আলোকিত হয়ে উঠেছে মঞ্চ। মানুষ ছুটছে। তারা জানে না কোথায় তাদের গন্তব্য। তারা বিশ্বাস করে প্রশ্ন নয়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছুটে চলাই তাদের একমাত্র কাজ। তাদের ভাবনায় এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা, যারা তাদের বশে রেখে শাসন-শোষণ জিইয়ে রাখে। তারা প্রভু। তারা ভাবে দেশের মানুষ সবাই তাদের দাস। মঞ্চে ঘটনা ঘটে প্যান্টোমাইমে। ততক্ষণ পর্যন্ত দাস মানসিকতার মানুষগুলো ছুটতে থাকে যতক্ষণ হিমশীতল মৃত্যু তাদের স্পর্শ না করে। বেশির ভাগ মৃত্যু আসে অত্যাচার-নির্যাতনে। শুরু হয় এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চনাটক ‘ক্রীতদাস কথা’। চীনের আধুনিক সাহিত্যের জনক লু স্যুন একশ বছর আগে লিখেছেন সমাজ বাস্তবতার নগ্ন নিরেট সত্য নিয়ে অসাধারণ এক ছোটগল্প ‘দ্য ওয়াইজ, দ্য ফুল অ্যান্ড দ্য স্লেভ’। বাংলায় তার নাট্যরূপ দিয়েছেন অমল রায়। নাম রেখেছেন ‘ক্রীতদাস কথা’। সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘ক্রীতদাস কথা’ মঞ্চস্থ করেছে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও নির্দেশনা শাহীন রহমান।
নাটকে ডাইমেনশন আছে একাধিক। নাটকে উপস্থাপিত হয়েছে কীভাবে মানুষের ভাবনায় দাস মানসিকতা জিইয়ে রেখে শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা যায় সে কথা। দাসত্বকে যেখানে নিজ অর্জন বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। একশ বছর পরও যা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের ভাবনায় পরিবারতন্ত্র জিইয়ে রাখে শোষণ। মঞ্চে আমরা শুনি দাস মালিকের উদ্ধত উচ্চারণ, ‘আমি অথবা আমার পিতা, তার পিতা, কিংবা তার পিতা, তারও পিতা– আমাদের অধিগত বিদ্যা একটাই। কার চাবুক বাতাসে কত তীক্ষ্ণ শিস তুলে আছড়ে পড়তে পারে দাসের পিঠে।’
তারপরই পারিবারিক ধারাবাহিক ক্ষমতার দাম্ভিকতায় দাস মালিক উদ্ধত চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে থাকে, ‘কোথায় স্পাটাকাস? ভিসুভিয়াসের খোঁড়লে খোঁড়লে স্পাটাকাসরা মরে গলে পচে গেছে। কিংবা রোমের পথে পথে স্পাটাকাসদের মৃতদেহ ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আমি মালিক। ক্রেসাসের রক্ত আমার শরীরে। তোরা এক একটা স্পাটাকাস।’ এখানেই ‘ক্রীতদাস কথা’ এ সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আমরা দেখতে পাই সমসাময়িক দৃশ্যাবলি। শোষণ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে প্রয়োজন পড়ে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং নিজ মতের আধিপত্য বিস্তার। যেখানে বলপ্রয়োগ করে, দ্বিমত পোষণকারীকে ভয় দেখিয়ে কিংবা প্রতিবাদীকে হত্যা করে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের রূপ দেওয়া হয়। পৃথিবীতে একক শাসন শুধু প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকেনি। টিকে থেকেছে তার অনুগত সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করে। যা করা হয় আদর্শিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। যেখানে উন্নয়নের কথা বলা হয়। আর অনুগত বুদ্ধিজীবীরা তাদের আদর্শ বিকিয়ে দিয়ে দাসত্ব মেনে নেয়। দাস মালিকের এমন একজন অনুগত জ্ঞানী চরিত্র ‘ক্রীতদাস কথা’ নাটকেও দেখা যায়।
‘ক্রীতদাস কথা’ নাটক মঞ্চে শেষ হয় না। প্রলম্বিত হয় দর্শক মননে। নাটকের সমাপ্তি কী হবে সেই সিদ্ধান্তের ভার থাকে দর্শকের ওপর। দাসত্বকে নিজ অর্জন বলে মেনে নিয়ে আমৃত্যু নির্যাতন সহ্য করে যাওয়া, নাকি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো!
মিউজিক্যাল ড্রামার আদলে কোরাস ফর্মে নাটকের কাঠামো গড়ে উঠেছে। সেট, প্রপস, কস্টিউম নাটকের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। তবে নাটকে আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। শাস্ত্রমতে অভিনয় সম্পন্ন হয় চার প্রকৃতির মিশেলে। আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক আর আহার্য। এই নাটকে সংলাপ ছাড়া থিয়েট্রিক্যাল মোমেন্ট তৈরি করা জরুরি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন টক
এছাড়াও পড়ুন:
এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর
বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।
এন্নিও মোররিকোনে (১০ নভেম্বর ১৯২৮—৬ জুলাই ২০২০)