প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লিনিক খুলে ‘এমবিবিএস ডাক্তার’ পরিচয়ে চিকিৎসা, এক বছরের কারাদণ্ড
Published: 29th, April 2025 GMT
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে ক্লিনিক খুলে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে ১০ বছর ধরে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন মো. রেজাউল করিম নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে ওই ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে তাঁকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। উজিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো.
উজিরপুরের সাতলা ইউনিয়নের পশ্চিম সাতলা গ্রামে ‘মায়ের দোয়া ক্লিনিক অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে’ নামের ওই ক্লিনিক এ অভিযান চালানো হয়। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন রেজাউল করিম। মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর চিকিৎসার নামে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি।
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, গত রোববার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বরিশাল জেলার সহকারী পরিচালক সুমি রানী মিত্র ওই ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম পাওয়ায় ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কোনো মেডিকেল ডিগ্রি ছাড়াই রেজাউল ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এমবিবিএস চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা, এমনকি জটিল অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করে আসছিলেন। এলাকাটি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ায় ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদ থাকায় এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করতে পারেননি।
রেজাউল করিম অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা দিই। যেগুলো আমার দ্বারা সম্ভব।’
ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্র জানায়, অভিযানের সময় রেজাউলের কাছে ‘চার্টার অব অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অব ইন্ডো অ্যালোপ্যাথি অ্যান্ড কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন’ নামে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক সনদ পাওয়া যায়। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এ নামে কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ভারতে নেই। অভিযানে ক্লিনিকে কোনো রোগীর তথ্য রেজিস্টারে সংরক্ষণ করার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র বা রোগনির্ণয়ের জন্য রোগীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার প্রমাণপত্র (রসিদ) পাওয়া যায়নি।
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, রেজাউল করিম আসলে কোনো চিকিৎসক নন। তিনি ভারতের যে মেডিকেল কলেজের সনদ দেখিয়েছেন, তদন্তে তাঁরা ওই নামে কোনো মেডিকেল কলেজের অস্তিত্ব পাননি। তাঁর ব্যাপারে তিনি দুবার অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করেছেন এবং ভুয়া চিকিৎসক মর্মে প্রতিবেদনও দিয়েছিলাম। রাজনৈতিক প্রভাবশালী একটি মহলকে ম্যানেজ করে চলায় তাঁর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওযা যায়নি। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কেউ নিজেকে চিকিৎসক লিখতে পারেন না এবং কোনো রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারেন না, এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাইনুল ইসলাম খান বলেন, তিনি যে সনদ দেখিয়েছেন, তা যাচাই করে দেখা গেছে, সেটির কোনো বৈধতা নেই। যেহেতু তাঁর এমবিবিএস ডিগ্রি নেই, তাই তিনি ভুয়া চিকিৎসক। আইনানুযায়ী তাঁকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সালাম বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত রেজাউল করিমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক আসছ ল ন বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।