নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা মো. ফারুক (৩৫) সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিক ছিলেন। এইচ এম শিপব্রেকিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মরত ছিলেন কাটারম্যান হিসেবে। ২০২২ সালের ১৮ মে ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান ফারুক। দুই মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী বিবি হাজেরা অকূল সাগরে পড়ে যান তখন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখনো পথের দিশা পায়নি।

চার ভাইয়ের মধ্যে ফারুক ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ছোট ভাই মো.

ইয়াসিন প্রথম আলোকে জানান, ভাইয়েরা সবাই পৃথক বসবাস করেন গ্রামের বাড়িতে। দুর্ঘটনার পর পাঁচ লাখ টাকার মতো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তাঁর ভাবি। ওই টাকা সম্বল করে কোনোরকমে দুই মেয়েকে নিয়ে জীবন যাপন করছেন।

জাহাজভাঙা কারখানায় এভাবে প্রতিবছর শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত বছর মোট মারা যান সাতজন। এর মধ্যে এস এন করপোরেশন নামে একটি কারখানায় মারা যান ছয়জন। গত ১০ বছরে জাহাজভাঙা কারখানায় মারা গেছেন ১৩৫ জন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। তবে বর্তমানে ২০টির মতো কারখানা চালু রয়েছে। শ্রমিকনেতারা বলছেন, এত অল্পসংখ্যক কারখানায় প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ জনের মৃত্যু উদ্বেগজনক। এ ছাড়া হতাহতদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা ব্যয় দিতে গড়িমসির অভিযোগও তোলেন শ্রমিকনেতারা।

দেশের অন্যতম বিপজ্জনক শিল্প খাত জাহাজভাঙা শিল্প। এখানে শ্রমিকদের জীবন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে। এত শ্রমিক মৃত্যুর পরও তারা সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে না।তপন দত্ত, জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক

শ্রমিক সংগঠনগুলো জাহাজভাঙা কারখানার কর্মপরিবেশ নিরাপদ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা ইয়ার্ডগুলোকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে গ্রিন করার ওপর জোর দিচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যে ইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন করার সময় বেঁধে দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত সাতটি কারখানা গ্রিন হয়েছে। বাকি আরও ১৭টির মতো গ্রিন করার কাজ চলছে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যেসব দেশ স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করবে, তাদের ইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ও সুরক্ষাসামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গ্রিন ইয়ার্ডের অন্যতম শর্ত। গ্রিন শিপইয়ার্ড বাস্তবায়নে শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান (এসআরএফপি) শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করতে পারে ইয়ার্ডগুলো। গ্রিন ইয়ার্ড করার জন্য কারখানাগুলো বিদেশি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।

চট্টগ্রামে মা ও শিশু হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক রজত শংকর রায় বিশ্বাস কয়েক বছর আগে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, কফ, কাশি, বুকে ব্যথাসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া এই শিল্পে বিপজ্জনক এজভেস্টরসহ স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর নানা ভারী ধাতু বিদ্যমান। যেগুলো শ্রমিকদের জীবনকে বিপন্ন করে।

জাহাজভাঙা কারখানায় শ্রমিকদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা থেমে নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে গড়িমসি শ্রমিকদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।​

জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, দেশের অন্যতম বিপজ্জনক শিল্প খাত জাহাজভাঙা শিল্প। এখানে শ্রমিকদের জীবন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে। এত শ্রমিক মৃত্যুর পরও তারা সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে না। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতেও তারা টালবাহানা করে থাকে।

সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরার বাসিন্দা মো. মিজান হোসেন (৩৩) গত বছরের ১২ মে বাঁশবাড়িয়া এলাকার এপিএস করপোরেশনে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তাঁর ডান হাত ও মেরুদণ্ডের একটি হাড় ভেঙে যায়। এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। হাতের হাড় জোড়া লেগেছে। তবে তাঁর মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। সেটা করা সম্ভব হয়নি।

মিজান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে হাতের অস্ত্রোপচার করেছি; কিন্তু মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার হয়নি। প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা খরচ এবং আরও এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এখন আরও টাকা দরকার চিকিৎসার জন্য। ওই টাকা আমার হাতে নেই। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এখন খুব কষ্ট করে সংসার চলছে।’

জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে শিশুশ্রমিকও নিয়োজিত রয়েছে। সীতাকুণ্ডের কদমরসুলের বাসিন্দা আবুল খায়ের। তাঁর ছেলে সালাহউদ্দিন ১০ বছর আগে এস এন করপোরেশনে দুর্ঘটনায় মারা যায়। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। আবুল খায়ের বলেন, ‘তখন কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। পেটের দায়ে তাকে কাজে দিয়েছিলাম।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বিভিন্ন কারখানায় শ্রমসংক্রান্ত বিষয়গুলোর তদারক করে থাকে। বিলসের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক তথ্যকেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সদস্যসচিব ফজলুল কবির বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পে অনেক শিশু শ্রমিক কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা অনেক দেনদরবারের পর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে কাজ করানো হচ্ছে ১২ ঘণ্টা। এটা আবার শ্রম আইনের পরিপন্থী।

২০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে হাতের অস্ত্রোপচার করেছি; কিন্তু মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার হয়নি। প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা খরচ এবং আরও এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এখন আরও টাকা দরকার চিকিৎসার জন্য। ওই টাকা আমার হাতে নেই। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এখন খুব কষ্ট করে সংসার চলছে।সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরার বাসিন্দা মো. মিজান হোসেন

কারখানার তুলনায় দুর্ঘটনা বেশি

১০ বছর আগে সীতাকুণ্ডে ১৫০টির মতো ইয়ার্ড চালু ছিল। ওই সময় বছরে গড়ে ২০ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করতেন। অবশ্য অনেক হতাহতের ঘটনা বাইরে আসত না। এখনো একই অভিযোগ রয়েছে। জাহাজভাঙা কারখানা এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে দাবি করা হয়।

তবে বর্তমানে মাত্র ২০টির মতো কারখানা চালু রয়েছে। তার মধ্যে সাতটি কারখানা পরিবেশ ও শ্রমবান্ধব গ্রিন ইয়ার্ড। কিন্তু এখনো প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাতজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এটা তুলনামূলকভাবে বেশি বলে অভিযোগ করছেন শ্রমিকনেতারা।

গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে ২২ জন শ্রমিক মারা যান। ২০১৮ সালে মারা যান ২০ জন। ২০২১ সালে ১৪ ও ২০২২ সালে ১০ জন মারা যান। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর জন্য প্রত্যেক শ্রমিক মোট ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকেন।

কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স রিসাইকেল অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জহিরুল ইসলাম ফোন ধরেননি। তবে সংগঠনের সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনা এখন কমে এসেছে। সম্পূর্ণ গ্রিন হয়ে গেলে তা আরও কমে যাবে। হতাহতদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বেশি দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক শিপন চৌধুরী বলেন, ‘গত বছর সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রিন হলে দুর্ঘটনা আরও কমে যাবে। আমরা ক্ষতিপূরণ আদায়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন ১০ বছর র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

নয়াপল্টনে শ্রমিক দলের সমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢল

মহান মে দিবস উপলক্ষে রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শ্রমিক সমাবেশ করছে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে এই সমাবেশ শুরু হয়।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

সমাবেশ ঘিরে বেলা ১২টা থেকে রাজধানী এবং এর আশপাশের জেলা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন।

এদিকে সমাবেশ শুরুর আগে জাসাসের শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। গানে অংশ নেন কণকচাঁপা, মৌসুমীসহ বেশ কয়েকজন শিল্পী।

এই সমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে। নেতাকর্মীর রঙিন টুপি, টি-শার্ট, ব্যানার ও ঢোল নিয়ে উপস্থিত হন। 

এদিকে সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন এবং এর আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ