জরাজীর্ণ ঘরে ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্ন বুনছে খুদে শিক্ষার্থীরা
Published: 6th, May 2025 GMT
জরাজীর্ণ ঘরেই স্বপ্ন বুনছে ওরা। একটি-দুটি নয়– একাধিক শ্রেণির শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে বসে আছে একটি জীর্ণ কক্ষে। ছাদের চুন খসে পড়ছে মাথার ওপর, দেয়ালের ফাটলগুলো যেন বলে দিচ্ছে– এই বিদ্যালয় আর নিরাপদ নয় তোমাদের জন্য। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে স্কুলে আসছে, অভিভাবকরা থাকছেন উদ্বেগে।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে মেরামতের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেক অভিভাবক বাধ্য
হয়ে সন্তানদের দূরের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছেন। এতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে যেমন ভোগান্তি বাড়ছে, তেমনি ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।
এই চিত্র বাঞ্ছারামপুরের নগরী চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, শিক্ষক সংকট ও নিরাপত্তার অভাবে বিদ্যালয়ে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। এই অবস্থায় শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
প্রতিদিন কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, চোখে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে স্কুলে আসে একঝাঁক শিশু। কিন্তু তাদের স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে জরাজীর্ণ ভবনের কারণে। বিদ্যালয়ের ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা প্রতিনিয়ত খসে পড়ছে। শিশুদের মুখে হাসির বদলে ফুটে উঠছে আতঙ্ক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০ সালে। বর্তমানে এখানে রয়েছে ১৩৯ শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচটি পদ রয়েছে শিক্ষকের।
তবে কর্মরত রয়েছেন মাত্র তিনজন। শিক্ষক সংকট থাকলেও সেখানে শূন্যপদে শিক্ষক পদায়ন করা হয়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটি দুই তলাবিশিষ্ট। নিচতলার দুটি কক্ষ ব্যবহারের অনুপযোগী। ওপরতলার দুটি কক্ষের অবস্থা ভালো নয়। তার পরও একটিতে অফিস, অন্যটিতে একযোগে একাধিক শ্রেণির শিক্ষাথীদের পাঠদান চলছে। এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী। অথচ সেখানে একটি কক্ষে বসে আছে ৯০ থেকে ১০০ জনেরও বেশি। ঘামে ভেজা গায়ে, পায়ের নিচে ধুলো আর মাথার ওপরে পলেস্তারা খসে পড়ার ঝুঁকি– এই তো তাদের প্রতিদিনের স্কুলজীবন।
অনেক অভিভাবক বুকে কষ্ট চেপে সন্তানকে দূরের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, কেউ আবার দারিদ্র্যের কারণে পারছেন না। অভিভাবক সালেহা বেগম বলেন, ‘সকালবেলা সন্তানকে স্কুলে পাঠাই; কিন্তু সারাদিন মনে ভয়– কে জানে ও ঠিকমতো ফিরে আসবে কিনা।’
অভিভাবক শিরিনা আক্তার জানান, তাঁর মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাকে স্কুলে পাঠিয়ে সারাদিন দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। মাসখানেক আগে তো এক ছাত্রের ওপর পলেস্তারা খসে পড়েছিল। তাঁর
মেয়ে খুব ভয় পেয়েছে। তাই এখন ভাবছেন মেয়েকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাবেন। যদিও দূরে যেতে কষ্ট হবে। কিন্তু সন্তানের জীবন তো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রাখা যায় না।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিনা আক্তার জানায়, এ বছর থেকে বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হবে; কিন্তু শ্রেণিকক্ষের কারণে ঠিকভাবে পড়ালেখা করতে পারছে না তারা। তাদের বিদ্যালয় অনেক দিন ধরেই শ্রেণিকক্ষের সংকট। পুরোনো ভবনে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে। মাথার ওপর ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে একজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ভয় লাগে কখন যেন মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ে।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার বলে, ‘স্কুলে ক্লাস করার সময় ভয়ে থাকি কখন মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ে। একই কক্ষে গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হচ্ছে। আমরা নতুন একটা স্কুলভবন চাই, যেখানে ভালোভাবে পড়তে পারব।’
প্রধান শিক্ষক শাহ আলীর ভাষ্য, বিদ্যালয়টি প্রায় ৮০ বছরের পুরোনো। মাত্র তিনজন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকবার লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো সংস্কার কিংবা নতুন ভবন হয়নি। তিনি বলেন, ‘ছাদে ফাটল, দেয়ালে চিড়– সবই চোখের সামনে। প্রতিদিন ভয় নিয়ে ক্লাস নিই। শিক্ষক হিসেবে এটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টের। আমরা চাই, দ্রুত একটি নিরাপদ ভবন তৈরি হোক, যাতে শিক্ষার্থীরা অন্তত জীবনের ঝুঁকি ছাড়া পড়াশোনা করতে পারে।’
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল আজিজ জানান, বিদ্যালয়টির সমস্যাগুলো তাদের নজরে আছে। নতুন ভবনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। শিক্ষক সংকটের বিষয়ে ডিপিও অফিসে কথা বলে একজন শিক্ষককে প্রেষণে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম থ র ওপর জন শ ক ষ পল স ত র
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাবিতে ‘হাসিনার পলায়নের’ বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন দলের কর্মসূচি
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের অবসান এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়নের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে র্যালি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘সাদা দল’ ও শাখা ছাত্রশিবির।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) দুপুর পৌনে ১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে র্যালিটি শুরু করে সাদা দল। পরে রাজু ভাস্কর্য ঘুরে ভিসি চত্বরে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
এর আগে, জুলাই অভ্যুত্থান ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুর্ঘটনায় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় ঢাবির কলা অনুষদের ডিন ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, “গত বছর এই দিনে ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কারফিউ ভেঙে দাঁড়িয়েছিলাম। শহীদদের স্বপ্ন পূরণের অংশ হিসেবেই আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে। ঢাবি শিক্ষকরা অতীতের মত ভবিষ্যতেও এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আশা করছি, অচিরেই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তারাই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রুখে দেবে।”
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবিএম ওবাইদুল ইসলাম বলেন, “গত বছর ৫ আগস্ট দীর্ঘ ১৭ বছরের দুঃশাসনের পর শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণের আন্দোলনের মুখে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন কারফিউ উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। এর পেছনে রয়েছে জুলাই আন্দোলন ও গত ১৬ বছরের শহীদদের রক্ত, নিপীড়ন ও গুম-খুনের ইতিহাস। তাই বিজয়ের দিন হিসেবে উদযাপনের পাশপাশি স্মরণ করছি আন্দোলনের শহীদদের। আমাদের আনন্দের মাঝেই রয়েছে তাদের ত্যাগের ইতিহাস।”
তিনি বলেন, “৫ আগস্টের বিজয় ছিল অভ্যন্তরীণ এক ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, যেখানে সরকার নিজ দেশের জনগণের ওপরই দমন চালিয়েছে। এই নিন্দনীয় দমননীতির দ্রুত বিচার আমরা দাবি করছি। বিচার বিলম্ব মানেই অন্যায়কে উৎসাহ দেওয়া, সমাজে অন্যায়কে স্থায়ী করে তোলা।”
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই দিনটিকে আমরা শুধু বিজয় নয়, গণতন্ত্র ও জনগণের শক্তির প্রতীক হিসেবেও স্মরণ করি। যখনই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে, তখনই আমরা সাধারণ ছাত্র-জনতার পাশে থাকব।”
ঢাবি কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম একটি বৈষম্যহীন ও ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে। আশা করছি এখন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ পাবো। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মালিকানা চলে গিয়েছিল অল্প কয়েকজন মানুষের হাতে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা চাই, ২০২৪ সালের আন্দোলনেও যেন একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয়।”
সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, “গত ১৬-১৭ বছর ধরে দেশকে জিম্মি করে রেখেছিল স্বৈরাচার হাসিনা সরকার। এই সময়ের মধ্যে অসংখ্য জীবন ধ্বংস করেছে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই-আগস্টে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। হেলিকপ্টার থেকে শিশুদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। এই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিল, শুধু বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্য।”
ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, “দেশের দু-এক জায়গায় বিচারের কিছু উদ্যোগ আছে। ঢাবিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটোয়া বাহিনী ও দোসর শিক্ষকদের এখন পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়নি। অবিলম্বে যারা ফ্যাসিবাদীদের হাতকে শক্তিশালী করার কাজ করেছেন, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যারা দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন, তাদের ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
এদিকে, ‘ফতহে গণভবন সাইকেল র্যালি’ শীর্ষক গণভবন অভিমুখে সাইকেল র্যালি করেছে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবির। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় টিএসসি থেকে শুরু করে শাহবাগ,কাওরান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি হয়ে গণভবনের সামনের সড়কে পৌঁছায়। সেখান থেকে র্যালিটি আবার রওনা দিয়ে আসাদগেট, ধানমন্ডি, সাইন্সল্যাব, নীলক্ষেত হয়ে টিএসসিতে এসে শেষ হয়। পুরো পথজুড়ে সাইকেল শোভাযাত্রায় সুশৃঙ্খল, প্রাণবন্ত এবং ব্যতিক্রমী স্লোগান দেখা যায়, যা গণতন্ত্র ও মুক্তির আহ্বানকে তুলে ধরে।
র্যালিতে উপস্থিত ছিলেন, শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম, ছাত্র অধিকার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম, ঢাবি শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ, সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী।
র্যালির শুরুতে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বিশেষ টিশার্ট বিতরণ করা হয়, যাতে লেখা ছিল-‘৩৬ শে জুলাই, আমরা থামব না’। বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের পতাকাও ছিল সবার সাইকেলে সাইকেলে।
র্যালি শেষে টিএসসিতে উপস্থিত সবাইকে প্রাতঃরাশ সরবরাহ করা হয় এবং সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাপনী বক্তব্যে ছাত্রশিবিরের নেতারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে অধিকার সচেতন, নৈতিক এবং গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সাহসী সৈনিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান জানান।
এ সময় নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, “আজ থেকে ১ বছর আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছিলেন দেশের আপামর জনগণ। আজকের র্যালির মাধ্যমে আমরা সেই বিজয়ের চেতনা ও অঙ্গীকারকে নতুনভাবে ধারণ করছি। ছাত্রসমাজের শক্তিই ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের মূল চালিকাশক্তি।”
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী