আগামী মাসে ঘোষিত হবে নতুন অর্থবছরের বাজেট। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার জাতীয় বাজেট নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারে করনীতি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি, এলডিসি থেকে উত্তরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেসবাহুল হক 

সমকাল: বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটের মূল দর্শন কী হওয়া উচিত?

জাভেদ আখতার : আমরা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ করতে যাচ্ছি। এর সঙ্গে আমদানি শুল্ক কমানো, সার্বিক কর কঠামো এবং শ্রম কমপ্লায়েন্স ইস্যু জড়িত। দিনশেষে ভালো নীতি এবং প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে আমাদের বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে কর কিংবা এলডিসি নীতির বিষয়গুলো একটি বাজেটে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে আগামীতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, নতুন বাজেটে তার একটি রোডম্যাপ দেওয়া উচিত। 

সমকাল : বাজেটের মাধ্যমে কর ব্যবস্থাপনায় কী কী পরিবর্তন চান?

জাভেদ আখতার : রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ভ্যাটের বিষয়টি আরও সহজ করতে হবে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, কাস্টমস শুধু কর আহরণ করবে। কিন্তু আসলে কাস্টমসকে কর আহরণের পাশাপাশি সহায়তাকারী হিসেবে তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। তিন শাখাকে একসঙ্গে কাজ করার জন্য একটি সমন্বিত ডিজিটাল তথ্য নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে এসব বিভাগের কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যে তেমন কথা হয় না। তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাই জটিলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্বও আসে না। সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে আরও বেশি রাজস্ব আহরণের সুযোগ রয়েছে। 

 সমকাল : ব্যক্তি ও কোম্পানি আয়করের ক্ষেত্রে আপনার সুনির্দাষ্ট প্রস্তাব কী কী?

জাভেদ আখতার : দেশি-বিদেশি যে কোনো উদ্যোক্তার জন্য কার্যকর কর হার বাংলাদেশে বড় চ্যালেঞ্জ, যা কমিয়ে আনতে হবে। বিদ্যমান করপোরেট কর হারে নানা শর্তের সঙ্গে ক্যাশলেস লেনদেনের বিষয়টিও রয়েছে। কিন্তু বর্তমান দেশের সার্বিক অবকাঠামো এর জন্য উপযোগী নয়। এমনকি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারকে ভ্যাটও দেওয়া যায় না। তাই ক্যাশ লেনদেনের সীমা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া ব্যক্তি করের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে। 

সমকাল : আমদানি শুল্ক এবং ভ্যাটের ক্ষেত্রে কোন কোন পদক্ষেপ নিলে তা একই সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে?

জাভেদ আখতার : আমদানি শুল্কের পরও বাড়তি সম্পূরক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়। এগুলো কমিয়ে আনতে হবে। অনেক সময় শুল্কায়নের ক্ষেত্রে মধ্যম পর্যায়ের পণ্যকে চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে ব্যবসায় খরচ বেড়ে যায়। তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন হারে ভ্যাট রয়েছে। ২০১২ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে একটি আদর্শ হার হলে আদায় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে। চূড়ান্ত হিসাবে ভোক্তাকেও কম ভ্যাট দিতে হবে। এতে ভ্যাট আদায় যেমন বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাবেন। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য বিলাসী পণ্যে আরও কর বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে করের আওতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় অটোমশনের বিকল্প নেই।

সমকাল : বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত?

জাভেদ আখতার : বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের হার খুবই কম। অনেক বছর ধরেই এ ধারা অব্যাহত। দুয়েক বছর ছাড়া প্রায় সব সময়ই বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ১ শতাংশের নিচে। এমন কি, পাকিস্তানের চেয়েও কম বিদেশি বিনিয়োগ আসে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রধান কাজ হবে দেশ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা। একই সঙ্গে নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে খুব ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন হয়। এখানে বিরোধ নিষ্পত্তি করা কঠিন, যা নিয়ে উদ্যোক্তাদের অনেক ভুগতে হয়। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, ট্রেডমার্ক– এসব বিষয়ে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন খুবই দুর্বল। অনেক সময় কোম্পানিগুলোকে আগের বছরের হিসাব শেষ করার পরও অতিরিক্ত কর প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের নিয়ম নেই। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার বিনিয়োগের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

সমকাল : সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলেন আয়োজন করে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। আপনার মতে প্রধান করণীয় কী?

জাভেদ আখতার : এত বড় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশটা ঠিক আছে কিনা, তা বহির্বিশ্বকে জানানোর জন্য বিনিয়োগ সম্মেলন দরকার ছিল। তবে একটা সম্মেলন থেকে তো আর সব বিনিয়োগ আসে না। বেশি সম্ভাবনা আছে এমন খাত ধরে ধরে উদ্যোক্তাদের নিয়ে আসতে হবে। তবে নীতির ধারাবাহিকতা নিয়ে আমদের বেশ দুর্নাম রয়েছে। গত বছর বেপজাতে বিনিয়োগে কিছু সুবিধা হঠাৎ বাতিল করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। এনবিআরের নীতি এবং কর আহরণে যে আলাদা সংস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে একটি কোম্পানি খুলতে প্রায় ১৪০টি বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। দুনিয়ার কোথাও এত জটিলতা নেই। দুবাইয়ে ১৫ মিনিটে যে কেউ কোম্পানি খুলতে পারে। বাংলাদেশে কেউ ১৫ মাসে খুলতে পারলে, সে খুব সৌভাগ্যবান। বুঝতে হবে, বাংলাদেশ একমাত্র বিদেশি বিনিয়োগ গন্তব্য নয়। উদ্যোক্তারা যদি এসে দেখেন এত জটিলতা, তাহলে বিনিয়োগ আসবে কীভাবে। বর্তমান সরকারের মাধ্যমেই এসব কাঠামোগত সংস্কার করা সম্ভব, যাতে পরবর্তী সময়ে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা যেন এগুলো অব্যাহত রাখে। 

সমকাল : বিভিন্ন ফোরামে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বালানিকে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় আপনার পরামর্শ কী?

জাভেদ আখতার : বিনিয়োগের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। একটি দেশে টেকসই জ্বালানি নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে কত কলকারখানা আছে এবং কী পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন, তা সরকারের জানা। বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে তার পরও যত দ্রুত সম্ভব জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। একজন স্থানীয় উদ্যোক্তা হয়তো জ্বালানি না পেলেও কিছুদিন অপেক্ষা করবেন, কিন্তু বিদেশি উদ্যোক্তা এ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করবেন না। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ভ দ আখত র সরক র র পদক ষ প র জন য ব যবস সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

এনবিআরের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা

আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান।

আজ দুপুরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ২২ জুন থেকে আবার আন্দোলন শুরু করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। টানা তৃতীয় দিনের মতো আজ বুধবারও এনবিআরসহ সারা দেশে শুল্ক-কর কার্যালয়ের কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার প্রত্যাশা করে, এই আলোচনার (২৬ জুন) মাধ্যমে সব ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হয়ে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা সম্ভব হবে। এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে যাঁর যাঁর দপ্তরে অবস্থান করে অর্থবছরের শেষ কর্মদিবসগুলোয় রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে মনোনিবেশ করার জন্য অর্থ উপদেষ্টা অনুরোধ করছেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী সংগঠন, অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন সহযোগীরা রাজস্ব কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়নের কাজ পৃথক্‌করণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে গত বছরের ৯ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার বিষয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। ওই পরামর্শক কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ১৬ জানুয়ারি উপদেষ্টা রাজস্ব আহরণে দুটি কার্যক্রম পৃথক করার বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাঁদের নিজ নিজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের তত্ত্বাবধানে অন্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ওই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ মে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ১৩ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঘণ্টাব্যাপী সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজস্ব সংস্কার কমিটিসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার পর তা বাস্তবায়ন করা হবে। এরপরও আন্দোলন চলমান থাকায় গত ২৫ মে অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। এরপর আন্দোলনকারীরা তাঁদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এনবিআরের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা