চট্টগ্রামের রাউজানে গত শনিবার মধ্যরাতে খাওয়ার সময় মুখে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদলকর্মী মানিক আবদুল্লাহকে। এ ঘটনায় সোমবার সন্ধ্যায় মামলা করেন মানিকের স্ত্রী চেমন আরা। এর পর ভয়ে সন্তানদের নিয়ে রাউজান ছেড়ে বোয়ালখালী উপজেলায় বাবার বাড়ি চলে যান।
গত ২৪ জানুয়ারি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন রাউজানের নোয়াপাড়ার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। আসামির নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করার পর পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে যান তাঁর স্ত্রী।
শুধু মানিক আবদুল্লাহ কিংবা জাহাঙ্গীরের পরিবার নয়; স্বজন খুন হওয়ার পর মামলা করে ভয়ে এলাকা ছাড়তে হয়েছে এমন চারটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। প্রত্যেকে ভয় আর আতঙ্কের কথা বলেছেন।
গত আট মাসে রাউজানে ১২টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কাউকে গুলি করে, কাউকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। তিনজনের লাশ মিলেছে কয়েক দিন নিখোঁজ থাকার পর। নিখোঁজ হওয়ার কথা জানলেও তাদের উদ্ধারে পুলিশের বাড়তি তৎপরতা ছিল না। এসব হত্য়ার ঘটনায় করা মামলার এজাহার ঘেঁটে দেখা যায়, ৯টি হত্যার ঘটনায় আসামির ঘরে লেখা ‘অজ্ঞাতনামা’। ১২ খুনের মামলার ১০টিতে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।তদন্ত প্রক্রিয়ায়ও পুলিশের উদাসীনতা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্তত ছয়জন বাদী। এসব বিষয় নিয়ে পাঁচ তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা কেউ স্বনামে কথা বলতে রাজি হননি।
যে কয়েকটি মামলায় আসামির নাম রয়েছে, সেগুলোর বাদীরা বলছেন, আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরছে। তাদের ধরার ব্যাপারে পুলিশের তৎপরতা নেই। অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তাদের দাবি, আসামি ধরতে গেলেই আসে রাজনৈতিক চাপ। আসামির বেশির ভাগ বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার অনুসারী। তাদের প্রতিনিধি বসে থাকে থানায়। কাকে আসামি করা যাবে, কাকে করা যাবে না– ঠিক করে দেন তারাই। বিএনপির ওই দুই শীর্ষ নেতা হলেন গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকার। সরেজমিন থানায় গিয়ে এ কথার সত্যতা পেয়েছে সমকাল। গত আট মাসে চারবার ওসি বদল হয়েছে
রাউজানে। তারপরও খুনের তালিকায় দাঁড়ি টানতে পারছে না প্রশাসন। রাউজানে খুনোখুনি নিয়ে গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেক সময় সন্ত্রাসীরা অপকর্ম করে পাহাড়ের দিকে চলে যায়।’ এক সাংবাদিক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে জানান, হত্যায় জড়িতরা এলাকায় প্রকাশ্যে আছে। তখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি এলাকায় থাকে এখনই রেঞ্জ ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়ে গেলাম। তাদের বিষয়ে যেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
এ ব্যাপারে কথা বলতে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতুকে ফোন করা হলেও তা রিসিভ করা হয়নি। তবে রাউজানের পরিস্থিতি নিয়ে এর আগে তিনি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
অজ্ঞাতনামা আসামি
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকার রাউজানে আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাদের বলয়ে আশ্রয় নিতে থাকে নেতাকর্মী, এমনকি সন্ত্রাসীরা। এক পর্যায়ে থানা নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়ে ওঠেন দুই নেতা। যদিও এ দুই নেতা সমকালের কাছে একাধিকবার এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, অভিযুক্ত ও সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার না করতে তারা থানাকে চাপ দেন না। উল্টো থানার পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয়– প্রশ্ন তোলেন তারা।
পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা চাপে আছেন। তাদের এ কথার প্রতিফলন দেখা যায় মামলার এজাহারে। মাত্র তিনটি মামলায় বাদীরা আসামিদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে মামলা করেছেন থানায়। এর একটি মানিক আবদুল্লাহ খুনের মামলা। অন্য দুটি হলো- কমর উদ্দিন জিতু হত্যা মামলা ও নূর আলম বকুল হত্যা মামলা। অবশ্য বকুল হত্যাকাণ্ড পারিবারিক বিরোধের জেরে হয়েছে বলে জানা গেছে।
যেভাবে ১২ খুন
আবদুল মান্নান : প্রকাশ্যে মান্নানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় গত ২৮ আগস্ট। পরে রাউজানের চৌধুরী মার্কেট এলাকায় সড়কের পাশের জঙ্গল থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মান্নান রাঙামাটির কাউখালীর বেতবুনিয়া ইউনিয়নের কবির আহাম্মদের ছেলে। তিনি বেতবুনিয়া ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি ছিলেন। মান্নানের পরিবারের অভিযোগ, এ ঘটনার পর রাউজান থানায় গেলে সেই সময়ের ওসি জাহিদ হোসেন মামলা নেননি। পরে তারা কাউখালী থানায় এজাহার দেন, সেখানেও মামলা হয়নি।
সর্বশেষ চট্টগ্রাম আদালতে অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে একটি মামলা করার কথা জানিয়েছেন মান্নানের স্ত্রী জান্নাতুল নুর। এ হত্যায় জড়িত কেউ শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়নি এখনও।
মো.
আজম খান : নিখোঁজের চার দিন পর গত ২৯ অক্টোবর দুপুরে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম এলাকা থেকে পুলিশ আজমের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় হত্যা মামলা করেন আজমের স্ত্রী লাকী আকতার। এ মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মাওলানা আবু তাহের : নিখোঁজের তিন দিনের মাথায় চিকদাইর ইউনিয়নের কালাচাঁন চৌধুরী ব্রিজ-সংলগ্ন সর্তাখাল থেকে গত ১১ নভেম্বর তাহেরের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগের সদস্য ছিলেন।
নিরাপত্তার ভয়ে পরিবার মামলা করতে রাজি না হওয়ায় অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বলে জানায় পুলিশ। স্থানীয়দের দাবি, তাঁকে হত্যা করার পর লাশ খালে ফেলে রাখা হয়েছিল।
জাহাঙ্গীর আলম : মোটরসাইকেলে চেপে জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়ার সময় গত ২৪ জানুয়ারি জাহাঙ্গীর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। তিনি রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের আবু সৈয়দ মেম্বারের ছেলে। পরিবারের তরফ থেকে হত্যা মামলা করার পর পুলিশ বিএনপি নেতা গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারী যুবদল নেতা আরফাত মামুন, রমজান আলী, বিপ্লব বড়ুয়া ও গিয়াস উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
মোহাম্মদ হাসান : রাউজানে যুবলীগকর্মী মুহাম্মদ হাসানকে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘর থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এক দল দুর্বৃত্ত। হাসান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের বজল আহমেদের ছেলে। তাঁর পরিবার মামলা করেনি। ঘটনার এক মাস পর রাউজান থানার বর্তমান সেকেন্ড অফিসার কাউসার হামিদ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের রিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
কমর উদ্দিন জিতু : স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে প্রতিপক্ষের পিটুনি ও ছুরিকাঘাতে গত ১৫ মার্চ নিহত হন জিতু। তিনি ওই ইউনিয়নের উত্তরসর্তা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। তাঁর স্ত্রী ডেইজি আকতার রাউজান থানায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেছেন। এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
বাদী ডেইজি আকতার বলেন, ‘আমার স্বামীকে বাজারে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। আমি নাম উল্লেখ করে মামলা করলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না।’ রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন।
মো. রুবেল : রাউজানের পূর্বগুজরা ইউনিয়নের বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশের জমি থেকে গত ২১ মার্চ রুবেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গরুচোর সন্দেহে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে দাবি পুলিশের। রুবেল চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার প্রয়াত নুরুল আলমের ছেলে। তাঁর ভাই সোহেল বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। হত্যায় জড়িত কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি।
নূর আলম বকুল : পারিবারিক দ্বন্দ্বে দুই ভাইয়ের ধারালো অস্ত্র ও রডের আঘাতে গত ৪ এপ্রিল খুন হন প্রকৌশলী মো. নূর আলম বকুল। তিনি রাউজানের হলদিয়া ইউনিয়নের ইয়াসিননগর গ্রামের মো. মুছার ছেলে। এ ঘটনায় বকুলের আরেক ভাই রাজু থানায় হত্যা মামলা করেন। এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।
মো. জাফর : রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের মাহামুনি দীঘি থেকে গত ১৭ এপ্রিল জাফরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জাফর পাহাড়তলী ইউনিয়নের খানপাড়া গ্রামের মো. ইব্রাহিমের ছেলে। তাঁকে হত্যা করে দীঘিতে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। হত্যার আলামত পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন জাফরের ভাই সাইফুল ইসলাম। কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
মানিক আবদুল্লাহ : রাতের খাবার খাওয়ার সময় গত শনিবার মুখের ভেতর অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে মানিককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় রাউজান থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন তাঁর স্ত্রী চেমন আরা।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম : যুবদলকর্মী ইব্রাহিমকে গত মঙ্গলবার দুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি রাউজান সদর ইউনিয়নের শমশেরনগর গাজীপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলমের ছেলে। ইব্রাহিম হত্যার পর সন্ত্রাসীরা দুই কিলোমিটার দূরে আরও একটি কিলিং মিশনে গিয়ে অটোরিকশাচালককে হাতে-পায়ে গুলি চালিয়ে ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে। গুলিবিদ্ধ অটোরিকশাচালক নাঈম উদ্দিনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি।
মামলা নিতে গড়িমসি : গত শনিবার মধ্যরাতে যুবদলকর্মী মানিক আবদুল্লাহ খুনের পর সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাউজান থানায় মামলা করতে যান মানিকের স্ত্রী চেমন আরা। দুই ছেলেমেয়েসহ সঙ্গে ছিলেন দু’জন রাজনৈতিক নেতা, এক প্রতিবেশী। থানাতেই কথা হয় তাদের সঙ্গে। প্রতিবেশী মোহাম্মদ রানা বলেন, ‘বেলা ১১টায় থানায় এসেছি। এখন বিকেল সাড়ে ৫টা বাজে। এখনও মামলা নেয়নি পুলিশ। কেন মামলা নিতে গড়িমসি করছে, জানি না।’ সন্ধ্যা ৭টার দিকে মামলা করে বাড়ি ফেরেন তারা।
চারবার ওসি বদল : রাউজানের পরিস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন চট্টগ্রামের এসপি। এর আগে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ওসিকে আরও কঠোর হতে বলেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক তদবির উপেক্ষা করে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে নির্দেশও দেন। দুই মামলায় আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এ পর্যন্ত।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হত্যাকাণ্ড ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণ, প্রতিটি হত্যা পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে। অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যতটা সহজ, হত্যাকাণ্ড ততটা সহজ নয়। আসামিদের গ্রেপ্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আসার আগে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তার পরও জড়িতদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অপর ধ ম ন ক আবদ ল ল হ গ র প ত র কর ম হ ম মদ পর স থ ত র পর ব র র জন ত ক এ ঘটন য় ল ইসল ম কর ছ ন এল ক য় র র পর ন র পর র পর স য বদল সমক ল তদন ত ব এনপ র আলম
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের একাল-সেকাল
ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘সংস্কারের জিগির’ তোলা হয়েছিল। সে সংস্কারের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে চিহ্নিত।
দল দুটির যেসব নেতা ওই তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হন। এক পর্যায়ে ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটিই রাজনৈতিক গালিতে পরিণত হয়।
সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালের নিন্দিত ‘সংস্কার’ ২০২৪ সালে এসে নন্দিত ‘সংস্কার’ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, লন্ডভন্ড নির্বাচন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আর যাতে কোনো দল সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
ধারণা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানকে গণমুখী করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করতে বিধিবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সীমিত রাখবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করে রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরত পাল্টে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞের সূচনা করেছে। গঠন করেছে ছোট-বড় ১১টি সংস্কার কমিশন: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, নারীবিষয়ক, স্থানীয় সরকার এবং গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আবার এসব বিষয়ে যাতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।
সন্দেহ নেই, জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত প্রয়োজনের নিরিখে সে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রয়োজনে। এবারও দেশকে আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এমনিতেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সে জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন কেন হলো, বোধগম্য নয়।
গঠিত ১১টি কমিশনের বেশ কয়েকটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলোর কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলেও অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিশেষত একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বা একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা না হওয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। কেননা, একটি দল সরকারে গেলে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান কে হবেন বা থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট দলের গঠনতান্ত্রিক বিষয়। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিয়ন্ত্রিত। নতুন করে রাজনৈতিক বিধিবিধান গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে কয়েকটি সংগঠন। ১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি প্রস্তাবনার একটিতে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য মোট আসন ৬০০ করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে করছেন অনেকে। কেননা, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে।
এটা বলা অসমীচীন নয়, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কোটা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে প্রত্যাখ্যাত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সুপারিশ নারী কমিশন কেন করল, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কোটা নারীদের জন্য অবমাননাকর নয় কি? জাতীয় সংসদে নারীদের কোটায় আবদ্ধ রাখার অর্থ তাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা। অথচ আমাদের দেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে আমাদের গ্রামের মাথার বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আজিমের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা জমে। ঢাকা থেকে গেলে আমিও অংশীজন হই। সেদিনও সে আড্ডায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে– তা নিয়ে একেকজন তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। এরই মধ্যে কলেজপড়ুয়া এক কিশোর ফোড়ন কেটে বলল, এর পর হয়তো সরকার ‘জাতিসংঘ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বলবে, নির্বাচন ওই সংস্কারের পর। ছেলেটির কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে। কারও কারও কাপ থেকে ছলকে পড়ে গেল কিছুটা চা।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক