সরকারি প্রচারণার পরও যে কারণে নদীর তীর ও ফসলের জমি দখল করছে তামাক
Published: 27th, April 2025 GMT
কক্সবাজার শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ১০৫ একর জমিতে গোলাপের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে দুই শতাধিক কৃষক পরিবার। ২৪ এপ্রিল দুপুরে বরইতলীতে গিয়ে দেখা গেল, গোলাপবাগানের পাশে অনেকে তামাকের চাষ করছেন। আশপাশের ফসলি জমিতেও চলছে তামাকের চাষ।
কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন চাষি জানান, গোলাপবাগান করে বেশির ভাগ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত। ক্রেতার অভাবে প্রতিবছর বরইতলীতে ৩০ লাখের বেশি গোলাপ ফুল গাছে নষ্ট হচ্ছে। তাই গোলাপবাগানের পাশাপাশি অনেকে তামাকের চাষ করছেন। তামাক চাষে লাভ থাকে বেশি। চাষের জন্য নগদ টাকাসহ বীজ, সার, কীটনাশকের সহায়তাও পাওয়া যায়।
শুধু বরইতলী নয়, চকরিয়া উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, বমুবিলছড়ি, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, ফাঁসিয়াখালী, পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভা এলাকায়ও এভাবে তামাকের চাষ বাড়ছে। এসব এলাকার অন্তত তিন হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ হচ্ছে। উপজেলার মাতামুহুরী নদীর চরেও চলছে তামাকের চাষ। তবে কৃষি কার্যালয়ের দেখানো হিসাবের চেয়ে বাস্তবে তামাকের জমি অনেক বেশি বলে দাবি সংম্লিষ্টদের। চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, পুরো উপজেলায় তামাকের চাষ হচ্ছে ১ হাজার ৬৬২ একর জমিতে। কিন্তু তামাকবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমে জড়িত বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)-এর দাবি করেছে, উপজেলায় তামাকের জমির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
তামাক চাষে চাষিদের নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকারি প্রচার-প্রচারণা কাজে আসছে না বলে মনে করেন চাষি ও পরিবেশবিদেরা। এর বড় কারণ হলো, তামাক চাষে বড় কোম্পানিগুলোর আর্থিক সুবিধা দান ও চাষিদের লাভ।
রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের ফাক্রিকাটা গ্রামের পাশে বাঁকখালী নদীর তীরেও তামাকের চাষ হচ্ছে। দুই বছর আগেও নদীর ফাক্রিকাটা অংশের ৪০ শতক জমিতে শাকসবজি ও ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন স্থানীয় কৃষক সোনা মিয়া। চলতি ফেব্রুয়ারির শুরুতে সেখানে এলাকার কয়েকজন তামাকের চাষ শুরু করেন। সরকারি জমি বলে তিনি প্রতিকারও চাইতে পারছেন না। এখন তিনি বেকার।
রামুর কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, ঈদগড়, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের অন্তত আটটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সেখানেও অন্তত দুই হাজার একরের বেশি জমিতে তামাকের চাষ চলছে। তামাকের চাষ বেশির ভাগ হচ্ছে নদী ও বনাঞ্চলের পাশের সরকারি জমিতে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বন ও কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর দুই তীর এবং আশপাশের ২৭টি ইউনিয়নের অন্তত ৫ হাজার একর জমিতে তামাকের চাষ চলছে। আগে এসব জমিতে শাকসবজি ও তরকারির চাষ হতো। তামাকের আগ্রাসনে পেশা হারিয়ে দিশাহারা এসব এলাকার অন্তত এক লাখ কৃষক।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিচালক মো.
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, তামাক চাষের জন্য বাঁকখালী নদীর চরভূমি কিংবা বনাঞ্চলের পরিত্যক্ত জমি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। সরেজমিন দেখে সরকারি জমি থেকে তামাক চাষ উচ্ছেদ করা হবে।
চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, তামাক চাষ বন্ধে তিনি চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি করেছেন অনেক, কিন্তু তামাক কোম্পানির ফাঁদে পড়ে চাষিরা তামাক চাষ ছাড়তে পারছেন না।
উবিনীগ কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক মো. জয়নাল আবেদীন খান বলেন, তামাক চাষের কারণে একদিকে জমির উর্বরতাশক্তি কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে চাষিদের পরিবারের সদস্যসহ আশপাশের বহু মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তা ছাড়া চুল্লিতে তামাকপাতা পোড়াতে গিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বেশির ভাগ কাঠ সংগ্রহ করা হয় বনাঞ্চল থেকে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব শ চ ষ কর উপজ ল সরক র চকর য়
এছাড়াও পড়ুন:
পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে
অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।
১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’
এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।
পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)