‘আজ যদি কাজ না করি, আমাগোরে আর কাজে লইবো না’
Published: 1st, May 2025 GMT
বিশালাকার জাহাজের গায়ে হাতুড়ি দিয়ে একের পর এক আঘাত করছেন ৬৫ বছর বয়সী শ্রমিক শাহাজান। উদ্দেশ্য জাহাজের গায়ে জমা মরিচাগুলো তুলে ফেলা। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা ধরে এ কাজ করেন শ্রমিক শাহজাহান। এর বিনিময়ে দিনে মজুরি পান মাত্র ৪৫০ টাকা। যেদিন কাজ করেন না বা করতে পারেন না, সেদিন হাত শূন্য। কেবল কাজের বিনিময়ে মজুরি মেলে।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রাজধানীর সদরঘাটের ডকইয়ার্ডে এ কাজ করে যাওয়া শাহজাহান জানেন না আজ শ্রমিক দিবস। শুধু এটুকু জানেন, আজ তাঁকে বিকেল পাঁচটার বদলে তিনটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। আজ শ্রমিক দিবস জানেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রমিক শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘না, জানি না, আজকে একটানা তিনটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে, এটি জানি।’
শ্রমিক শাহজাহানের বাড়ি পিরোজপুরের সদর উপজেলার কলাখালী ইউনিয়নে। সেখানে পরিবারে স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তাঁর এই আয়ের ওপর ভর করেই চলে সংসার। শাহজাহান এখন থাকেন ডকইয়ার্ডের পাশে একটি মেসে। তিনি বলেন, ছয়–সাত বছর ধরে একই মজুরি (৪৫০ টাকা) পেয়ে আসছেন। সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়েনি শাহজাহানের মতো শ্রমিকদের মজুরি।
‘আমরা চাই সরকারি ছুটিগুলো অন্তত আমাদের দেওয়া হোক। আমাদের হাজিরাটা (প্রতিদিনের কাজের মজুরি) বাড়ানো হোক।’শ্রমিক শাহীনশাহজাহান জানান, ডকইয়ার্ডে কেবল প্রতিদিন হাজিরার ওপর বেতন দেওয়া হয়। শ্রমিক দিবস কিংবা সরকারি কোনো ছুটি তাঁরা পান না। কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেলেও মজুরি কেটে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ তাঁদের মজুরি। বলেন, ‘এইবার একবার রোজা রইয়া কাজ করতে গিয়া হুইয়া পড়ছি, অসুস্থ অইছি। কইলাম একটু মোরে ডাক্তারে ধারে নাও, হেইয়া কেউ নেলো না। জেরে আধা ঘণ্টা ধরে হুইয়া রইছি, পরে আস্তে আস্তে উইড্ডা বাসায় গেছি, জেরে ডাক্তারের ধারে গিয়া স্যালাইন আইনা খাইয়া হের পরে সুস্থ অইছি।’
শুধু শ্রমিক শাহজাহান নয়, রাজধানীর সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের এ ডকইয়ার্ডে আজ কাজ করেছেন অসংখ্য শ্রমিক। ভরদুপুরে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়া আরও দুই শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের মধ্যে একজন ৭৬ বছর বয়সী ইউনুস হাওলাদার। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই ডকইয়ার্ডে কাজ করছেন তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নে। সুন্দরবনের বাঘ-হরিণে ডাক দিলে তাঁর বাড়ি থেকে শোনা যায় বলে তিনি জানান। কাজের জন্য ঢাকার হাবিব নগরে থাকেন। পরিবারে ৫ ছেলে ১ মেয়ে।
প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয় ডকইয়ার্ড শ্রমিকদের.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ডকইয় র ড ক জ করত ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।