আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের মধ্যে সমন্বয় চাই
Published: 10th, May 2025 GMT
আগামী মাসে ঘোষিত হবে নতুন অর্থবছরের বাজেট। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার জাতীয় বাজেট নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারে করনীতি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি, এলডিসি থেকে উত্তরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেসবাহুল হক
সমকাল: বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটের মূল দর্শন কী হওয়া উচিত?
জাভেদ আখতার : আমরা স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ করতে যাচ্ছি। এর সঙ্গে আমদানি শুল্ক কমানো, সার্বিক কর কঠামো এবং শ্রম কমপ্লায়েন্স ইস্যু জড়িত। দিনশেষে ভালো নীতি এবং প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে আমাদের বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে কর কিংবা এলডিসি নীতির বিষয়গুলো একটি বাজেটে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে আগামীতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, নতুন বাজেটে তার একটি রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।
সমকাল : বাজেটের মাধ্যমে কর ব্যবস্থাপনায় কী কী পরিবর্তন চান?
জাভেদ আখতার : রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ভ্যাটের বিষয়টি আরও সহজ করতে হবে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, কাস্টমস শুধু কর আহরণ করবে। কিন্তু আসলে কাস্টমসকে কর আহরণের পাশাপাশি সহায়তাকারী হিসেবে তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। তিন শাখাকে একসঙ্গে কাজ করার জন্য একটি সমন্বিত ডিজিটাল তথ্য নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে এসব বিভাগের কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যে তেমন কথা হয় না। তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাই জটিলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্বও আসে না। সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে আরও বেশি রাজস্ব আহরণের সুযোগ রয়েছে।
সমকাল : ব্যক্তি ও কোম্পানি আয়করের ক্ষেত্রে আপনার সুনির্দাষ্ট প্রস্তাব কী কী?
জাভেদ আখতার : দেশি-বিদেশি যে কোনো উদ্যোক্তার জন্য কার্যকর কর হার বাংলাদেশে বড় চ্যালেঞ্জ, যা কমিয়ে আনতে হবে। বিদ্যমান করপোরেট কর হারে নানা শর্তের সঙ্গে ক্যাশলেস লেনদেনের বিষয়টিও রয়েছে। কিন্তু বর্তমান দেশের সার্বিক অবকাঠামো এর জন্য উপযোগী নয়। এমনকি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারকে ভ্যাটও দেওয়া যায় না। তাই ক্যাশ লেনদেনের সীমা বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া ব্যক্তি করের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে।
সমকাল : আমদানি শুল্ক এবং ভ্যাটের ক্ষেত্রে কোন কোন পদক্ষেপ নিলে তা একই সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে?
জাভেদ আখতার : আমদানি শুল্কের পরও বাড়তি সম্পূরক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়। এগুলো কমিয়ে আনতে হবে। অনেক সময় শুল্কায়নের ক্ষেত্রে মধ্যম পর্যায়ের পণ্যকে চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে ব্যবসায় খরচ বেড়ে যায়। তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন হারে ভ্যাট রয়েছে। ২০১২ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে একটি আদর্শ হার হলে আদায় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে। চূড়ান্ত হিসাবে ভোক্তাকেও কম ভ্যাট দিতে হবে। এতে ভ্যাট আদায় যেমন বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাবেন। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য বিলাসী পণ্যে আরও কর বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে করের আওতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় অটোমশনের বিকল্প নেই।
সমকাল : বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজেট কেমন হওয়া উচিত?
জাভেদ আখতার : বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের হার খুবই কম। অনেক বছর ধরেই এ ধারা অব্যাহত। দুয়েক বছর ছাড়া প্রায় সব সময়ই বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ১ শতাংশের নিচে। এমন কি, পাকিস্তানের চেয়েও কম বিদেশি বিনিয়োগ আসে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রধান কাজ হবে দেশ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা। একই সঙ্গে নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে খুব ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন হয়। এখানে বিরোধ নিষ্পত্তি করা কঠিন, যা নিয়ে উদ্যোক্তাদের অনেক ভুগতে হয়। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, ট্রেডমার্ক– এসব বিষয়ে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন খুবই দুর্বল। অনেক সময় কোম্পানিগুলোকে আগের বছরের হিসাব শেষ করার পরও অতিরিক্ত কর প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের নিয়ম নেই। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার বিনিয়োগের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল : সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলেন আয়োজন করে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। আপনার মতে প্রধান করণীয় কী?
জাভেদ আখতার : এত বড় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশটা ঠিক আছে কিনা, তা বহির্বিশ্বকে জানানোর জন্য বিনিয়োগ সম্মেলন দরকার ছিল। তবে একটা সম্মেলন থেকে তো আর সব বিনিয়োগ আসে না। বেশি সম্ভাবনা আছে এমন খাত ধরে ধরে উদ্যোক্তাদের নিয়ে আসতে হবে। তবে নীতির ধারাবাহিকতা নিয়ে আমদের বেশ দুর্নাম রয়েছে। গত বছর বেপজাতে বিনিয়োগে কিছু সুবিধা হঠাৎ বাতিল করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। এনবিআরের নীতি এবং কর আহরণে যে আলাদা সংস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে একটি কোম্পানি খুলতে প্রায় ১৪০টি বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। দুনিয়ার কোথাও এত জটিলতা নেই। দুবাইয়ে ১৫ মিনিটে যে কেউ কোম্পানি খুলতে পারে। বাংলাদেশে কেউ ১৫ মাসে খুলতে পারলে, সে খুব সৌভাগ্যবান। বুঝতে হবে, বাংলাদেশ একমাত্র বিদেশি বিনিয়োগ গন্তব্য নয়। উদ্যোক্তারা যদি এসে দেখেন এত জটিলতা, তাহলে বিনিয়োগ আসবে কীভাবে। বর্তমান সরকারের মাধ্যমেই এসব কাঠামোগত সংস্কার করা সম্ভব, যাতে পরবর্তী সময়ে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা যেন এগুলো অব্যাহত রাখে।
সমকাল : বিভিন্ন ফোরামে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বালানিকে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় আপনার পরামর্শ কী?
জাভেদ আখতার : বিনিয়োগের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। একটি দেশে টেকসই জ্বালানি নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে কত কলকারখানা আছে এবং কী পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন, তা সরকারের জানা। বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে তার পরও যত দ্রুত সম্ভব জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। একজন স্থানীয় উদ্যোক্তা হয়তো জ্বালানি না পেলেও কিছুদিন অপেক্ষা করবেন, কিন্তু বিদেশি উদ্যোক্তা এ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করবেন না।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ভ দ আখত র সরক র র পদক ষ প র জন য ব যবস সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
৯ মাসে এনবিআরের সাড়ে ১৬ হাজার অভিযান, আদায় ৯৯৪ কোটি টাকা
রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদঘাটন করতে গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত নয় মাসে সাড়ে ১৬ হাজার অভিযান পরিচালনা করেছে। যার মাধ্যমে আদায় হয়েছে ৯৯৪ কোটি টাকা। মঙ্গলবার এনবিআরের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য দেওয়া হয়।
সেখানে বলা হয়, সেপ্টেম্বর-মে সময়ে এনবিআরের দুই অনুবিভাগের (কাস্টমস ও আয়কর) মাঠ পর্যায়ের দপ্তর এবং গোয়েন্দা ইউনিটগুলো মোট ১৬ হাজার ৫৭২টি কর বা রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব ঘটনায় ৬ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে এনবিআর বলছে, এর মধ্যে ৯৯৪ কোটি টাকা আদায় করা গেছে।
এই সময়ে বিভিন্ন কাস্টম হাউজ মোট ২ হাজার ২১৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে; যাতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৮৩ কোটি টাকা। এর পুরোটাই আদায় করার কথা বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
এছাড়া বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেট মোট ৬ হাজার ৮০৩টি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে, যাতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৫১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট ৮৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।
ভ্যাট গোয়েন্দা ২৩১টি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান চালিয়েছে। এসব ঘটনায় ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছিল, আদায় হয়েছে মোট ২৪০ কোটি টাকা।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এ সময়ে রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করে মোট ৭৩ (তিয়াত্তর) কোটি টাকা আদায় করেছে।
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) ১৮১টি অভিযানে আদায় করেছে ১৯৪ কোটি টাকা।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট মোট ১৭০টি কর ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান চালায়। এসব অভিযানে ১১০ কোটি টাকা আদায় করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন কর অঞ্চল (৪১টি) মোট ৬ হাজার ৯৭২টি কর ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। আদায় হয়েছে ১০৫ কোটি টাকার রাজস্ব।