নিজ দলের হাতে নেতাকর্মী খুনে চুপ কেন বিএনপি
Published: 2nd, May 2025 GMT
কয়েক দিন আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম খুন হন। দুই নারী শিক্ষার্থীর প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসির অভিযোগে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জেরে ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হন জাহিদুল। হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। জাহিদুল রাজনৈতিকভাবে ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড নিশ্চিতভাবে আমাদের সমাজের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যকার অসহিষ্ণুতা ও বিকারহীন ক্ষমতাচর্চার প্রতিচ্ছবি।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের কয়েকজন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ ওঠে। এটিকে বিএনপি ও ছাত্রদল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বলে চিত্রিত করে বিবৃতি দেয় এবং কর্মসূচি পালন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও পাল্টা বিবৃতি দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, পাল্টাপাল্টি এই বিবৃতিতে একটা ২২ বছরের তরুণের সম্ভাবনাময় জীবনের অবসান হলো, মা-বাবা যে তাঁর প্রিয়তম সন্তানকে হারালেন— সেই ক্ষতি, সেই শোক কি পূরণ হবে?
জাহিদুলের মা পারভীন আক্তারের প্রশ্ন, ‘হেরারে (হত্যার সঙ্গে জড়িতদের) আমার সামনে আন, আমি জিগাই কী অপরাধ আছিন আমার পুতের। কের লাইগ্যা আমার পুতেরে মারল হেরা।’ সন্তানহারা মায়ের এই আর্তির উত্তর কি কেউ দিতে পারবেন!
জাহিদুলের হত্যার প্রতিবাদে বিএনপির একটা প্রতিবাদ মিছিলে নেতা-কর্মীদের স্লোগান দিতে শুনেছি, ‘একটা একটা এনসিপি ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’।—রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চা কী, সেটা বোঝার একটা বড় মাপকাঠি হলো তাদের স্লোগান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা থেকে সরে আসার প্রক্রিয়াটা গণতান্ত্রিক নয়; বরং যে দল ক্ষমতায় যায়, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর ভর করে, আইনবিধি সংশোধন করে, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চায়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতি সাংঘর্ষিক। রাস্তার রাজনীতিই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে।
বিরোধী রাজনীতিতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা চেষ্টা করেন সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। আর ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করে দিতে চান। রাজনৈতিক চর্চায় বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে গোত্রবাদী চর্চা আমরা দেখি আসছি, সেখানে ‘ধরে ধরে জবাই কর’— এই স্লোগান আমাদের অনেকের কানে স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই স্লোগান কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয় না? এই স্লোগান শিশু-কিশোরদের মনে কী প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়? কিংবা বিদেশিরা এই স্লোগানকে কীভাবে পড়বে?
বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান্তরালেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যার ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে ‘স্বাভাবিকতা’ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চায় অন্য দল ও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা নিছক রাজনৈতিক এজেন্ডার বিষয়। এখানে নাগরিক হত্যার কোনো মানবিক মূল্য নেই। আমরা কি সামনে এগোতে পারব না গোত্রতন্ত্রের রাজনীতি থেকে। ‘ধরে ধরে জবাই কর’— স্লোগান স্থায়ীভাবে বন্ধ হোক রাজনীতি থেকে।অথচ জুলাই অভ্যুত্থান আরও অনেক সম্ভাবনার সঙ্গে ৫৪ বছরের রাজনীতির সঙ্গে একটা স্পষ্ট ছেদবিন্দু আঁকার সুযোগ সামনে নিয়ে এসেছে। এই সুযোগ হুট করে রূপকথার গল্পের মতো একদিন সকালে আসেনি। জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে, যাদের বড় একটা অংশ শিশু ও ৩০ বছরের কম বয়সী, এই সুযোগ এসেছে। অভ্যুত্থানের পরপরই আমরা দেখেছি, কোন দলের কতজন নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন, সেই তালিকা নিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থানে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করছে। কিন্তু অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট সেটাকে ধারণ করে নিজেদের চর্চা পাল্টানোর তাগিদ কার মধ্যে কতটা দৃশ্যমান?
জাহিদুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে কি না, সেটা বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর গত সাড়ে আট মাসে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিন্তু থেমে নেই; বরং যেকোনো বিবেচনাতেই এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক। আর সবচেয়ে বেশি হত্যার শিকার হয়েছেন বিএনপির কর্মীরা, সেটা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাতে যতটা, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি নিজেদের কোন্দলে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) গত ২৫ এপ্রিলের তথ্য বলছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় গত তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) সারা দেশে অন্তত ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপির অন্তঃকোন্দলে ২৭ জন, আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দলে ৫ জন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষে ৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সংঘর্ষে ২ জন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সংঘর্ষে ১ জন নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের রাউজান, মিরসরাই ও আনোয়ারা উপজেলায় গত ৮ মাসে প্রায় ৮০টি ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১০ কর্মী খুন এবং অন্তত ৩৫০ জন আহত হয়েছেন।
১২ এপ্রিল দৈনিক সমকালের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আট মাসে দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিএনপির ৫১ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।
এই যে এত এত মানুষের মৃত্যু, তার রাজনৈতিক মূল্য কতটুকু? এসব মৃত্যু ঘটেছে কর্মীদের মধ্যে রেষারেষি, নেতাদের মধ্যে বিরোধ, মূল সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গসংগঠনের মতভিন্নতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্ষমতার বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, বালু ও মাটি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঘটা সংঘর্ষে। কিন্তু এই সংঘাত থামাতে, এই অযথা অমূল্য রক্তপাত বন্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন বিএনপির নেতৃত্ব? কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাঁরা। অন্য দলগুলোও বা কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মীরা যখন একই দলের কর্মীদের হাতে খুন হচ্ছেন, তখন একটা শব্দও উচ্চারণ হতে আমরা দেখি না। কিন্তু যে দলের কর্মীই হোক, কিংবা রাজনৈতিকভাবে যে আদর্শকেই ধারণ করুক না কেন, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। একজন সহনাগরিকের মৃত্যু কেন কোনো অনুভূতি, কোনো বোধ তৈরি করতে পারে না।
বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে তাদের সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে খুন করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে ৬০০-এর বেশি নেতা-কর্মীকে। কিন্তু সাড়ে আট মাসে তাদের নিজেদের বিরোধে যে শতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হলেন, সেটা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বিবৃতি নেই কেন তাদের।
বাংলাদেশের রাজনীতি গোত্রবাদী চর্চা থেকে খুব বেশি পা যে এগোতে পারেনি, রাজনৈতিক খুনোখুনি তারই প্রতিচ্ছবি। নতুন চর জাগলে কিংবা আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে একসময় এখানে বল্লম, টেঁটা নিয়ে বিবদমান দুই গোষ্ঠী খুনোখুনিতে মেতে উঠত। এখনো আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সিগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় এই চর্চা দেখি। এই মানসিকতাও রাজনীতিতে পুনর্লিখিত হয়েছে।
বাংলাদেশ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হত্যাকাণ্ড হতে দেখেছি। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেই এই খুনের ঘটনা ঘটেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের আসামিরা পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর মুক্তি পান এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন। দেশে আলোড়ন ওঠা সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। সে সময়কার আলোচিত গোপালগঞ্জে ৪ কমিউনিস্ট নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার হত্যার বিচার হয়নি।
ফলে বাংলাদেশের একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে একটা বৈধতা দেওয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে। নব্বই থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে রাজনৈতিক হত্যার একটি চিত্র পাওয়া যায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘হত্যার রাজনীতি, লাশের মিছিল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে। মাঝের ২০০৭-০৮-এর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদে বাকিটা ছিল সংসদীয় রাজনীতির সময়কাল। সেই ২২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যার শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৫১৯ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে নিহত হয়েছিলেন ১১ জন। বিএনপির প্রথম আমলে (১৯৯১-৯৬) নিহত হয়েছিলেন ১৭৪ জন, আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে (১৯৯৬-২০০১) নিহত হয়েছিলেন ৭৬৭ জন, বিএনপির দ্বিতীয় আমলে (২০০১-২০০৬) নিহত হয়েছিলেন ৮৭২ জন, আওয়ামী লীগের তৃতীয় আমলে (২০০৯-২০১৩) নিহত হয়েছিলেন ৫৬৪ জন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান্তরালেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যার ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে ‘স্বাভাবিকতা’ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চায় অন্য দল ও নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা নিছক রাজনৈতিক এজেন্ডার বিষয়। এখানে নাগরিক হত্যার কোনো মানবিক মূল্য নেই। আমরা কি সামনে এগোতে পারব না গোত্রতন্ত্রের রাজনীতি থেকে। ‘ধরে ধরে জবাই কর’— স্লোগান স্থায়ীভাবে বন্ধ হোক রাজনীতি থেকে।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক প র র র জন ত র র জন ত ক এই স ল গ ন র জন ত ত ক র জন ত ন জ দল র কর ম দ র ব এনপ র ক ন দল আম দ র র কর ম স ঘর ষ র চর চ প রথম র একট আওয় ম ক ষমত স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
কোহলি জানালেন, তাঁর ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলেছিল যে আইপিএল–সতীর্থ
২০০৮ সালে তাঁর আইপিএল অভিষেক। আইপিএলের শুরুর মৌসুমে ভারতের টপ অর্ডার এই ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলিকে দলে ভিড়িয়েছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর।
১৭ বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে কোহলির মনে পড়ছে, আইপিএলে শুরুর দিনগুলোতে কোন সতীর্থ তাঁর ব্যাটিংয়ের ওপর প্রভাব ফেলেছিলেন।
বেঙ্গালুরুর এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক পডকাস্ট ভিডিওতে কোহলি কথা বলেছেন আইপিএলে নিজের শুরুর সময় নিয়ে। সেই ভিডিওতে তিনি মায়ন্তি ল্যাঙ্গারকে বলেছেন সাবেক আইপিএল সতীর্থ দক্ষিণ আফ্রিকার মার্ক বাউচারের কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক এবং উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান কীভাবে তাঁর ব্যাটিংয়ে প্রভাব রেখেছিলেন, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কোহলি।
মার্ক বাউচার