উপজেলা পর্যায়ে সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোয় বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা চালু করতে হবে, যাতে সেবার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হয়। এতে মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় ইনস্টিটিউটগুলোর ওপর রোগীর চাপ কমবে। ভৌগোলিক কারণে কেউ বিশেষায়িত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন না।

গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা.

এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।

এতে বলা হয়, প্রতিটি বিভাগীয় সদরে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও বিশ্বমানের টারশিয়ারি সেবা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য একটি আঞ্চলিক রেফারেল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে।

এই নিরীক্ষার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা চিহ্নিত করে সেবার মান উন্নয়ন ও অর্থ অপচয় রোধ করা যাবে। নিরীক্ষার ফলাফল ব্যবহার করে চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন, অর্থায়ন, পেমেন্ট এবং ক্রয় সিদ্ধান্তে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
কমিশন মনে করে, বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা অবিলম্বে চালু করতে হবে। এতে ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক ব্যবহারে শৃঙ্খলা আসবে। ওষুধের অপব্যবহার ও অতিরিক্ত খরচ রোধ হবে এবং জবাবদিহিমূলক ও ব্যয়সাশ্রয়ী চিকিৎসা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

সংস্কার প্রতিবেদনে সরকারি হাসপাতালে সেবা বিকেল ৫টা পর্যন্ত করা, বেসরকারি হাসপাতালে সেবামূল্য নির্ধারণ, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ওষুধের কাঁচামাল তৈরি, স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য সার্ভিস গঠনসহ ৩২টি সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে দুই বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক থেকে নেওয়া

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবহ র

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশের কৃষিতে যেভাবে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে

নদী ও উর্বর মাটিতে ভরা আমাদের এই দেশে কৃষিই জাতীয় জীবনের মূল চালিকা শক্তি। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই কৃষি এখানে কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি ছিল সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে লুকিয়ে আছে কৃষকের ঘাম, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের গল্প। হাজার বছরের এই কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে পয়লা অগ্রহায়ণ—নবান্ন উৎসবের দিনটিকে জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এই দিনটি এখন বাংলার কৃষি ও কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা, অর্জন এবং অঙ্গীকারের প্রতীক। পাশাপাশি দিনটি কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের এক জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

মোগল আমল পর্যন্ত এ অঞ্চলে কৃষি ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। ব্রিটিশ আমলে জমিদারি প্রথা কৃষিকে করেছিল শোষণের শিকার। মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর বাংলাদেশ কৃষিতে ছিল বিপর্যস্ত। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ ও উৎপাদনহীনতার কঠিন বাস্তবতায় জর্জরিত। ‘কৃষিই হবে উন্নয়নের ভিত্তি’—এই দর্শনে সরকার কৃষি পুনর্গঠনের নীতি গ্রহণ করে।

কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো।

এই সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৮০-র দশক থেকে ধান, গম ও সবজি উৎপাদনে বিপ্লব দেখা দেয়। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ। ধান, সবজি, মাছ-মাংস ও দুগ্ধ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে অগ্রগণ্য। এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে কোটি কৃষকের পরিশ্রম, কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন এবং কৃষি নীতি ও নেতৃত্বের সুপরিকল্পিত দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন কেবল চাষাবাদ নয়, এটি জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি সমন্বিত ক্ষেত্র।

অতীতের কৃষি ছিল পরিশ্রমনির্ভর। বর্তমান কৃষি হচ্ছে জ্ঞাননির্ভর। কৃষি গবেষণাগারে উদ্ভাবিত হচ্ছে উচ্চফলনশীল বীজ, জলবায়ু সহনশীল জাত, জৈব সার প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি–নির্ভর স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা। কৃষি এখন উৎপাদন  থেকে টেকসই উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে।

দেশের খাদ্যনিরাপত্তার মেরুদণ্ড হলো ধান। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১২০টিরও বেশি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহনশীল এই জাতগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে ধান চাষের সংকট দূর করেছে। এই উদ্ভাবনই বাংলাদেশকে ‘রাইস সেলফ সাফিশিয়েন্ট নেশন’ বা ধানে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। সবজি ও ফলের উন্নত জাতের জনপ্রিয়তা বাড়ায় সেগুলো এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে।

শ্রম থেকে প্রযুক্তির রূপান্তরে যান্ত্রিকীকরণ বাংলাদেশের কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে কৃষকের সময় ও শ্রম বাঁচছে এবং উৎপাদন ব্যয় কমছে।

কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাঁদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।

বাংলাদেশের কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কৃষকেরা মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে ফসলের রোগনির্ণয়, বাজারদর, আবহাওয়ার তথ্য ও সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। ড্রোন ইমেজিং, স্যাটেলাইট মনিটরিং ও রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে জমির স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। স্মার্ট কৃষি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ কৃষি ৪.০-এর যুগে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, সার ও পানির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ এবং বাজার চাহিদা বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষি এখন আর শুধু পুরুষের নয়, নারীর হাতও সমানভাবে এর অগ্রযাত্রায় যুক্ত। তাঁরা বীজ বপন, রোপণ, ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। নতুন প্রজন্মের তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘স্মার্ট অ্যাগ্রিপ্রেনিউরশিপ’ শুরু করছে। ই-কমার্স ভিত্তিক কৃষিপণ্য বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম, হাইড্রোপনিক ফার্মিং ইত্যাদি কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার’ মডেল। এই মডেলে উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষকের সহনশীলতা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে এখন চাষ হচ্ছে লবণাক্ততা সহনশীল ধান, বন্যাপ্রবণ এলাকায় গড়ে উঠেছে ফ্লোটিং গার্ডেন বা ভাসমান কৃষি।

শুষ্ক এলাকায় রয়েছে ড্রিপ সেচ ও সোলার কৃষি। বাংলাদেশের এই জলবায়ু সহনশীল কৃষি মডেল আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জমি ক্রমে কমছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষিজমির প্রায় ৩০ শতাংশ জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাই টেকসই কৃষি কৌশলই একমাত্র সমাধান।

কৃষি এ দেশের অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তার ভিত্তি হলেও কৃষকই সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, অথচ কৃষির মোট জিডিপি অবদান মাত্র ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। মানে দাঁড়ায়, কৃষকের পরিশ্রমের প্রকৃত আর্থিক মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না।

এই বৈষম্যই কৃষক–জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থা এখনো মধ্যস্বত্বভোগীনির্ভর। কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে একাধিক ধাপ পার হয়, যেখানে কৃষক সর্বনিম্ন অংশ পান। কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ঘাটতি থাকায় প্রতিবছর ২৫-৩০ শতাংশ কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। যদি কার্যকর কৃষি বিমা ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে কৃষকেরা উৎপাদনে ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন।

কৃষির ভবিষ্যৎ এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রিসিশন ফার্মিং, স্মার্ট গ্রিনহাউস, ড্রোন ডেলিভারি সিস্টেম, বায়োইনফরমেটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক কৃষিনীতির ধারণাগুলো আগামী দিনের কৃষিকে পুনর্গঠন করবে। বিশ্ব কৃষি বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হলে এই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিবিপ্লবকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। পাশাপাশি, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ‘কৃষক থেকে ভোক্তা’ সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাঁদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।

গোলাম মর্তুজা সেলিম, কৃষি সংগঠক ও রাজনৈতিক কর্মী
ইমেইল [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের কৃষিতে যেভাবে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে