-তিন হাজারের কনটেইনার ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারে। বড় জাহাজ জেটিতে ভেড়ানো গেলে পণ্য পরিবহনে খরচ কমবে। সবচেয়ে বড় কথা ইউরোপ-আমেরিকায় সরাসরি জাহাজ সার্ভিস চালু করা যাবে। এর ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আরও সুবিধাজনক অবস্থানে যাবে।


মাতারবাড়ী শুধু বাংলাদেশের নয়, এ অঞ্চলের বাণিজ্য ব্যবস্থারও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলোর আমদানি-রপ্তানির জন্য এ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হলে তা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ট্রানজিট হাবে রূপান্তর করবে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক হাবে পরিণত হতে পারে। আমরা আশা করতে পারি, মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে ভারতের সাত রাজ্য, নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের বড় সুযোগ তৈরি হবে। আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে মাতারবাড়ীকে গড়ে তোলা যাবে।


আমাদের এখন ৯৯ শতাংশ কনটেইনার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এই বন্দরের যে কোনো সমস্যা বা দুর্ঘটনা অর্থনীতিতে শঙ্কা জাগায়। মাতারবাড়ী হলে এই শঙ্কা থাকবে না। কারণ তখন মাতারবাড়ী থেকে চট্টগ্রাম, মোংলাসহ সারাদেশে নানা বন্দর ও টার্মিনালে নৌপথে কনটেইনার পণ্য পরিবহনের অবাধ সুযোগ তৈরি হবে।


মাতারবাড়ী বড় বন্দর হওয়ার কারণে ফ্রি ইকোনমিক জোনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। ফলে কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হবে। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসা, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ও সার্ভিস সেক্টরের প্রসার ঘটবে। এতে শুধু জাতীয় অর্থনীতি নয়, স্থানীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও সমৃদ্ধ হবে। যদিও সম্ভাবনা অনেক, তবুও এ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সময়মতো প্রকল্প শেষ করা, পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলা, জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও এই প্রকল্পে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। যেমন– নৌপথ তৈরি হয়ে আছে। এখন মাতারবাড়ীর জন্য টানেল থেকে বন্দর পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ জরুরি। তাহলে সড়কপথে খুব কম সময়ে সারাদেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের সঙ্গেও সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রাখা উচিত। তাহলে সড়ক, রেল ও নৌপথের মতো বহুমাত্রিক যোগাযোগ তৈরি হবে। 


মাতারবাড়ী ঘিরে বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতে এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে। এ বন্দর শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক। বিশ্ববাণিজ্যের মূল স্রোতে যুক্ত হতে হলে এমন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর অপরিহার্য ছিল। আজ তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।


সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর না হওয়ার আক্ষেপ অনেকদিন ধরে ছিল। মাতারবাড়ী সেই শূন্যতা পূরণ করে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। আমাদের এখন প্রয়োজন পরিকল্পিত ও সময়মতো বাস্তবায়ন, যাতে এই বিশাল বিনিয়োগের সুফল পুরো জাতি ভোগ করতে পারে।

খায়রুল আলম সুজন: সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা); পরিচালক, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং সদস্য, জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম ত রব ড় প রকল প র ম ত রব ড় অবক ঠ ম র জন য আম দ র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

‘আমার তো একেবারেই গন্ডারের চামড়া’

ভারতীয় বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শ্রীনন্দা শঙ্কর। সৃজিত মুখার্জির ‘এক যে ছিল রাজা’, সুমন ঘোষের ‘বসুপরিবার’-এর মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন এই তারকা। বলা যায়, টলিউডের প্রথম সারির সব নির্মাতার সঙ্গেই কাজ করেছেন এই নৃত্যশিল্পী। 

গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা ছেড়ে মুম্বাইয়ে বসবাস করছেন শ্রীনন্দা। সেখানে সংসার, কাজ নিয়ে সময় কাটছে তার। তবে অভিনয়ে নেই। অভিনয় থেকে দূরে থাকার কারণ কী? ফের কী অভিনয়ে ফিরবেন না শ্রীনন্দা?  

ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে আলাপকালে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শ্রীনন্দা। এ অভিনেত্রী বলেন, “টলিউডে যাদের সঙ্গেই কাজ করেছি, তাদের সঙ্গে এখনো আমার খুব ভালো সম্পর্ক। ভীষণ ভালো অভিজ্ঞতাও বলা চলে। মুশকিল হলো, বাংলা সিনেমায় তেমন বাজেট থাকে না। সত্যিই যদি খুব ভালো সিনেমা হয় বা এমন কোনো পরিচালক আমাকে অফার দেন যেখানে কোনো ভাবেই ‘না’ করব না। আমি নিশ্চয়ই আবার অভিনয়ে ফিরব।”

আরো পড়ুন:

কলকাতায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি অভিনেত্রী

পরিচালকের আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে মুখ খুললেন শোলাঙ্কি

কিছু কিছু লোকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েও মাঝপথে থেমে গিয়েছেন শ্রীনন্দা। কারণ, তাদের সঙ্গে মানসিকভাবে মেলেনি। তার ভাষায়—“মুম্বাই, কলকাতা বা সাউথ ইন্ডাস্ট্রি যেখানেই হোক না কেন, আমি ভালো মানুষের সঙ্গে কাজ করতে চাই। কেউ এমন চরিত্রে সুযোগ দেন, যেখানে প্রয়োজনে টাকাটা ভুলে গিয়ে শুধু পরিচালকের নাম দেখেই কাজটা করব।”

কিছুটা ইঙ্গিপূর্ণভাবে শ্রীনন্দা বলেন, “কাজের পাশাপাশি আমার সংসারও রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই পেতে হবে, যার জন্য সংসারটা ইগনোর করার কথা ভাবব। অর্থাৎ মনে হবে সংসার ফেলে এই সিনেমাটা আমাকে করতেই হবে। এই বয়েসে একটু কফি খেতে যাবেন? কাজ দেবেন? এগুলো করতে পারব না। সবাই তো চেনেই আমাকে। কাজ দিতে হলে দেবেন।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব শ্রীনন্দা। অনেকে ভেবেছিলেন, এ মাধ্যমে কাজ করে টাকা আয় করে থাকেন। তাদের উদ্দেশে শ্রীনন্দা বলেন, “অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা এটাও আমার পেশা। এখান থেকে অনেক টাকা উপার্জন করা যায়। আমি নিজেও আগে বিষয়টা জানতাম না। পোস্ট করতে করতে বুঝেছি। আমি এখন মুম্বাইয়ে মায়ের সঙ্গে পুরোদমে নাচের স্কুল চালাচ্ছি। এখন মোট ছয়টা ব্রাঞ্চ এবং ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। সব মিলিয়ে ভালো আছি।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের শিকার হন শ্রীনন্দা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার তো একেবারেই গন্ডারের চামড়া হয়ে গিয়েছে। কয়েকদিন আগে আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘রিল মামনি’। আমি আর মা এটা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছি। মাঝেমধ্যে এসব বেশ মজাও লাগে। তবে যে পরিমাণ ভালোবাসা পাচ্ছি, সেটা খুব মন থেকেই ভক্তরা দিচ্ছেন বলে আমার বিশ্বাস। আমি মনে করি, এটা আমার জীবনে আশীর্বাদ।”

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ