দেশে সোমবার এক দিনে বজ্রপাতে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই। এক দিনে একক কারণে এত মৃত্যু নিশ্চয়ই উদ্বেগজনক। বজ্রপাতের এই বিপদ অবশ্য অনেক আগে থেকেই আমরা দেখে আসছি। প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বজ্রপাতে এত প্রাণহানির পরও মানুষ এখনও কেন সচেতন হচ্ছে না, সে এক বিস্ময়। বজ্রপাতে হঠাৎ মৃত্যু হয়ে যেতে পারে বটে, তবে এ সময় কিছু পদক্ষেপ ব্যক্তির সুরক্ষায় কাজ করতে পারে। পাশাপাশি মৃত্যুর হার কমাতে সরকারি পদক্ষেপও জরুরি। বজ্রপাতে যখন মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই এই দুই বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকে যায়।
মঙ্গলবার সমকালের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছিল– বজ্রপাতে ঝরে গেল ১৮ প্রাণ। সেখানে দেখানো হয়েছে– বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সরকারি নানা উদ্যোগ আছে। একে দুর্যোগও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সরকার এ লক্ষ্যে কিছু ভুল প্রকল্প নিয়েছে। অন্যদিকে বড় গাছ কাটা বন্ধ না হওয়া এবং প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরির চেষ্টা না থাকায় মৃত্যু রোধ হচ্ছে না। বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টির পেছনে নদী শুকিয়ে যাওয়া, বায়ুদূষণ, জলাভূমি ভরাট হওয়া আর গাছ ধ্বংস হওয়ার প্রভাবও অনস্বীকার্য।
বিভিন্ন তথ্যে এটা স্পষ্ট, সারাবিশ্বে বজ্রপাতে যে সংখ্যায় মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। বজ্রপাতে প্রাণহানির শিকার অধিকাংশই মাঠে থাকা কৃষক। অনেকে বাড়ি ফেরার পথে এবং বাইরে গোসল করা কিংবা মাছ শিকারের সময়ও বজ্রপাতে মারা যান। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৩ হাজার ৮৭০ জনের। এত প্রাণহানি দেখেই হয়তো সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু তার অধিকাংশই সে অর্থে কাজে আসেনি। ২০২৩ সালে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সমকালের একটি প্রতিবেদন ছিল– মৃত্যু ঠেকানোর উদ্যোগ প্রকল্পেই ঘুরপাক। সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ওই বছরই বজ্রপাতে মৃত্যু প্রতিরোধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সারাদেশে ১০ লাখ তালগাছের চারা এবং ৩৫ লাখ তালের আঁটি রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত প্রকল্পটির অধীনে প্রায় শতকোটি টাকা গচ্চা যায়। দায়িত্বশীলরা একটা সময় পর এসে বলেছিলেন, তালগাছ বড় হতে ৩০-৪০ বছর সময় লাগে। সেজন্য প্রকল্পটি তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। এরপরও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওরাঞ্চলের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ডসহ বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণ করে কোনো প্রকার সমীক্ষা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। এমনকি ২০১৭ সালে বজ্রপাতের পূর্বাভাসের জন্য ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আট স্থানে স্থাপন করা হয় লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর- এলডিএস; যার মাধ্যমে ১৫ মিনিট আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কাজ করেনি। এরপর ২০২৩ সালে সরকার ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ একটি প্রযুক্তি চালু করার সময়ই এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। সোমবারের ১৮ জনের মৃত্যু প্রমাণ করছে সরকারের প্রকল্পগুলো ‘সকলি গরল ভেল’।
বাকি রইল মানুষের সচেতনতা। বস্তুত বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় এটাই সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। আকাশে যখন কালো মেঘ জমে মাঠে বা বাড়ির বাইরে থাকা মানুষের তখনই বাড়িতে বা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া উচিত। এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাত বেশি হয়। এ সময়ে কেউ কৃষি কাজের জন্যও বাড়ির বাইরে গেলে জুতা পরে যাওয়া উচিত। জুতা না থাকলে ভূপৃষ্ঠ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সময় তা শরীরে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। সেজন্য এ সময় জুতা ছাড়া যাওয়া যাবে না। বজ্রপাতের সময় উঁচু স্থান ও উঁচু গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। খোলা জায়গায় বা মাঠে থাকলে মাটির সঙ্গে যেন স্পর্শ কম হয়, এমনভাবে দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে রাখতে হবে। এ সময় পানিতে থাকলে দ্রুত উঠে যেতে হবে।
বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল থামাতে এই সচেতনতার কাজটাই আগে করা জরুরি। তাছাড়া প্রকৃতিবিনাশী সব কর্মকাণ্ড থামাতে হবে। আমাদের পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ শেষ বিচারে যে কতভাবে হতে পারে, বজ্রপাতে মৃত্যু তার অন্যতম উদাহরণ।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদ, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র সময় সরক র এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
নগর উন্নয়নে সবুজকে কেন্দ্রে রাখতে হবে
বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ সবুজ অঞ্চল রাখতে হয়। এ জন্য সব সংস্থার সমন্বয়ে স্বল্প–মধ্য–দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। শুধু নগর নয়, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে সারা দেশের জন্য প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান (নেচার–বেজড সলিউশন) দরকার। জীবনযাপনে যেন প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটাও একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নগর উন্নয়নে প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয় বিষয়ক এক তথ্য সংকলন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন নগরবিশেষজ্ঞরা। প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট (আইইউসিএন) বাংলাদেশ এবং গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) যৌথভাবে সংকলনটি প্রণয়ন করেছে, যার অর্থায়ন করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। এতে ২০টি বিস্তৃতভাবে প্রয়োগযোগ্য ‘নেচার–বেজড সলিউশন’ উদ্যোগ উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে শহর পরিকল্পনাকারী, নীতিনির্ধারক ও উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য একটি কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান বা নেচার–বেজ সলিউশন হচ্ছে প্রকৃতির কোনো ধরনের ক্ষতি না করে বা মাটি, বায়ু, পানিসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অটুট রেখে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন। তিনি বলেন, ‘এই সংকলন শুধু একটি নথি নয়, এটি আমাদের সবুজ ও নিরাপদ শহর গঠনের প্রতিশ্রুতিকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে।’
প্রকৃতির কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত মন্তব্য করে ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন বলেন, ‘আমাদের জীবনযাপনে প্রকৃতি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক এস এম মেহেদি আহসান বলেন, নগরকে বাসযোগ্য করতে হলে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৩০ শতাংশ অঞ্চল সবুজ রাখতে হয়। বাংলাদেশের জাতীয় লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত।
বিষয়টি বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়ে এস এম মেহেদি আহসান বলেন, ‘আমাদের একটা বিল্ডিং কোড আছে। সেটা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থার দক্ষতার উন্নয়ন করার সুযোগ আছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যে ১ হাজার ৪০০ প্রকল্প আছে। সেগুলোকে যদি প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তাহলে একটা পরিবর্তন আসবে।’ তবে এটার জন্য সব মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ব্রিটিশ হাইকমিশনের ক্লাইমেট ও এনভায়রনমেন্ট উইংয়ের টিম লিডার নাথানিয়েল স্মিথ বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজন সব সময় তাঁদের অগ্রাধিকারের মধ্যে আছে। বাংলাদেশের প্রকৃতি, জীবন–জীবিকার সুরক্ষা দিতে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
জলবায়ু অভিযোজন খাতে অধিক বিনিয়োগ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার কাজ করছে জানিয়ে নাথানিয়েল স্মিথ বলেন, ‘আমরা সুন্দরবন, হাকালুকি হাওরের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এগুলো রক্ষা করা জরুরি।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশিদ মিয়া বলেন, ‘আমাদের চলমান কিছু প্রকল্পে আমরা প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের চর্চা করি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ক্লাইমেট মিটিগেটেড নলেজ হাব তৈরি করেছি। পাশাপাশি জার্মান সরকারের অর্থায়নে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট লোকাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রকল্প চলছে।’ বাংলাদেশ সরকারের ১৩২টি প্রকল্প ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে ৩২টি প্রকল্পে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য দেন আইইউসিএনের বাংলাদেশের অ্যাক্টিং কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন এবং জিসিএর ইন্টেরিম কান্ট্রি ম্যানেজার এম ফয়সাল রহমান। মূল প্রবন্ধ পড়েন বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক আলিয়া শাহেদ।