জেলা নয়, উপজেলা শহর থেকেও ১১ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের একটি বিদ্যালয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ৩৫ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু। ১১ বছরের ব্যবধানে সেই বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩২০। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী আট শ্রেণিকক্ষের স্থানে রয়েছে পাঁচটি। এখনও অপূর্ণাঙ্গ অবকাঠামোসহ নানা সংকটে চলছে বিদ্যালয়টি। যেখানে সহকারী শিক্ষক থাকার কথা আট, সেখানে রয়েছেন পাঁচজন। এত সংকটের মধ্যেও দেশসেরা হয়েছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
গত ১০ মে প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২৪-এর অনুষ্ঠানে দেশের সেরা স্কুল হিসেবে এ বিদ্যালয়কে পুরস্কৃত করা হয়। সুব্রত খাজাঞ্চী বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করলে যে কারও মনে হতে পারে অন্যরকম বিদ্যালয়। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে দৃষ্টি কাড়বে সুন্দর মাঠ ও হরেক রকম ফুল, ফল ও পাতাবাহার গাছের সৌন্দর্য। শিশুদের জন্য রয়েছে দোলনা, স্লিপার, অক্ষরগাছসহ নানা কিছু। আছে বিশ্রাম নেওয়ার শেড। রয়েছে ছাদবাগান ও সততা স্টোর। ভেতরের প্রতিটি কক্ষে রঙের মাধ্যমে শিক্ষামূলক ছবি আঁকা।
এই ভবনের ওপরে ছাদবাগান। যেখানে রয়েছে আঙুর, কমলা, আম, লেবুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। এক পাশে মুক্তমঞ্চ, যেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে।
একতলা ভবনের পেছনে রয়েছে আরও দুটি টিনশেডের শ্রেণিকক্ষ ও সামনে মাঠ। মাঠের চারপাশে প্রাচীরে আঁকা রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছবিযুক্ত বিভিন্ন শিক্ষামূলক বাণী। বিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রাচীরেই রয়েছে এমন আর্ট। জাতীয় সংসদ, জাতীয় ফুল, ফল, পাখি, বই ও পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং জ্ঞান আহরণের অনেক কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিদ্যালয়ের দেয়াল ও প্রাচীরগুলোতে।
গত সোমবার যখন বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করা হয়, তখন ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১১টা। বিদ্যালয়ে তখন পরীক্ষা চলছিল। দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রথম শিফট ও দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষার্থীদের পিটির জন্য ডাকা হয় মাঠে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ শেষে জাতীয় সংগীত ও শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। করানো হয় নৃত্য ও গান পরিবেশন। এর পর প্রধান শিক্ষক মাইকে ঘোষণা দেন যে, এই বিদ্যালয় দেশসেরা পুরস্কার পেয়েছে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে করতালির শব্দে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ।
বিদ্যালয়টির প্রথম শ্রেণিতে দেখা যায়, মেঝের মধ্যে গোল করে তিনজন শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন শিশুদের। কখনও আদর করে, কখনও গল্পের ছলে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে মজা করে জোড় ও বিজোড় শেখাচ্ছেন গণিত শিক্ষক। তারা জানান, এই বিদ্যালয়ের মূলমন্ত্রই হলো মজার ছলে শেখানো, যাতে স্কুলকে কেউ বোঝা না মনে করে।
অভিভাবকরা বলেছেন, এই বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ এতটাই বেশি যে, সকাল হলেই সন্তানরা অপেক্ষায় থাকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী বায়েজিদ ইসলাম বলে, স্কুলে আসতে খুব ভালো লাগে। খেলাধুলা, গান, নাচ, বিতর্ক– অনেক কিছু শিখতে পারি।
সহকারী শিক্ষক শাহীন আক্তার বলেন, আমাদের শিক্ষা শুধুই পড়ালেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ ছাড়া উৎসাহ বাড়াতে আমরা পুরস্কৃত করি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জগদীশ রায় বলেন, প্রথমে চারটি টেবিল, ছয়টি চেয়ার, ৬০ জোড়া বেঞ্চ ছাড়া বিদ্যালয়ে কিছুই ছিল না। সাহায্যের জন্য সবার দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। স্থানীয় লোকজন এগিয়ে না এলে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারতাম না। তিনি বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থী অনুযায়ী শিক্ষক কম, শ্রেণিকক্ষের সংকট। যদি এসব সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়, তাহলে আমরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারব।
চিরিরবন্দর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোছা.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর
বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।
এন্নিও মোররিকোনে (১০ নভেম্বর ১৯২৮—৬ জুলাই ২০২০)