রাজীব গান্ধী হত্যা: পারিবারিক শাসনের অবসান ও বিজেপির উত্থান
Published: 21st, May 2025 GMT
আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরদিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘মর্মান্তিক বাঁকবদল: গান্ধী হত্যাকাণ্ডে ভারতকে গড়ে তোলা রাজনৈতিক পরিবারের নেতৃত্বের ইতি ঘটল’। রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর গান্ধী পরিবারে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না থাকার বিষয়টি এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় বছর পর রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী দলের হাল ধরেন। তাঁর হাত ধরে কংগ্রেস জোটগতভাবে একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও গান্ধী পরিবারের কেউ আর সরকারপ্রধান হননি।
রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর ভারতের ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব কমতে থাকে উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দল কংগ্রেসের। উত্থান হয় হিন্দুত্ববাদী আদর্শের দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। গত এক দশকে কংগ্রেসের নেতৃত্বসংকট আরও প্রকট হয়েছে। দৃশ্যত রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ছায়া থেকে দলটি বের হতে পারেনি। ১৯৯১ সালের ২১ মে চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ) নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তামিল বিদ্রোহীদের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন তিনি।
ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী
১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট মুম্বাইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) জন্ম নেন রাজীব গান্ধী। নানা জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হলে পরিবার লক্ষ্ণৌ থেকে দিল্লি চলে আসে। স্কুলজীবন শেষে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ এবং কিছুদিন পরে ইম্পেরিয়াল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি যন্ত্রকৌশলে পড়াশোনা করেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও রাজনীতির প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না রাজীবের।
পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরেই বাণিজ্যিক পাইলটের লাইসেন্স নেন রাজীব। পরে ভারতের রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে পাইলট হিসেবে চাকরি নেন। কেমব্রিজে পড়াশোনার সময় রাজীবের পরিচয় হয় ইতালি বংশোদ্ভূত সোনিয়া ম্যাইনোরের সঙ্গে। পরে ১৯৬৮ সালে তাঁরা দিল্লিতে বিয়ে করেন। দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে রাজীব মা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে থাকতেন।
ভাই সঞ্জয় গান্ধী বেঁচে থাকতে কখনো রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষেননি রাজীব। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় ভাই নিহত হলে মা ইন্দিরা গান্ধী এবং নানামুখী চাপে তাঁকে মনোভাব পাল্টাতে হয়। পরের বছরের জুনে উত্তর প্রদেশের আমেথি থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে লোকসভায় আসেন। একই সময়ে তিনি কংগ্রেসের যুব সংগঠন ইন্ডিয়ান যুব কংগ্রেসের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন।
পাঞ্জাবের খালিস্তানপন্থী আন্দোলন দমনে কঠোর ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনকারীদের নেতা ভিন্দ্রানওয়ালেসহ তাঁর অনুসারীদের ধরতে শিখদের পবিত্র স্থান গোল্ডেন টেম্পলে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তে শিখ সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। মায়ের মরদেহ রেখে ওই দিনই রাজীব গান্ধীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে শপথ নিতে হয়েছিল। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। এখন পর্যন্ত তিনি ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।
উদারতার সুযোগ নিয়ে যেভাবে হত্যা
মা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর মাত্র সাত বছর পর একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল ছেলে রাজীব গান্ধীকে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগার বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত জাফনা অঞ্চলে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইপিকেএফ) পাঠিয়েছিল তাঁর সরকার। কিন্তু তাঁর এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি তামিলরা। ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তামিলদের আত্মঘাতী বোমায় প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
সরকারের নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন রাজীব গান্ধী। ওই বছর অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হয়। তিনি হন লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা। তবে ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বেশি দিন স্থিতিশীল হতে পারেনি। ১৯৯১ সালে সেই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়।
চেন্নাইয়ে সেই সমাবেশে সমর্থকদের সঙ্গে রাজীব গান্ধী। এখানেই একটু পর বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইন দ র হয় ছ ল র জন ত পর ব র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই
অমাবস্যা ও সমুদ্রের নিম্নচাপ একই সময় হওয়ার কারণে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সেখানকার জনজীবনে দুর্ভোগ ও ক্ষতির পরিমাপ এতটা বেশি যে অনুমান করাও কঠিন।
প্রতিবছর বর্ষায় মোটামুটি দু-তিনটি ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। এত তাণ্ডব কখনো দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
২৬ ও ২৭ জুলাই সমুদ্রের নিষ্ঠুর লীলাখেলা দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বীপের প্রায় চারপাশ থেকে হু হু করে ঢুকেছে সমুদ্রের পানি। অনেক দিন এমন পানির তোড় দেখেননি দ্বীপের মানুষ।
দ্বীপে যা সামান্য কৃষিকাজ হয়, বিশেষ করে ধান চাষ ও সবজি চাষে এবার জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়েছে। লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
সমুদ্রের পাড়ের বাড়ি ও দ্বীপের মাঝখানের নিম্নাঞ্চলে (স্থানীয় ভাষায় মরং বলে) সাগরের পানি ঢোকার কারণে অনেক এলাকায় পানি লবণাক্ত হয়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক বাড়ি ও রিসোর্ট সমুদ্রের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে।
দ্বীপে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার জলোচ্ছ্বাস পূর্ণমাত্রায় আঘাত করতে পেরেছে! ফলে পুরোপুরি অনিরাপদ দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
দ্বীপের ভাঙন শুরু মূলত ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। ওই দুই ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ আশপাশের পাথরের স্তূপ নড়বড়ে করে দেয়। ফলে দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের স্রোত সমুদ্রগর্ভের পরিবর্তে সৈকত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়।
এতে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব পাশে ব্যাপক ভাঙন হয়। উত্তর পাড়া ও ডেইল পাড়া নামের দুটি পাড়া বিলীন হয়ে যায়। বাসিন্দাদের ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গুচ্ছগ্রাম করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ অবধি দ্বীপের ভাঙন চলমান। কিন্তু কোনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার নতুন করে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণেও সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়া ঝোপ উজাড় হয়েছে। এতে দ্বীপের ঢেউ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মুরব্বিদের কথায় এবারের মতো জলোচ্ছ্বাস তাঁদের জীবনে দেখেনি। তাঁরা দ্বীপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আদৌ দ্বীপে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মনে করেন, এ রকম আর দু–তিনটি জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো শক্তি সেন্ট মাটিনের নেই। দ্রুত স্রোতপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সেন্ট মার্টিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে!
দ্বীপবাসী মনে করে, একটা টেকসই বেড়িবাঁধ যেটা সচরাচর উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের মতো না। কারণ, এখানে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে কাছিমের ডিম দিতে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সেভাবে সৈকত থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বালম্বি করে বাঁধ দিয়ে স্রোত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিতে হবে। দক্ষিণ ভারতে এ রকম বাঁধ অনেক কার্যকর প্রমাণিত।
পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের আয়ের বিকল্প কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে পর্যটননির্ভরতা কমাতে হবে। একটা আবাসন নীতিমালা করে দ্বীপে পরিবেশবান্ধব বাড়ি ও ইকো রিসোর্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। যত্রতত্র রিসোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রিসোর্ট কমিয়ে ফেলতে হবে আর যেসব রিসোর্টের বিরুদ্ধে আইনি বাধা আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।
সৈকত, জঙ্গল, খাল ও জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা ক্ষতিপূরণ হলেও সৈকতের ১০০ ফুট পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সে জমিতে বনায়ন করতে হবে। ঝাউগাছের পরিবর্তে ভাঙনপ্রতিরোধী কেয়াগাছ, নারকেল ও সাগরলতা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?
তৈয়ব উল্লাহ, আন্দোলনকর্মী ও সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা