উজানের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আন্তঃসংযুক্ত নদী ব্যবস্থার মাধ্যমে ২৪ গুণ বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য গ্রহণ করে বাংলাদেশ। অনুমান করা হয়, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা নদীর মাধ্যমে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। ফলে বাংলাদেশের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর মাছের পেটে মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।

মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত নদীর মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা। একইসঙ্গে এসব নদীর পানি, পলি এবং বাতাসেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি পাওয়া গেছে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটানের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রথমবারের মতো তিন দেশের যৌথ গবেষণায় এসব নদীর পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার হিসাব করা হয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড.

হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটানের বিজ্ঞানীদের যৌথ অংশগ্রহণে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ফর গ্লোবাল চেঞ্জ রিসার্চ এ গবেষণার অর্থায়ন করেছে।

গবেষকরা বলছেন, পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিকের কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অব্যবস্থাপিত প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত দ্বিতীয় এবং চীন পঞ্চম। এ দেশগুলো কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা না থাকায় তাদের নদীগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। পানি ও পলির সঙ্গে মিলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা মিশছে বঙ্গোপসাগরে।

গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ বলেন, “বাংলাদেশ অংশে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর প্রতি বর্গ কিলোমিটার পানিতে ২৫ লাখের অধিক ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নদীত তলদেশের প্রতি কেজি পলিতে ৪৫০ পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। এসব নদ-নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে সংগৃহীত মাছের পেটেও বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখা গেছে গবেষণায়।”

গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার বিষয়ে অধ্যাপক বলেন, প্লাস্টিক দূষণের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এখানে প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং ইরাবতী নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। বিগত ২ বছর ধরে এ গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে ভুটানের তিনটি পাহাড়ি নদী (হারাছু, মানস ও তোরসা), যেগুলো ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রের পাঁচটি মোহনা (টুটিং, দিব্রুগড়, তেজপুর, গোয়াহাটি ও ধুবরি) এবং বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পাঁচটি মোহনা (কুড়িগ্রাম, সুন্দরগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ ও হুমুরিয়া) থেকে গবেষণা প্রকল্পের নমুনা (পানি, নদীর তলদেশের পলি ও মাছ) সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে বায়ুতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরীক্ষা করা হয়।”

তিনি আরো বলেন, “গবেষণায় দেখা যায়, ভুটানের নদীগুলোর পানি ও পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ খুবই কম। কিন্তু উজানে ভারত ও ভাটির বাংলাদেশ অংশে ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীর পানি, পলি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্বেগজনকহারে বেশি। নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক অনেক ধরনের মানবসৃষ্ট উৎস থেকে আসে যেমন প্রসাধনী সামগ্রী কসমেটিকস, ফেস স্ক্রাব, সানস্ক্রিন, শ্যাম্পু, লোশন, সিন্থেটিক কাপড় উৎপাদন কারখানা ও প্রতিদিন ধোয়া, গাড়ির টায়ারের ক্ষয়, ভবন ও রাস্তার রঙের ক্ষয়, সিন্থেটিক আবরণ উপাদান, পলিমার-আবৃত সার ও কীটনাশক, ক্ষয়কারী পরিষ্কারের সামগ্রী, শিল্প ও জাহাজে ব্যবহৃত ব্লাস্টিং মিডিয়া, মিউনিসিপাল স্যুয়েজ স্লাজ ইত্যাদি। যা দৈনন্দিন ব্যবহারের প্লাস্টিকের সঙ্গে মিশে যায়।”

মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, “মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত নদীর মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। রান্নার পরও এটি থেকে যাচ্ছে এবং খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পেটে যাচ্ছে। যা মানুষের অন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি, হরমোনের ক্রিয়াকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।”

অধ্যাপক আরো বলেন, “এটা আমাদের অন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ব্যাহত করে দিতে পারে। এছাড়া পেটে ফোলা ভাব, অস্বস্তি ও হজমের সমস্যার পাশাপাশি ক্লান্তিসহ নানা শারীরিক জটিলতা হয়ে থাকে। বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির কারণে কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার পাশাপাশি শরীরের হরমোনের স্বা ভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে ওজন কমে যাওয়া, স্মৃতি বিভ্রাটসহ হাতের কাঁপুনিও হতে পারে।”

এ ছাড়া গবেষণায় কয়েকটি নদ-নদীতে ন্যানো প্লাস্টিকের দেখা মিলেছে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, “মাছের মাধ্যমে এই ন্যানো প্লাস্টিক মানুষের কোষে প্রবেশ করতে সক্ষম। এর ফলে মানুষের যকৃৎ ও কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কাজের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।”

প্লাস্টিকের পরিবর্তে আমরা যদি পাট বা সুতি ব্যাগ ব্যবহার করতে পারি এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ও প্যাকেজিং এড়াতে পারি তবেই প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব বলে দাবি গবেষক দলের।

ঢাকা/লিখন/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প ল স ট ক বর জ য ব যবস থ উপস থ ত নদ র ম নদ র প ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।

মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা  মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?

তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।

সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি  যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?

সরকারের পক্ষ থেকে  রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।

যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।

দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন,  সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।

এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!

এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।

যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ