কয়েক দিন আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম খুন হন। দুই নারী শিক্ষার্থীর প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসির অভিযোগে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জেরে ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হন জাহিদুল। হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। জাহিদুল রাজনৈতিকভাবে ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড নিশ্চিতভাবে আমাদের সমাজের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যকার অসহিষ্ণুতা ও বিকারহীন ক্ষমতাচর্চার প্রতিচ্ছবি।

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের কয়েকজন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ ওঠে। এটিকে বিএনপি ও ছাত্রদল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে চিত্রিত করে বিবৃতি দেয় এবং কর্মসূচি পালন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও পাল্টা বিবৃতি দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, পাল্টাপাল্টি এই বিবৃতিতে একটা ২২ বছরের তরুণের সম্ভাবনাময় জীবনের অবসান হলো, মা-বাবা যে তাঁর প্রিয়তম সন্তানকে হারালেন— সেই ক্ষতি, সেই শোক কি পূরণ হবে?

জাহিদুলের মা পারভীন আক্তারের প্রশ্ন, ‘হেরারে (হত্যার সঙ্গে জড়িতদের) আমার সামনে আন, আমি জিগাই কী অপরাধ আছিন আমার পুতের। কের লাইগ্যা আমার পুতেরে মারল হেরা।’ সন্তানহারা মায়ের এই আর্তির উত্তর কি কেউ দিতে পারবেন!

জাহিদুলের হত্যার প্রতিবাদে বিএনপির একটা প্রতিবাদ মিছিলে নেতা-কর্মীদের স্লোগান দিতে শুনেছি, ‘একটা একটা এনসিপি ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’।—রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চা কী, সেটা বোঝার একটা বড় মাপকাঠি হলো তাদের স্লোগান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা থেকে সরে আসার প্রক্রিয়াটা গণতান্ত্রিক নয়; বরং যে দল ক্ষমতায় যায়, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর ভর করে, আইনবিধি সংশোধন করে, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চায়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতি সাংঘর্ষিক। রাস্তার রাজনীতিই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে।

বিরোধী রাজনীতিতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা চেষ্টা করেন সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। আর ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করে দিতে চান। রাজনৈতিক চর্চায় বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে গোত্রবাদী চর্চা আমরা দেখি আসছি, সেখানে ‘ধরে ধরে জবাই কর’— এই স্লোগান আমাদের অনেকের কানে স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই স্লোগান কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয় না? এই স্লোগান শিশু-কিশোরদের মনে কী প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়? কিংবা বিদেশিরা এই স্লোগানকে কীভাবে পড়বে?

বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান্তরালেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যার ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে ‘স্বাভাবিকতা’ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চায় অন্য দল ও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা নিছক রাজনৈতিক এজেন্ডার বিষয়। এখানে নাগরিক হত্যার কোনো মানবিক মূল্য নেই। আমরা কি সামনে এগোতে পারব না গোত্রতন্ত্রের রাজনীতি থেকে। ‘ধরে ধরে জবাই কর’— স্লোগান স্থায়ীভাবে বন্ধ হোক রাজনীতি থেকে।

অথচ জুলাই অভ্যুত্থান আরও অনেক সম্ভাবনার সঙ্গে ৫৪ বছরের রাজনীতির সঙ্গে একটা স্পষ্ট ছেদবিন্দু আঁকার সুযোগ সামনে নিয়ে এসেছে। এই সুযোগ হুট করে রূপকথার গল্পের মতো একদিন সকালে আসেনি। জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে, যাদের বড় একটা অংশ শিশু ও ৩০ বছরের কম বয়সী, এই সুযোগ এসেছে। অভ্যুত্থানের পরপরই আমরা দেখেছি, কোন দলের কতজন নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন, সেই তালিকা নিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থানে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করছে। কিন্তু অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট সেটাকে ধারণ করে নিজেদের চর্চা পাল্টানোর তাগিদ কার মধ্যে কতটা দৃশ্যমান?

জাহিদুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে কি না, সেটা বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর গত সাড়ে আট মাসে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিন্তু থেমে নেই; বরং যেকোনো বিবেচনাতেই এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক। আর সবচেয়ে বেশি হত্যার শিকার হয়েছেন বিএনপির কর্মীরা, সেটা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাতে যতটা, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি নিজেদের কোন্দলে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) গত ২৫ এপ্রিলের তথ্য বলছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) সারা দেশে অন্তত ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপির অন্তঃকোন্দলে ২৭ জন, আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে ৫ জন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষে ৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সংঘর্ষে ২ জন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংঘর্ষে ১ জন নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের রাউজান, মিরসরাই ও আনোয়ারা উপজেলায় গত ৮ মাসে প্রায় ৮০টি ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১০ কর্মী খুন এবং অন্তত ৩৫০ জন আহত হয়েছেন।

১২ এপ্রিল দৈনিক সমকালের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আট মাসে দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিএনপির ৫১ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।

এই যে এত এত মানুষের মৃত্যু, তার রাজনৈতিক মূল্য কতটুকু? এসব মৃত্যু ঘটেছে কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি, নেতাদের মধ্যে বিরোধ, মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্ষমতার বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, বালু ও মাটি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঘটা সংঘর্ষে। কিন্তু এই সংঘাত থামাতে, এই অযথা অমূল্য রক্তপাত বন্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন বিএনপির নেতৃত্ব? কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাঁরা। অন্য দলগুলোও বা কী ব্যবস্থা নিয়েছে।

নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মীরা যখন একই দলের কর্মীদের হাতে খুন হচ্ছেন, তখন একটা শব্দও উচ্চারণ হতে আমরা দেখি না। কিন্তু যে দলের কর্মীই হোক, কিংবা রাজনৈতিকভাবে যে আদর্শকেই ধারণ করুক না কেন, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। একজন সহনাগরিকের মৃত্যু কেন কোনো অনুভূতি, কোনো বোধ তৈরি করতে পারে না।

বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে তাদের সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে খুন করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে ৬০০-এর বেশি নেতা-কর্মীকে। কিন্তু সাড়ে আট মাসে তাদের নিজেদের বিরোধে যে শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হলেন, সেটা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বিবৃতি নেই কেন তাদের।

বাংলাদেশের রাজনীতি গোত্রবাদী চর্চা থেকে খুব বেশি পা যে এগোতে পারেনি, রাজনৈতিক খুনোখুনি তারই প্রতিচ্ছবি। নতুন চর জাগলে কিংবা আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে একসময় এখানে বল্লম, টেঁটা নিয়ে বিবদমান দুই গোষ্ঠী খুনোখুনিতে মেতে উঠত। এখনো আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সিগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় এই চর্চা দেখি। এই মানসিকতাও রাজনীতিতে পুনর্লিখিত হয়েছে।

বাংলাদেশ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হত্যাকাণ্ড হতে দেখেছি। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেই এই খুনের ঘটনা ঘটেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের আসামিরা পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর মুক্তি পান এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন। দেশে আলোড়ন ওঠা সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। সে সময়কার আলোচিত গোপালগঞ্জে ৪ কমিউনিস্ট নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার হত্যার বিচার হয়নি।

ফলে বাংলাদেশের একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে একটা বৈধতা দেওয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে। নব্বই থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে রাজনৈতিক হত্যার একটি চিত্র পাওয়া যায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘হত্যার রাজনীতি, লাশের মিছিল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে। মাঝের ২০০৭-০৮-এর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদে বাকিটা ছিল সংসদীয় রাজনীতির সময়কাল। সেই ২২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যার শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৫১৯ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে নিহত হয়েছিলেন ১১ জন। বিএনপির প্রথম আমলে (১৯৯১-৯৬) নিহত হয়েছিলেন ১৭৪ জন, আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে (১৯৯৬-২০০১) নিহত হয়েছিলেন ৭৬৭ জন, বিএনপির দ্বিতীয় আমলে (২০০১-২০০৬) নিহত হয়েছিলেন ৮৭২ জন, আওয়ামী লীগের তৃতীয় আমলে (২০০৯-২০১৩) নিহত হয়েছিলেন ৫৬৪ জন।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান্তরালেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যার ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে ‘স্বাভাবিকতা’ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চায় অন্য দল ও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা নিছক রাজনৈতিক এজেন্ডার বিষয়। এখানে নাগরিক হত্যার কোনো মানবিক মূল্য নেই। আমরা কি সামনে এগোতে পারব না গোত্রতন্ত্রের রাজনীতি থেকে। ‘ধরে ধরে জবাই কর’— স্লোগান স্থায়ীভাবে বন্ধ হোক রাজনীতি থেকে।

মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প র র র জন ত র র জন ত ক এই স ল গ ন র জন ত ত ক র জন ত ন জ দল র কর ম দ র ব এনপ র ক ন দল আম দ র র কর ম স ঘর ষ র চর চ প রথম র একট আওয় ম ক ষমত স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল

তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।

যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।

এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।

বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।

একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু

রাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

এত মৃত্যুর কারণ কী

এই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।

যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।

গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।

গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।

মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।

শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:

এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।

দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)

তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।

চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।

পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।

এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।

পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি

নিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।

গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

লেখক গবেষক: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ