ইস্টার সানডের আগের দিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খ্রিষ্টানদের ছুটির দিন উপলক্ষে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। অন্যবারের মতো এবারও তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। ইউক্রেনীয় গণমাধ্যমের খবর জানাচ্ছে, রাশিয়া ডোন হামলা ও গোলাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল। যথারীতি ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছে তারা।

পুরোটা সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অব্যাহতভাবে বলে আসছেন যে শান্তি অর্জিত হবে। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক রুবিও যখন বলছেন যে অগ্রগতি না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতার পথ থেকে সরে আসতে পারে। তারপরও ট্রাম্প আশাবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছেন যে চুক্তি সম্ভব।

ইস্টার সানডেতে ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘আশা করা যায়, রাশিয়া ও ইউক্রেন এ সপ্তাহেই চুক্তিতে পৌঁছাবে।’

এক সপ্তাহ আগে রাশিয়া ইউক্রেনের সামি শহরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালায়। ২ শিশুসহ ৩৪ জন নিহত হন, আহত হন আরও কয়েক ডজন। এমন রক্তাক্ত হামলাও মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি এটাকে ভুল বলে বর্ণনা করেছেন।

দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস পর এটা এখন স্পষ্ট যে ইউক্রেনে ট্রাম্প নাটকীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁকে এখন অনুধাবন করতেই হবে যে সাহসী প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। তিনি ২৪ ঘণ্টায় যুদ্ধ শেষ করতে পারেননি, ১০০ দিনেও সেটা পারবে না।

ট্রাম্পের নেতৃত্বে ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতা করার তাড়নাটা ফিকে হয়ে গেছে এবং এখানে তাদের কৌশলটাও অপরিষ্কার। একজন প্রেসিডেন্ট যিনি নিজেকে ‘চুক্তি প্রণেতা’বলে গর্ব প্রকাশ করতেন, তাঁকে এখন সিদ্ধান্তহীন বলে মনে হচ্ছে।

এটা যদি চলতে থাকে তাহলে ট্রাম্প দুই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। এক.

মধ্যস্ততাকারী হিসেবে, দুই. মিত্র হিসেবে। তাঁর বর্তমান ভূমিকা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করছে না, রাশিয়াকেও আগ্রাসন চালাতে উৎসাহিত করছে।

এখন পর্যন্ত পুতিনের অবস্থানের কোনো বদল হয়নি। তিনি ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল রুশ সেনাবাহিনী আংশিক দখলে নিয়েছে, তার স্বীকৃতি দাবি করেছেন। কিয়েভের জন্য ন্যাটোর সদস্যপদ নয় ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আকার ছোট করা। তিনি ইউক্রেনে সরকার পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালে ইউক্রেনে নির্বাচন দেওয়ার দাবিও তিনি জানিয়েছেন।

পুতিন বুঝতে পারছেন যে তিনি শক্তিশালী অবস্থান থেকে দর-কষাকষি করছেন এবং সে কারণেই কোনো ধরনের সমঝোতা করতে অস্বীকার করছেন তিনি। ট্রাম্পের কাছে এখন এমন কিছু নেই যে এখানে তিনি সুবিধা করতে পারেন। এ কারণেই তাঁর কৌশল হলো ইউক্রেনকে চাপ দিয়ে রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করানো। ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তাসংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করে তিনি পুরো বিষয়টিকে আরও খারাপ করে তুলেছেন।

প্রথমে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ইউক্রেনকে আর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গোয়েন্দা তথ্য দেবেন না। পরে অবশ্য তিনি তাঁর অবস্থান কিছুটা পাল্টান। পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে অনুমোদন দেওয়া সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু নতুন কোনো প্যাকেজ অনুমোদন দেবেন না বলে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন।

ইউক্রেনের জন্য পরাজয় কোনো বিকল্প নয়। এই দেশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে এবং ভবিষ্যতে লড়াই চালিয়ে যাবে, তার কারণ হলো, এর স্বাধীনতা ও মুক্তি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এমনকি ট্রাম্প যদি একটা ‘খারাপ চুক্তি’ মেনে নেওয়ার জন্য ইউক্রেনের ওপর আরও চাপ দেন, তারপরও ইউক্রেনের কোনো নেতা এ ধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। কারণ, এর মানে হলো রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস হওয়া।

এর মানে হচ্ছে, খুব শিগগির ইউক্রেনের গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে আসবে। রাশিয়া এটা ভালো করেই জানে, সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর–কষাকষির সুযোগে দেশটি সময়ক্ষেপণ করছে।

ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যখন তাদের গুরুত্বপূর্ণ রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন পার করছে, তখন রাশিয়া নতুন করে তাদের সেনাবাহিনীতে বিপুলসংখ্যক সেনা নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়া তাদের সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ৬০ হাজার নতুন সেনা নিয়োগ দিচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে তারা যুদ্ধের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে তীব্র করবে। ইউক্রেনের কমান্ডাররা সতর্ক করেছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েকটি ফ্রন্টে বড় ধরনের আক্রমণ করবে রাশিয়া।

পুতিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের স্ব-আরোপিত ‘শান্তি-প্রতিষ্ঠার’ উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নিজের সুবিধায় কাজে লাগানো। পুতিনের কৌশল হলো, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ভান্ডার নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে টেনে নিয়ে যাওয়া, যাতে রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রতিরোধহীন অবস্থায় ইউক্রেনের অনেকটা ভেতরে অগ্রসর হতে পারে এবং কিয়েভকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে পারে।

ইউক্রেনের জন্য পরাজয় কোনো বিকল্প নয়। এই দেশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে এবং ভবিষ্যতে লড়াই চালিয়ে যাবে, তার কারণ হলো, এর স্বাধীনতা ও মুক্তি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এমনকি ট্রাম্প যদি একটা ‘খারাপ চুক্তি’ মেনে নেওয়ার জন্য ইউক্রেনের ওপর আরও চাপ দেন, তারপরও ইউক্রেনের কোনো নেতা এ ধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। কারণ, এর মানে হলো রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস হওয়া।

সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের দেশগুলোর সামনে কিয়েভের পূর্ণাঙ্গ মিত্র না হওয়ার বিকল্প নেই। ইউরোপীয়রা জানে, রাশিয়া ইউক্রেনেই থামবে না। এটা তাদের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি। কেননা, ক্রেমলিন এরই মধ্যে রাশিয়ার জনগণকে এই বলে প্রস্তুত করছে যে ন্যাটোর দেশগুলোর সঙ্গে একটা ‘মহাযুদ্ধ’ দরকার।

এই হুমকির মুখে ইউরোপীয় দেশগুলো পুনরায় সশস্ত্র হতে চাইছে এবং এর জন্য তাদের সময়ের প্রয়োজন। এর মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা থাকুক আর না–ই থাকুক, ইউক্রেনের স্বাধীনতা যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চলবে।

সের্গেই মাইদুকভ একজন ইউক্রেনীয় লেখক। তিনি ‘লাইফ অন দ্য রান: ওয়ান ফ্যামিলি’স সার্চ ফর পিস ইন ওয়্যার-টর্ন ইউক্রেন’ বইয়ের লেখক।

আলজাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ও ইউক র ন র ইউক র ন র স ন ইউক র ন র জন য এর ম ন ধরন র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ