জোয়ারে ৮-১০ ফুট পানি ওঠে ছোট ফেনী নদীতে। ভাটার টানে পানি নামার সময় প্রতিনিয়ত ভাঙছে এই নদীতীরের জনপদ। বসতভিটা হারানোর ভয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে ফেনীর সোনাগাজী ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার হাজারো মানুষের। ইতোমধ্যে দুই উপজেলার শত শত মানুষের ফসলি জমি ও বসতভিটা গেছে নদীর পেটে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতির শিকার মানুষের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকার লোকজন।
কয়েকদিন আগেই সোনাগাজীর চরমজলিশপুর ইউনিয়নের মিয়াজীর ঘাট ব্রিজের কাছে অবস্থিত নুরুল হক নুরুর বাড়ির অর্ধেকের বেশি বিলীন হয়েছে ছোট ফেনী নদীতে। চরমজলিশপুরের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ডালিম গতকাল বুধবার সমকালের কাছে এ তথ্য জানান। তাঁর ভাষ্য, বর্ষার আগেই যদি মুছাপুর রেগুলেটর ঠিক করা না হয়, তবে নুরুর বাড়ির পুরোটাই যাবে নদীতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর রেগুলেটরটি গত বছরের ২৬ আগস্ট সকালে উজান থেকে নেমে আসা পানির তীব্র চাপে ভেঙে যায়। ছোট ফেনী নদীতে নির্মিত স্লুইসগেটের রেগুলেটরে থাকা ২৩টি গেট দিয়ে পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্লুইসগেটটি নির্মাণ করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তখন এলাকাবাসী সতর্ক করেছিলেন, রেগুলেটরটি ভেঙে গেলে জোয়ারের পানিতে ছোট ফেনী নদীর তীরবর্তী মুছাপুর, চরহাজারী, চরপার্বতী ও পাশের ফেনী জেলার সোনাগাজীর নিচু এলাকা তলিয়ে যাবে।
স্থানীয় লোকজনের সেই আশঙ্কা সত্য হয়েছে। চরমজলিশপুরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন সেলিম বলেন, চরবদরপুর গ্রামের আবদুল গফুরের বাড়ির প্রায় ২০ শতক জমি ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তিনিও আগামী বর্ষার আগেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন।
অব্যাহত এই ভাঙনে ইতোমধ্যে ছোট হয়ে আসছে তিন দিক থেকে নদীবেষ্টিত সোনাগাজী উপজেলা। ছোট ফেনী নদীর তীরবর্তী এলাকার মধ্যে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর, চরহাজারী, চরপার্বতী ও সোনাগাজীর বেশ কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, নানা ধরনের স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। সোনাগাজীর চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চরবদরপুর, কুঠিরহাট, কাটাখিলা, কালীমন্দির, চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদরবেশ, আদর্শ গ্রাম, পশ্চিম চরদরবেশ, কাজীরহাট স্লুইসগেট, আউরারখীল জেলেপাড়াসহ আলামপুর, তেল্লারঘাট, ইতালি মার্কেট, ধনীপাড়া, চরচান্দিয়ার সাহেবের ঘাট, মোল্লার চর, পশ্চিম চরচান্দিয়া, বগদানানার আলমপুর, আউরারখিল; আমিরাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব সোনাপুর, বাদামতলী, গুচ্ছগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীর পেটে গেছে। যদিও কত মানুষের জমি নদীতে গেছে সে হিসাব পাওয়া যায়নি।
চরমজলিশপুর মিয়াজী ঘাটের পাশেই বাড়ি মো.
নদীতীরের লোকজনের ভাষ্য, জোয়ারের সময় ৮-১০ ফুট উঁচু পানি ছোট ফেনী নদী দিয়ে উজানে বয়ে যায়। ভাটার সময় পানি নামার তোড়ে ভাঙন দেখা দেয়। মুছাপুরের লোকজনের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় প্রভাবশালীরা নদী থেকে বালু তুলে আসছিল। এ কারণে আশপাশে গর্ত সৃষ্টি হয়। ২৬ আগস্ট সকালে টানা বর্ষণের কারণে নেমে আসা ঢলে রেগুলেটরটি ভেঙে যায়।
ফেনী জেলা শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য জোটের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের বাড়ি চরমজলিশপুরে। তিনি বলেন, মুছাপুর রেগুলেটর ভাঙার পর নদীতীর এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। যারা এখানে বসবাস করেন, তারা ভাঙন আতঙ্কে রাতে ঘুমের মধ্যেও জেগে ওঠেন। তাদের মনে ভয়, কখন নদীতে পড়ে প্রাণ হারান!
জানা গেছে, ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। এসব পরিবারের মধ্যে এমন পরিবারও রয়েছে, যাদের ঘরবাড়ি ভাঙলে আর তৈরির সামর্থ্য নেই। ভাটার প্রবল স্রোতে কত মানুষের বসতঘর গেছে, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। অনেকেই ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন।
ফেনী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সৈয়দ রবিউল হক শিমুলও চরমজলিশপুরের বাসিন্দা। তিনিও নদীভাঙনের জন্য মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যাওয়াকে দায়ী করেন। রবিউল হকের ভাষ্য, ‘জোয়ারে (তীর) ভাঙছে, মনে হচ্ছে বুকের একেকটা পাঁজর ভাঙছে। আমরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে রয়েছি।’
সোনাগাজীর ইউএনও কামরুল হাসান বলেন, মুছাপুর রেগুলেটর নদীতে বিলীন হওয়ার পর দুই উপজেলার বাসিন্দারাই ভাঙনের কবলে পড়েছেন। স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। পাউবোসহ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
ফেনী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ছোট ফেনী নদীর ভাঙন রোধে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। নদীভাঙন রোধ, বিভিন্ন রেগুলেটরের ক্ষয়ক্ষতি ও বাঁধ নির্মাণে ফেনী অংশের জন্য ১৩১ কোটি টাকার প্রস্তাবনা আছে। তাঁর আশা, প্রস্তাবটি এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে একনেকে পাস হবে। তখন নদীতে প্রতিরক্ষামূলক কাজ শুরু হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র ল কজন ঘরব ড় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ
সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়।
গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।
টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন।
এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’
সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।