ইসরায়েলিরা এসব ‘সাহসী চিঠি’ লিখে কী বোঝাতে চান
Published: 26th, April 2025 GMT
এটা সত্যি যে [গাজা] যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যেসব চিঠি লেখা হয়েছে, সেগুলো সবই স্বীকৃতিযোগ্য। তবে এটাও ঠিক যে বড্ড দেরি করে চিঠিগুলো লেখা হয়েছে এবং তা-ও খুব ভীত ও দুর্বলভাবে। এসব চিঠি পড়ার পর যে কারও মনে হতে পারে যে মাত্র ৫৯ জন গাজা উপত্যকায় ভুগছেন। আর কারও কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে নেই ৫০ হাজার লাশ। নেই হাজার হাজার এতিম, ভীতসন্ত্রস্ত ও আহত শিশু। নেই বাস্তুচ্যুত ও বিপর্যস্ত ২০ লাখ ফিলিস্তিনি। আছেন শুধু জীবিত ও মৃত ৫৯ জন ইসরায়েলি জিম্মি, যাঁদের রক্ত খুবই পবিত্র এবং যাঁদের মুক্তির বিষয়টা আর সবকিছুকে ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে।
এসব চিঠির ভাষ্য অনুসারে, যুদ্ধের একমাত্র ভুক্তভোগী কেবল জিম্মিরাই। যে কেউ এসব তথাকথিত সাহসী চিঠি পড়লে বিকৃত ও বাছাইকৃত নৈতিক বোধসম্পন্ন এক ইসরায়েলি সমাজের সাক্ষাৎ পাবেন। এসব চিঠির মূল সুরটি ভয়াবহ: যদি জিম্মিরা সব মুক্তি পায় (এবং যদি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়), তাহলে গাজায় যে রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে, তা বাধাহীনভাবে চলতে পারে। হাজার হোক, এটা তো ন্যায়ের যুদ্ধ!
অনেকেই এসব চিঠির প্রশংসা করছেন, প্রশংসা করছেন পত্রলেখকদের সাহস ও গণসম্পৃক্ততার। তবে এটা দেখে মর্মাহত না হয়েও কোনো উপায় নেই যে তাদের একজনও মানবতার ও মানব মর্যাদার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটিয়ে চলার দায়েই সবার আগে এই যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানাননি। জিম্মিদের পরিণতি অবশ্যই প্রত্যেক ইসরায়েলি এবং প্রত্যেক মানুষকেও চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন করা উচিত। কিন্তু যখন শুধু তাঁদের ওপরই আলোকপাত করা হয় বা ২০ লাখের বেশি মানুষের চরম দুর্দশা উপেক্ষিত হয়, তখন এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না যে এটা হলো জাতীয়তাবাদী নৈতিকতা, যেখানে ইসরায়েলি রক্ত ও মুক্তি সবার ওপরে।
কোনো সন্দেহ নেই যে প্রত্যেক জাতিই সর্বপ্রথম ও সর্বাগ্রে তার নিজের বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে। তাই বলে অন্য ভুক্তভোগীদের—আমাদের [ইসরায়েলিদের] কারণে সৃষ্ট ভুক্তভোগীদের দিক থেকে পুরোপুরি মুখ ঘুরিয়ে রাখা ভীষণ মর্মপীড়াদায়ক। সত্যিকারের বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ এ রকম কোনো চিঠিতে স্বাক্ষর করতে পারে না।
কিছু চিঠিতে গাজার ভুক্তভোগীদের প্রতি শুধু মৌখিক সমবেদনা জানানো হয়েছে। পাইলটরা তাঁদের চিঠিতে ‘নিরীহ বেসামরিক নাগরিক’ উল্লেখ করলেও তারা কারা, তা স্পষ্ট করেননি। তারা সম্ভবত গাজার সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী ইসরায়েলি, তাই কি? লেখকেরা অবশ্য আরেকটু সাহস দেখিয়ে ‘গাজার বাসিন্দাদের অসমানুপাতি ক্ষতি’ হয়েছে বলেছেন এবং ‘অসহায় মানুষদের ভয়াবহরকম ক্ষতির’ কথা উল্লেখ করেছেন, যা তাঁদের করাই উচিত। তারপরও এ ক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বানের প্রধান তাগিদটা হলো জিম্মিদের পরিণতির চিন্তা।
ইসরায়েলি সেনা প্যারাট্রুপার ও ইনফ্যানট্রি ব্রিগেডের দুই হাজার রিজার্ভ সেনা, সাঁজোয়া বাহিনীর ১ হাজার ৭০০ সদস্য, ১ হাজার ৫৫ জন পাইলট ও বিমানকর্মী এবং তালপিয়ট প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ২০০ রিজার্ভিস্ট এসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর প্রধান তাঁদের বরখাস্ত করার হুমকি দিয়ে একটি মৃদু প্রতিবাদকে অযথা নাটকীয় ও গাল ভারী করে তুলেছেন।
শিল্পী, স্থপতি ও চিকিৎসকদের কথায় আসা যাক এবার। তাঁরা সবাই যেন দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ভয়াবহতা ও নীরবতা থেকে হঠাৎ করেই জেগে উঠলেন। ‘জিম্মিদের রক্ষায় যুদ্ধ বন্ধ করো’—এই দাবিসংবলিত চিঠি লিখলেন তাঁরা সবাই একে অপরকে অনুকরণ করে। এটা তো সতর্ক ও পরিমাপকৃত প্রতিবাদের একটি রূপ। পত্রলেখকেরা ভালোভাবেই জানতেন যে তাঁরা কী করছেন। এসব চিঠিতে যদি আক্রান্ত ফিলিস্তিনিদের খানিকটা হলেও সামনে আনা হতো, তাহলে অনেক স্বাক্ষরকারীই সরে যেতেন।
হ্যাঁ, চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা ঠিকই বলেছেন যে জিম্মিদের বাঁচাতে অবশ্যই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এটা একমাত্র বা প্রাথমিক কারণ হতে পারে না। ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির সঙ্গে যা করা হচ্ছে, সে জন্যই যুদ্ধ বন্ধ করতে। আর এদের সিংহভাগই নিরীহ ও প্রতিরক্ষাহীন। সত্যকে উপলব্ধির জন্য তাঁদের ভোগান্তি ও যন্ত্রণার কোনো ক্রমমান নির্ধারণ করার বা অন্য কোনো যন্ত্রণার সঙ্গে তুলনা করার কোনো প্রয়োজন নেই।
জিম্মি ও তাঁদের পরিবারগুলো যে অকল্পনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার তাৎক্ষণিক অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের একই সঙ্গে সাংবাদিক ও চিকিৎসাকর্মীদের হত্যার বিরুদ্ধে (যেসব ইসরায়েলি চিকিৎসাজীবী জোরালোভাবে ইতিমধ্যে কথা বলেছেন, তাঁরা অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন), হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে, গোটা একটি সম্প্রদায়কে কোনো গেম বোর্ডের পুতুলের মতো উৎখাতের বিরুদ্ধে এবং লক্ষ্যহীনভাবে সেনাবাহিনী দ্বারা সৃষ্ট সামগ্রিক ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে।
৫৯ জন জিম্মি গাজায় ধুঁকছেন। তাঁদের অবিলম্বে মুক্ত করতে হবে। তবে লোকপ্রিয় ইসরায়েলি জনমতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, তাঁরাই গাজার একমাত্র মানুষ নন, যাঁদের অশেষ যন্ত্রণা থেকে এক্ষুনি উদ্ধার করতে হবে।
গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক ও লেখক
হারেৎজ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ তানিম আসজাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এসব চ ঠ ইসর য় ল সব চ ঠ অবশ য
এছাড়াও পড়ুন:
চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।
শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।
সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।
বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।
ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।
পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।
মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়