পুতিনের যে সাত সত্যি জানেন না ট্রাম্প
Published: 23rd, April 2025 GMT
আপনি ভেবে বসে থাকতে পারেন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যাকুল। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রায় সাত লাখ সেনা হতাহত হয়েছে। প্রতিদিন এক হাজারের বেশি সেনা হারাচ্ছে রাশিয়া। এর বিনিময়ে যৎসামান্য ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে দেশটি। রাশিয়ার অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
ব্যাপারটা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন একটা চুক্তি করতে চাইছেন যেন পুতিনের পক্ষে গ্রহণ করা সহজ হয়। ‘শান্তির’ জন্য হন্যে হয়ে ছুটতে গিয়ে ট্রাম্প ক্রেমলিনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার কাছে নতিস্বীকার করছেন এবং আগাম ছাড় দিয়ে পুতিনকে আলোচনার টেবিলে আনার পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন।
এই যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার নির্লজ্জ মিথ্যা বয়ান ও শর্তগুলোর বেশির ভাগই মেনে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে তার কারণ হলো ইউক্রেন ন্যাটোয় যুক্ত হতে চেয়েছিল। ইউক্রেনের যে ভূখণ্ড রাশিয়া দখলে নিয়েছে, সেটা রাশিয়াকে দিয়ে দেওয়া।
আরও পড়ুনট্রাম্পের যে বিশ্বাসঘাতকতায় পুতিন এখন আরও সাহসী১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫কিন্তু উপহারগুলো পকেটে পুরে যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করার বদলে পুতিন ভিন্ন কিছু ভাবছেন। ১১ এপ্রিল ট্রাম্পের দূত স্টিফেন উইটকফের সঙ্গে পুতিনের তৃতীয় দফার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। কিন্তু আগের দুই দফার চেয়ে এবারের অগ্রগতি সামান্য। এর দুই দিন পর গির্জায় প্রার্থনার জন্য সমবেত হওয়া ব্যক্তিদের ওপর মারাত্মক আক্রমণ চালায় রাশিয়া, যেখানে কয়েক ডজন নিহত হন। ট্রাম্পের ‘শান্তি’ প্রস্তাবে রাশিয়া যে রাজি নয়, এ ঘটনা তারই প্রদর্শন।
সর্বশেষ ব্যর্থ আলোচনার পর উইটকফ যে বার্তা পোস্ট করেন, সেখানে তাঁর হতাশা ফুটে উঠেছে। ‘রাশিয়াকে তো সামনে এগোতে হবে। অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, সপ্তাহে হাজার হাজার, একটা ভয়াবহ ও অর্থহীন যুদ্ধ।’
ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন এখন পর্যন্ত যেটা এড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটা হলো ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় পুতিনের সত্যিকারের কোনো আগ্রহ নেই। ট্রাম্প প্রশাসন এই সরল সত্যকে দেখতে অক্ষম তিনটি অন্ধবিশ্বাসের কারণে। রাশিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা, নিজেদের ব্যক্তিগত মতামত সম্পর্কে সীমাহীন আস্থা, কর্তৃত্ববাদী শাসন চালানোর যে মতাদর্শ ও রাজনৈতিক প্রেরণা, সেটা বোঝার অক্ষমতা। এই তিন জায়গাতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরি সব প্রেসিডেন্টকে পার করে ফেলেছেন।
পুতিনকে নিয়ে দ্বিধার বড় কারণ হচ্ছে তার কাছে শান্তি অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। বিজয়ই তাঁর অগ্রাধিকার। যুদ্ধ নিয়ে যেসব অস্থিরতা,কেবল একটা বিজয়ই তার অবসান ঘটাতে পারে। কেননা একটি বিজয়ই পারে সশস্ত্র দমনের পথে না গিয়ে যুদ্ধ–পরবর্তী সামাজিক অসন্তোষগুলো প্রশমন করতে। এ কারণেই পুতিন কেবল তখনই আলোচনার টেবিলে যাবেন, যখন তিনি দেখবেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া ভালো অবস্থানে রয়েছে। সুতরাং, প্রলোভন কিংবা আলংকারিক শব্দে ভরা হুমকি পুতিনের আশার পারদকে নামাবে না।পুতিন কেন শান্তিচুক্তি এখনই চান, তার সাত কারণ এখানে দেওয়া হলো।
এক.
পুতিনের একনায়কতন্ত্রের জন্য এই যুদ্ধ যৌক্তিকতা দিচ্ছে
একনায়কতন্ত্রের জন্য যুদ্ধের চেয়ে ভালো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আর নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল যুদ্ধ ঠেকানোর একজন স্থপতি হলেন জর্জ কেনান। একবার তিনি বলেছিলেন, সোভিয়েত নেতারা বাইরের বিশ্বের সঙ্গে বৈরী আচরণ করেন তার কারণ হলো, তাঁদের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে এটা একটা অজুহাত। আর স্বৈরশাসন ছাড়া তাঁরা জানেন না কীভাবে শাসন করতে হয়।’
আরও পড়ুনপুতিন এবার ট্রাম্পকে লেনিন পদক দেবেন!১০ মার্চ ২০২৫প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের তৃতীয় দফা মেয়াদে (২০১২-২০১৮) রাশিয়ার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যখন শ্লথ হয়ে পড়েছিল, তখন তিনি তাঁর শাসনের ভিত্তি সামরিক-দেশপ্রেমে রূপান্তরিত করেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় আগ্রাসনের সময় প্রথম এই বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে। এরপর ২০২২ সালে ইউক্রেন আগ্রাসন চালায় রাশিয়া।
পুতিনের জন্য এখনো যেটা দরকার, সেটা হলো শত্রুরা রাশিয়া ঘিরে ফেলছে—এ ধারণাকে ফেরি করা। তা না হলে তার সামরিক-দেশপ্রেমের কোনো ভিত্তি থাকে না। তার শাসন যে ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের ওপর টিকে আছে, তারও কোনো ভিত্তি থাকে না।
দুই. পুতিন সামরিকবাদের ফাঁদ পছন্দ করেন
পুতিন ব্যক্তিগতভাবে স্তালিনের মতো সুপ্রিম কমান্ডার ইন চিফ উপাধি ধারণ করতে আনন্দিত বোধ করেন। সেনাদের সঙ্গে কুচকাওয়াজ করতে ও তাদেরকে মেডেল পরিয়ে দিতে আনন্দিত হন। যুদ্ধ শেষ হলে মাতৃভূমির রক্ষক হিসেবে এই প্রতীকী বেশভূষা থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন।
তিন. রাশিয়ার অর্থনীতি যুদ্ধের ওপর নির্ভরশীল
২০২২ সালে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে রাশিয়ার অর্থনীতি যুদ্ধের সমর্থনে পুনর্গঠিত হয়েছে। শান্তিকালীন অর্থনীতিতে রূপান্তর হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ভোক্তারা এরই মধ্যে ভুগছেন। রুটি, মুরগি, আলুসহ প্রধান সব ভোগ্যপণ্যের দাম বছর বছর বেড়েই চলেছে। এ বছর রাশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে ২১ শতাংশ করেছে। দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে তার আশা সামান্যই।
চার. যুদ্ধকালীন বোনাস ও অন্যান্য সুবিধা বন্ধ হলে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে
সমাজ যখন কোনো বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, হঠাৎ করেই সেটা সরিয়ে নেওয়া যেকোনো সরকারের জন্যই কঠিন। বোনাস, সেনাদের বেতন, নিহত সেনাদের পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে বড় ধরনের সামাজিক অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। কেননা এই আর্থিক সুবিধাগুলো রাশিয়ার গড় জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশি। আবার এই অর্থ কিছু অঞ্চলে দায়িত্ব হঠাতে ভূমিকা রেখেছে।
পাঁচ. যেকোনো পরিবর্তন কর্তৃত্ববাদী শাসনকে অস্থিতিশীল করবে
নীতির ক্ষেত্রে যেকোনো বড় পরিবর্তন, সেটা ভালো কোনো উদ্দেশ্যে হলেও রাজনৈতিক নেতাদের ক্যারিয়ার ঝুঁকির মুখে ফেলে। বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষেত্রে এটা সত্যি।
ছয়. পুতিন একজন সুবিধাবাদী ও ঝুঁকি নিতে পারঙ্গম ব্যক্তি
পুতিনকে যত ছাড় দেওয়া যাবে, ততই তিনি নির্লজ্জের মতো নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসবেন। ট্রাম্প প্রশাসন যত বেশি প্রণোদনা দিতে চাইবে,পুতিন আরও বেশি চাইতে থাকবেন। এটাই পুতিনের চুক্তির শিল্প।
সাত. পুতিনের বিজয় দরকার, শান্তি নয়
পুতিনকে নিয়ে দ্বিধার বড় কারণ হচ্ছে তার কাছে শান্তি অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। বিজয়ই তাঁর অগ্রাধিকার। যুদ্ধ নিয়ে যেসব অস্থিরতা,কেবল একটা বিজয়ই তার অবসান ঘটাতে পারে। কেননা একটি বিজয়ই পারে সশস্ত্র দমনের পথে না গিয়ে যুদ্ধ–পরবর্তী সামাজিক অসন্তোষগুলো প্রশমন করতে। এ কারণেই পুতিন কেবল তখনই আলোচনার টেবিলে যাবেন, যখন তিনি দেখবেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া ভালো অবস্থানে রয়েছে। সুতরাং, প্রলোভন কিংবা আলংকারিক শব্দে ভরা হুমকি পুতিনের আশার পারদকে নামাবে না।
লিওন অ্যারন আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
পলিটিকো ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।