জামিলুর রেজা চৌধুরী: স্বপ্নবান এক প্রকৌশলী
Published: 28th, April 2025 GMT
২০২০ সালের এপ্রিল মাস। দেশে তখন করোনাকাল, ভয়ে-আতঙ্কে মানুষ দিশাহারা। ৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত হলো অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর লেখা, শিরোনাম: ‘অভাবীদের তালিকা করে মোবাইলে টাকা পাঠান’। তখনো করোনার বিপদ, করণীয়, মুক্তির উপায় সম্পর্কে বিশ্ববাসী বেশি কিছু জানে না। শুধু আসছে মৃত্যুর খবর; আক্রান্তের সংখ্যা যাচ্ছে হু হু করে বেড়ে। সেই শুরুর দিনগুলোয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী তাঁর ছোট্ট লেখায় সবগুলো অগ্রগণ্য করণীয় ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, ঘরে থাকুন, সাবান দিয়ে হাত ধৌত করুন, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরুন, চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে যুক্ত করুন, হোম অফিস ও হোম স্কুল চালু করুন, আর অভাবী মানুষের তালিকা করে তাঁদের মোবাইল ফোনে টাকা পাঠান। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার ২২ দিন পর ২৮ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী নিজের ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ঘুমের মধ্যে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্যারের ক্লাস মন দিয়ে করলে শেখা হয়ে যেত। আর যা পড়াতেন, সেখান থেকে প্রশ্ন করতেন পরীক্ষায়। খারাপ করার কোনো সুযোগ ছিল না।পাঁচ বছর পর তাঁর ওই শেষ লেখাটি পড়লাম। এই লেখাটায় যেন বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু ধারণ করা আছে। এত ছোট লেখায় দরকারি সব কথা বলার জন্য দরকার হয় প্রজ্ঞা, জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন এক অনন্য প্রাজ্ঞ মানুষ।
১৫ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে সিলেটে প্রকৌশলী পরিবারে তাঁর জন্ম। ২০ বছর বয়সে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (তখন ইপুয়েট) থেকে পুরকৌশলে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন রেকর্ড মার্কস নিয়ে। বৃত্তি নিয়ে ১৯৬৪ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনে অ্যাডভান্সড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করতে যান। ১৯৬৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পিএইচডির বিষয় ছিল প্রকৌশল কাঠামো নকশায় কম্পিউটারের ব্যবহার। ওই সময় বিলাতে তিনি প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন। দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সেন্টার চালু করেন।
পদ্মা সেতু কিংবা যমুনা সেতুতে যখন চলাচল করি, তখন আমরা জামিলুর রেজা স্যারের কথা স্মরণ করি। বাংলাদেশের আইটি সেক্টর নিয়ে প্রথম যাঁরা স্বপ্ন ও পরিকল্পনা রচনা করেন, তিনি ছিলেন সেখানে অগ্রদূত।আমি জামিলুর রেজা চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র ছিলাম। লেখালেখির প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ায় বুয়েটে আমি ভালো ছাত্রের তালিকায় ছিলাম না। কিন্তু জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের ক্লাসে এবং পরীক্ষায় আমি প্রায় পূর্ণ নম্বর পেয়েছিলাম। এর কারণ, স্যার পড়াতেন কম্পিউটারের মতো করে, প্রথমে বলতেন, গত ক্লাসে আমরা কী শিখেছি। তারপর আজকের ক্লাসে আমরা শিখব। এরপর এতক্ষণ আমরা শিখলাম। স্যারের ক্লাস মন দিয়ে করলে শেখা হয়ে যেত। আর যা পড়াতেন, সেখান থেকে প্রশ্ন করতেন পরীক্ষায়। খারাপ করার কোনো সুযোগ ছিল না।
একবার বুয়েটের স্থাপত্যের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গন্ডগোল হতে লাগল। আমি তখন সাংবাদিকতা করি। স্যারের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। স্যার বললেন, ‘তুমি কি আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি রাশোমন দেখেছ? একই ঘটনা বিভিন্নজন বর্ণনা করছে, কিন্তু একেকজনের বর্ণনা একেক রকম হচ্ছে। আমি যদি ঘটনা সম্পর্কে বলি এক রকম হবে, আর্কিটেকচারের কেউ বললে আরেক রকম হবে।’ এই রকম অনেকবার হয়েছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্য সাহিত্য বা চলচ্চিত্র থেকে উদাহরণ দিয়েছেন।
শুধু নিজে স্বপ্ন দেখেননি তিনি, স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন। আমাদের একই সঙ্গে স্বাপ্নিক এবং কর্মবীর মানুষ দরকার, জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল আলোকিত মানুষ।বাংলাদেশের বড় বড় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের প্রায় সবকিছুর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পদ্মা সেতু কিংবা যমুনা সেতুতে যখন চলাচল করি, তখন আমরা জামিলুর রেজা স্যারের কথা স্মরণ করি। বাংলাদেশের আইটি সেক্টর নিয়ে প্রথম যাঁরা স্বপ্ন ও পরিকল্পনা রচনা করেন, তিনি ছিলেন সেখানে অগ্রদূত। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জাতীয় ইমারত নীতিমালা, ড্যাপ প্রভৃতির পেছনে তিনি ছিলেন প্রধান কারিগর। ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভাইস চ্যান্সেলর। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কিংবা গণিত অলিম্পিয়াডের মতো আন্দোলনে তিনি ছিলেন মশালবরদার।
জামিলুর রেজা চৌধুরী স্বপ্ন দেখেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পাবেন। পাঁচ বছর বাকি আছে, দেখা যাক, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের স্বপ্ন পূরণ হয় কি না। শুধু নিজে স্বপ্ন দেখেননি তিনি, স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন। আমাদের একই সঙ্গে স্বাপ্নিক এবং কর্মবীর মানুষ দরকার, জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন সেই বিরল আলোকিত মানুষ। মেধাবী, পরিশ্রমী, দেশপ্রেমিক, সজ্জন এবং স্বপ্নবান মানুষ ‘জেআরসি স্যার’কে আমরা কোনো দিনও ভুলতে পারব না।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মাইলস্টোন ছাত্রীর মৃত্যু
রাজধানীর আফতাবনগর এলাকায় বাসার ছাদ থেকে পড়ে মাইলস্টোন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তানহা (১৪) মারা গেছে। গতকাল বুধবার বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে উঠেছিল সে।
তানহার বোন তাবাসসুম বলেন, বৃষ্টিতে ভেজার সময় হঠাৎ ছাদ থেকে পড়ে যায় তানহা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তানহা পাবনা সদর উপজেলার আব্দুস সালামের মেয়ে। আফতাবনগর পাসপোর্ট অফিসের পাশে পরিবারের সঙ্গে থাকত সে।
এদিকে একই দিন দুপুরে গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চ পার্কের পুকুরে গোসল করতে নেমে ডুবে মারা যায় ইয়াসিন ওরফে নিরব (১৫)। তার বন্ধু জুবায়ের আহমেদ জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে কয়েকজনের সঙ্গে গোসল করতে নামে নিবর। এ সময় পানিতে ডুবে গেলে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সে সৈয়দপুরের মৃত এনায়েত হোসেনের ছেলে। গুলিস্তানে ফুটপাতে সে ঘড়ি বিক্রি করত।
ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক জানান, দু’জনের লাশ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। দুই ঘটনায় আলাদা থানায় অপমৃত্যুর মামলা হবে।