সম্প্রতি ভারতের একজন সমরবিশেষজ্ঞ ও ফোর্স পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ সাহানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কেন ভারতের পক্ষে এখনই যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর ও অন্যদের বক্তব্য থেকে একটা ন্যূনতম মৌলিক বিষয় বেরিয়ে আসছে। বিষয়টি হলো, ভারত এটা বুঝতে পারছে না যে আক্রমণ করে তারা শুধু পাকিস্তানের সঙ্গেই সরাসরি লড়াই করবে, নাকি চীনের সঙ্গে পরোক্ষভাবেও তাদের লড়তে হবে।

সাহানি বলেছেন, চীন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলে চীন ও ভারতের সীমান্তে (লাইন অব অ্যাকচ্যুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) চীনের সেনাবাহিনীর ‘গ্রে জোন অ্যাকটিভিটি’ (সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে এমন কিছু করা, যাতে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সফল হয়, আবার শত্রুপক্ষ বিষয়টিকে যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে পাল্টা আক্রমণে যেতে পারে না। যেমন ভুয়া ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালানো, অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি, সাইবার আক্রমণ প্রভৃতি) বাড়াবে। এর ফলে চীন সীমান্ত, অর্থাৎ এলএসি থেকে যাবতীয় সরঞ্জাম (অস্ত্র ও লোকলস্কর) সরিয়ে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে (লাইন অব কন্ট্রোল) নিয়ে যাওয়ার বিষয় বিভ্রান্তিতে থাকবে ভারত।

আরও পড়ুনযুদ্ধ বাধলে পাকিস্তান ও ভারত— কার কী ক্ষতি হবে০৩ মে ২০২৫

সাহানির বক্তব্য, এই যুদ্ধ–পরিস্থিতিতে চীনের যে একটি অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তার প্রধান কারণ, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাবিষয়ক ধারাগুলোর প্রত্যাহার। এই পরিবর্তনের কারণে চীন ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানকে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে।

চীন মর্যাদা প্রত্যাহারের বিষয়টি যে একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি, সেটা তারা ২০১৯ সালের ৬ আগস্টই জানিয়েছিল। কারণ, কাশ্মীর চীন–সংলগ্ন অঞ্চল। এখানে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিরোধিতা করেছিল চীন। তাই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ যদি একবার শুরু হয়, তবে চীন কোন পক্ষ নেবে, সেটা জোর দিয়ে ভারতের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, শুধু যদি পাকিস্তানের সঙ্গে লড়ার বিষয়ে ভারত নিশ্চিত হতো, তবে গত ২২ এপ্রিলের পরই তারা যুদ্ধ শুরু করে দিত।

চীনের পাশাপাশি ভারতের পূর্বে, অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে ভারতের উদ্বেগ গত আট মাসে প্রচণ্ড বেড়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতে চীন ছাড়াও রয়েছে মিয়ানমার সীমান্ত। যে সীমান্তের কারণে ভারতকে বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। মণিপুরে আড়াই শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পরে এবং সেখানেও নানান ‘অ্যাসেট’ (সরঞ্জাম) মজুত রাখতে হচ্ছে। পাকিস্তান সীমান্তের মতোই সেখান থেকেও চট করে সরঞ্জাম ও সৈন্য সরানো যাবে না।

যুদ্ধের খরচ

২০২১ সালে আফগানিস্তান ছাড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় ‘কস্ট অব ওয়ার’ বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখিয়েছিল, ২০ বছরে খরচ হয়েছে ২ দশমিক ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার (দৈনিক ৩১৬ মিলিয়ন ডলার)। এই হিসাব করা হয়েছিল, যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন বা আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার খরচ ও ক্ষতিপূরণ বাদ দিয়ে। যাবতীয় খরচ সুদসহ ধরলে ২০৫০ সালে এই অঙ্ক সাড়ে ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে জানানো হয়েছিল।

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ঠিক কত খরচ করছে, তা জানা যায়নি। কারণ, মস্কো সবকিছু পার্লামেন্টে জানায় না। তারপরও রাশিয়া বিপদের মধ্যে রয়েছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা মনে করছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পেন্টাগন জানিয়েছিল, দৈনিক ২৮৯ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের।

এরই পাশাপাশি দিল্লিকে মাথায় রাখতে হচ্ছে যে এই সময়ে, যখন বিশ্বব্যাপী ‘রিসেশন’ বা মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন ভারতের অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বৃহৎ অর্থব্যবস্থার মধ্যে ভারতের সবচেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি হচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরে সম্ভাব্য বৃদ্ধি ৭ শতাংশ। যুদ্ধ করে এই হার ধরে রাখা অসম্ভব। অন্যদিকে ভারত যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে, তাদের অবস্থা দেখে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে ফল গড়াবে বহুদূরে০২ মে ২০২৫

আফগানিস্তান-পাকিস্তান (আফ-পাক) আন্তর্জাতিক জিহাদ পর্যবেক্ষক আবদুল সৈয়দ জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ২৬২টি হামলা বৃহৎ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানে চালিয়েছিল। এরপরে সর্বোচ্চ আক্রমণ হয়েছে গত মার্চে, ২৬০টি। বেসামরিক নাগরিকের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কর্মী থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিপুল সংখ্যায় মারা গেছেন। সোজা কথায়, পাকিস্তানের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ চলছে।

অর্থব্যবস্থার প্রশ্নে, পাকিস্তানের ডন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে গত ২৮ এপ্রিল বলা হয়েছে, ‘৫০ বছর আগে আমরা একটি প্রবল গতিশীল অর্থব্যবস্থায় ছিলাম, আজ সিঁড়ির একেবারে নিচে পৌঁছেছি।’ পাকিস্তান যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ওপর নির্ভরশীল, তা–ও বলা হয়েছে।

তাই যুদ্ধে গেলে পাকিস্তানের কতটা ক্ষতি হবে, বলা মুশকিল; কিন্তু ভারতের যে সবিশেষ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

ভারতে চাপ বাড়ছে

যুদ্ধ করে যে লাভ হয় না, সেটা ভারত বোঝে। এ কারণেই ক্ষমতায় আসার পরে গত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে অন্তত দুবার ‘হট ওয়ার’ বা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করার সুযোগ এসে গেলেও তিনি করেননি। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা এবং ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে চীনা ফৌজের হাতে ২০ ভারতীয় সৈনিকের মৃত্যুর জেরে যুদ্ধের সুযোগ এসেছিল।

পুলওয়ামায় ঠিক কী হয়েছিল, সেটা ভারতীয়রা ভালো করে বোঝেন না; কিন্তু এটা বোঝেন যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হয়নি। আর লাদাখের গালওয়ানে যে ভারত গোড়া থেকেই যুদ্ধের রাস্তায় হাঁটেনি, তা পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়ে যায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন (মার্চ, ২০২২), তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দুই বছর ধরে কথা বলছেন; অর্থাৎ গালওয়ান সংঘর্ষের সময় থেকে। এর মানে হলো, ভারত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়নি।

কিন্তু বর্তমানে নরেন্দ্র মোদির ওপর সাংঘাতিক চাপ রয়েছে ও তা বাড়ছে। চাপটা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দিক থেকে। তাদের দাবি, যুদ্ধ করতে হবে। ভারত সরকারের কট্টর সমর্থক ও দেশের অন্যতম প্রধান এক প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাংবাদিক লিখেছেন, এবারে আর ওই সব সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা বালাকোট দিয়ে হবে না। এবারে এমন কিছু করতে হবে, যার অর্থ আছে। অর্থাৎ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা বালাকোটের কোনো অর্থ নেই। এবারে এমন কিছু করতে হবে, যার অর্থ আছে। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করতে হবে।

আরও পড়ুনভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম২৮ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের বর্তমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ এখন আর শুধু সংখ্যালঘু পীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না। এটা এখন অন্য দেশের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর রাস্তায় হাঁটতে চাইছে।

বিশ্ব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কানাডার সমাজবিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রায় সব দেশেই একটা সময় পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ মোটামুটিভাবে সংখ্যালঘু পীড়নের মধ্যে দিয়ে পরিতোষ লাভ করে। কিন্তু এমন একটা সময় আসে, যখন এটা আর শুধু দেশের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, অন্য দেশের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর বা তাকে নিয়ন্ত্রণের রাস্তায় যেতে চায়। অর্থাৎ যুদ্ধে যেতে চায়। একটা সময় ছিল, যখন জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিকভাবে শোষিত জাতিজুড়ে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের একটি প্রধান হাতিয়ার ছিল। এর পরিবর্তন হয়েছে। এখন সংখ্যালঘু নিপীড়ন সংখ্যাগরিষ্ঠের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের যন্ত্র থেকে এটি সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ও পরিচয়ের রাজনীতির (আইডেনটিটি পলিটিকস) অংশ হয়ে উঠেছে এবং যুদ্ধের আহ্বানকে চালিত করছে।’

একে ‘সাংঘাতিক বিপজ্জনক’ একটা পরিস্থিতি বলেছেন অধ্যাপক ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী। তাই এখন বিজেপিশাসিত সরকারের পক্ষে যুদ্ধ না করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসা মুশকিল নয়, অসম্ভব।

ভূকৌশলগত রাজনীতির সমীকরণ

এখানে আরও একটা ব্যাপার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভূকৌশলগত যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বিরোধ দুই দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে চলছে। কাশ্মীরকে পাকিস্তান সব সময় ব্যবহার করেছে ‘লিভারেজ পয়েন্ট’, অর্থাৎ এমন এক বিন্দু হিসেবে, যেটিকে কৌশলগত রাজনীতিতে প্রয়োগ করা যায়।

এখন পেহেলগামে যে ঘটনা ঘটল, সেই ঘটনা সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য, এর পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এবং পাকিস্তানের বক্তব্য, এর পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। এটা সম্ভবত কখনোই নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করা যাবে না যে এই ঘটনার পেছনে কার হাত রয়েছে। সাধারণত কাশ্মীরে সেটা করা যায়ও না।

কিন্তু এর একটা ব্যাখ্যা রয়েছে, যেটা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিচ্ছিলেন কাশ্মীরের এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘আমরা ধরে নিচ্ছি যে এর পেছনে পাকিস্তানের হাত নেই। হতে পারে আবার না–ও হতে পারে। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এ ঘটনা নিশ্চিতভাবে ভারতকে সমস্যায় ফেলেছে, পাকিস্তানকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে।’

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাগলে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে২৭ এপ্রিল ২০২৫

ওই সাংবাদিকের কথায়, এর ফলে নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে ‘ভারত গোটা দেশের মানুষকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেটা যে ভিত্তিহীন, এটা বোঝা গেছে।’

ভারতের দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিসংখ্যান মোতাবেক, ‘২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শুধু কাশ্মীরে পর্যটকদের সংখ্যা ৪২৫ শতাংশ বেড়েছে (৬ দশমিক ৬৫ লাখ থেকে ৩৪ দশমিক ৯৮ লাখে) এবং ২০২৪ সালে জম্মু-কাশ্মীরে প্রায় ৬৫ হাজার বিদেশিসহ ২ দশমিক ৩৫ কোটি পর্যটক গিয়েছেন।’

ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং) একসময়ের প্রধান এ এস দুলত পেহেলগামের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সব জায়গায় কনস্টেবল দেওয়া সম্ভব নয়।’ ঠিক কথা, কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কাশ্মীর নিরাপদ বলে হাওয়া তুলে দেওয়ার জন্য কে দায়ী?

এখানেই পাকিস্তানের একটা বড় সুবিধা হয়ে যাচ্ছে। ভারতের পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, কাশ্মীরকে নিরাপদ রাখতে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ভূরাজনীতির খেলায় পাকিস্তানকে একটি পক্ষ হিসেবে দেখা প্রয়োজন, কাশ্মীর ও ভারতের মতো আরও দুই পক্ষের পাশাপাশি। যে পর্যবেক্ষকেরা এ কথা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছেন, তাঁদের অন্যতম ওই দুলত।

পেহেলগামের ঘটনার চার দিন আগে এক অনুষ্ঠানে যখন দুলতকে কাশ্মীর সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে এই সম্পর্ক বন্দুক ও যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হবে না। আমি বলছি না আমাদের কিছু দেওয়া বা নেওয়া উচিত, তবে কথা বলা উচিত। কথা বলতে ক্ষতি কী?’

কিন্তু সমস্যা হলো ওই হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ওই জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে বিজেপি একের পর এক নির্বাচনে জিতেছে ও জিতছে। তাদের পক্ষে রাতারাতি বা হয়তো কখনোই একটি ‘মুসলিম’ দেশের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়, বিশেষত সাম্প্রতিক ঘটনার পরে। সে ক্ষেত্রে তাদের সমর্থকেরা প্রশ্ন তুলবেন যে তাহলে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির তফাত কোথায়? বিজেপির ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের আঘাত লাগার আশঙ্কাও সে ক্ষেত্রে থাকবে।

এখনই জাতীয় নির্বাচন না থাকলেও আগামী দুই বছরে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে মোট ১৩ জায়গায় নির্বাচন হবে। এর মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশও রয়েছে। এই অবস্থায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধান বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়।

আবার যেমনটা বলা হয়েছে, চট করে যুদ্ধে যাওয়াও অর্থব্যবস্থার জন্য আত্মহত্যার শামিল হতে পারে। ফলে একটা জটিল অবস্থার মধ্যে গিয়ে পড়েছে ভারতের কেন্দ্র সরকার। ‘যুদ্ধ করব না’ এটা বলা যাচ্ছে না, আবার ‘করব’ সেটাও ঘোষণা করা যাচ্ছে না।

এই অবস্থায় সবকিছুই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর। গত ১১ বছরে বারবার দলকে খাদের কিনারা থেকে বাঁচিয়েছেন মোদি। এই মুহূর্তে সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি ও তাঁর দল। কীভাবে সামলান, সেটাই দেখার বিষয়।

শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০২৪ স ল য দ ধ কর র আশঙ ক অবস থ য ত র সব র জন ত ত র পর ঘটন র দশম ক র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

জাবিতে বই সহজলভ্য করছে ‘গ্রন্থাশ্রম’ 

প্রযুক্তির প্রলোভন, সহজলভ্যতার অভাবে তরুণদের মাঝে মুদ্রিত বইয়ের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বই একমাত্র মাধ্যম, যেখানে মানুষ খুঁজে পায় জ্ঞান, মুক্তি ও মানবিকতার পথ। এই বিশ্বাস থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) একদল বইপ্রেমী শিক্ষার্থী গড়ে তুলেছেন ‘গ্রন্থাশ্রম’ নামে ব্যতিক্রমী বই বিপণি।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশী-বিদেশী কোনো বইয়ের দোকান ছিল না। দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে ঢাকার নীলক্ষেতে কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে বই কিনতে হতো শিক্ষার্থীদের। এতে তাদের সময় ও অর্থে অপচয়সহ চরম ভোগান্তিতে পড়তে হতো।

এ ভোগান্তি নিরসনে এবং শিক্ষার্থীদের বই পড়া ও কেনা সহজলভ্য করতে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় ২০টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘গ্রন্থাশ্রম’।

আরো পড়ুন:

জাবি উপ-উপাচার্যের ফেসবুক আইডি হ‍্যাক

জুলাই হামলাকারীদের শাস্তি চেয়ে জাবি ছাত্রদলের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’

যার নেপথ্যে ছিলেন, বাংলা বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. মাহফুজ আহমেদ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ সজিব এবং বাংলা বিভাগের ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন।

পরে এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন বাংলা বিভাগের সিফাত আন-নূর শিহাব, রামিসা, অনামিকা আহমদ, দর্শন বিভাগের সাগরময় বিশ্বাস এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাহমুদুল ইসলাম রাঙ্গা নামে শিক্ষার্থীরা।

প্রথমদিকে ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় গ্রন্থাশ্রমের কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বেশকিছু বই ধুলোবালি ও বৃষ্টির কারণে নষ্ট হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বইপ্রেমীদের বাড়তে থাকা আগ্রহের কারণে একটি নির্দিষ্ট কক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন উদ্যোক্তারা।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও অনুমতি পাননি তারা। বর্তমান প্রশাসনের সহায়তায় ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার একটি পরিত্যক্ত কক্ষ সংস্কার করে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে ‘গ্রন্থাশ্রম’। বর্তমানে ২ লাখ টাকা সমমূল্যের বই রয়েছে গ্রন্থাশ্রমে।

গ্রন্থাশ্রমের পরিচালক মাহফুজ আহমেদ বলেন, “শুরুর দিকে আমাদের বই বিক্রির চিন্তা ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম বেশকিছু বই নিয়ে আমরা বসবো, সেখান মানুষজন  আসবে, বই পড়বে, বই নিয়ে আলোচনা করবে ইত্যাদি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমরা বুঝতে পারলাম সংকট, প্রতিকূলতা ছাপিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে আর্থিক চাকা সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই।”

তিনি বলেন, “গ্রন্থাশ্রমের বইগুলো যেমন আমাদের পকেটের টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে, তেমনি এখানে বই পড়তে এসে সুন্দর মলাট দেখে অনেকে বই কেনার আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। তখন থেকে আমরা বই বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।”

বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রতিদিন চালু থাকে এই বই বিপণি। এখানে রয়েছে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি ও সমকালীন চিন্তাধারার বিশ্লেষণমূলক বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ ও শহিদুল জহিরের রচনাও রয়েছে এখানে। বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রচিত বইগুলো স্থান পেয়েছে ‘জাহাঙ্গীরনগর কর্নার’ নামক একটি বিশেষ শেলফে।

মাহফুজ আহমেদ বলেন, “আমরা চাই শিক্ষার্থীরা যেন তাদের চাহিদা অনুসারে সহজেই সুলভমূল্যে ভালো বইয়ের নাগাল পায় এবং পড়ার অভ্যাসে ফিরে আসে। আমরা একই বইয়ের বিভিন্ন মানের ও দামের কালেকশন রেখেছি যাতে চাহিদা ও বাজেট অনুসারে প্রিয় বইটি কিনতে এসে কাউকে ফিরে যেতে না হয়।” 

শুধু বই বিক্রি নয়, বই নিয়ে আলোচনা, পাঠচক্র এবং সাহিত্যচর্চার একটি চর্চাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে গ্রন্থাশ্রম। গ্রন্থাশ্রমের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কোন বই কোন তাকে রয়েছে, তার রিয়েলটাইম তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বই অর্ডার করার সুযোগ রতেছে এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ফ্রি ডেলিভারি সুবিধা রয়েছে। যে বইটি তাদের আউটলেটে নেই, সেই বইটিও অর্ডার করার সুযোগ রয়েছে। ৩-৫ কর্মদিবসের মধ্যে কোনো ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই সেই বইটি জাবি শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা।

গ্রন্থাশ্রম কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীর খণ্ডকালীন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বই বিক্রির লভ্যাংশ থেকে গ্রন্থাশ্রমে কর্মরত শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসের ব্যয় নির্বাহের জন্য সম্মানী প্রদান করা হয়। আয় কম-বেশি যাই হোক একটি পরিবারের মত তারা একে অপরের পাশে থাকেন বলে জানান গ্রন্থাশ্রমের কার্যনির্বাহী পরিচালক সিফাত আন-নূর শিহাব।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে মাহফুজ বলেন, “ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যাদের হাতে পড়বে, তারা যেন অন্তঃসারশূন্য হয়ে বেড়ে না ওঠে। সেজন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সাহিত্যের বিশাল জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে আমরা গ্রন্থাশ্রমকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই।”

তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাশ্রমের আউটলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। মানুষ যেন কফি খেতে এসে যেকোনো বই পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা রাখতে চাই।”

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ