কাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড়, ভাঙা হচ্ছে বাড়ি: ‘আমার ভাই জড়িত থাকলেও পরিবারের অপরাধ কী’
Published: 28th, April 2025 GMT
কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনার পর রোববার রাতেও নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। এ নিয়ে টানা চার রাত ধরে পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনা ঘটল। এ ছাড়া হামলার পর কাশ্মীরে প্রায় ২ হাজার জনকে আটক করেছে ভারতীয় বাহিনী। হামলায় জড়িত সন্দেহের অনেকের ঘর–বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
রোববার রাতের গোলাগুলির বিষয়ে ভারতের সামরিক বাহিনীর ভাষ্য আগের দিনগুলোর মতোই। তারা জানিয়েছে, কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখায় কোনো উসকানি ছাড়াই গুলি ছোড়েন পাকিস্তানি সেনারা। এরপর ভারত এর পাল্টা জবাব দেয়। এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। আর আগেই মতোই এদিনও গোলাগুলির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি পাকিস্তান সরকার বা দেশটির বাহিনী।
এই গোলাগুলি নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি অবস্থান করা বাসিন্দাদের নতুন করে দুর্দশার মধ্যে ফেলেছে। এমনই একজন ভারতের ডাওকে এলাকার বাসিন্দা হরদেব সিং। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মাঠে কৃষিকাজ করতে যেতে পারছি না।’ অন্যদিকে লানজোত এলাকার বাসিন্দা শওকাত আওয়ান বলেন, ‘আমরা এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বড় হয়েছি। আমাদের মধ্যে আর ভয় কাজ করে না।’
পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আব্বাসি শনিবার বলেছেন, পাকিস্তানের ১৩০টির বেশি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে।কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে দুই দেশ। তবে ২২ এপ্রিল পেহেলগামে হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া গোলাগুলি বড় উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কারণ, ওই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে নয়াদিল্লি। যদিও এ অভিযোগ নাকচ করেছে ইসলামাবাদ।
হামলার পর ভিসা বাতিল, সিন্ধু পানিচুক্তি বাতিল, আকাশসীমা বন্ধসহ একরাশ পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের নাম না নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘কঠিন জবাব’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। আর পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আব্বাসি শনিবার বলেছেন, পাকিস্তানের ১৩০টির বেশি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় স্বজনের মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন একজন নারী.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ