আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরদিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘মর্মান্তিক বাঁকবদল: গান্ধী হত্যাকাণ্ডে ভারতকে গড়ে তোলা রাজনৈতিক পরিবারের নেতৃত্বের ইতি ঘটল’। রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর গান্ধী পরিবারে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না থাকার বিষয়টি এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় বছর পর রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী দলের হাল ধরেন। তাঁর হাত ধরে কংগ্রেস জোটগতভাবে একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও গান্ধী পরিবারের কেউ আর সরকারপ্রধান হননি।

রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর ভারতের ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব কমতে থাকে উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দল কংগ্রেসের। উত্থান হয় হিন্দুত্ববাদী আদর্শের দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। গত এক দশকে কংগ্রেসের নেতৃত্বসংকট আরও প্রকট হয়েছে। দৃশ্যত রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ছায়া থেকে দলটি বের হতে পারেনি। ১৯৯১ সালের ২১ মে চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ) নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তামিল বিদ্রোহীদের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন তিনি।

ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী

১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট মুম্বাইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) জন্ম নেন রাজীব গান্ধী। নানা জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হলে পরিবার লক্ষ্ণৌ থেকে দিল্লি চলে আসে। স্কুলজীবন শেষে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ এবং কিছুদিন পরে ইম্পেরিয়াল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি যন্ত্রকৌশলে পড়াশোনা করেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও রাজনীতির প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না রাজীবের।

পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরেই বাণিজ্যিক পাইলটের লাইসেন্স নেন রাজীব। পরে ভারতের রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে পাইলট হিসেবে চাকরি নেন। কেমব্রিজে পড়াশোনার সময় রাজীবের পরিচয় হয় ইতালি বংশোদ্ভূত সোনিয়া ম্যাইনোরের সঙ্গে। পরে ১৯৬৮ সালে তাঁরা দিল্লিতে বিয়ে করেন। দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে রাজীব মা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে থাকতেন।

ভাই সঞ্জয় গান্ধী বেঁচে থাকতে কখনো রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষেননি রাজীব। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় ভাই নিহত হলে মা ইন্দিরা গান্ধী এবং নানামুখী চাপে তাঁকে মনোভাব পাল্টাতে হয়। পরের বছরের জুনে উত্তর প্রদেশের আমেথি থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে লোকসভায় আসেন। একই সময়ে তিনি কংগ্রেসের যুব সংগঠন ইন্ডিয়ান যুব কংগ্রেসের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন।

পাঞ্জাবের খালিস্তানপন্থী আন্দোলন দমনে কঠোর ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনকারীদের নেতা ভিন্দ্রানওয়ালেসহ তাঁর অনুসারীদের ধরতে শিখদের পবিত্র স্থান গোল্ডেন টেম্পলে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তে শিখ সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। মায়ের মরদেহ রেখে ওই দিনই রাজীব গান্ধীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে শপথ নিতে হয়েছিল। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। এখন পর্যন্ত তিনি ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।

উদারতার সুযোগ নিয়ে যেভাবে হত্যা

মা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর মাত্র সাত বছর পর একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল ছেলে রাজীব গান্ধীকে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগার বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত জাফনা অঞ্চলে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইপিকেএফ) পাঠিয়েছিল তাঁর সরকার। কিন্তু তাঁর এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি তামিলরা। ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তামিলদের আত্মঘাতী বোমায় প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।

সরকারের নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন রাজীব গান্ধী। ওই বছর অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হয়। তিনি হন লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা। তবে ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বেশি দিন স্থিতিশীল হতে পারেনি। ১৯৯১ সালে সেই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়।

চেন্নাইয়ে সেই সমাবেশে সমর্থকদের সঙ্গে রাজীব গান্ধী। এখানেই একটু পর বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন দ র হয় ছ ল র জন ত পর ব র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজীব গান্ধী হত্যা: পারিবারিক শাসনের অবসান ও বিজেপির উত্থান

আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পরদিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘মর্মান্তিক বাঁকবদল: গান্ধী হত্যাকাণ্ডে ভারতকে গড়ে তোলা রাজনৈতিক পরিবারের নেতৃত্বের ইতি ঘটল’। রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর গান্ধী পরিবারে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না থাকার বিষয়টি এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় বছর পর রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী দলের হাল ধরেন। তাঁর হাত ধরে কংগ্রেস জোটগতভাবে একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও গান্ধী পরিবারের কেউ আর সরকারপ্রধান হননি।

রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর ভারতের ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব কমতে থাকে উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দল কংগ্রেসের। উত্থান হয় হিন্দুত্ববাদী আদর্শের দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। গত এক দশকে কংগ্রেসের নেতৃত্বসংকট আরও প্রকট হয়েছে। দৃশ্যত রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ছায়া থেকে দলটি বের হতে পারেনি। ১৯৯১ সালের ২১ মে চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ) নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তামিল বিদ্রোহীদের বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন তিনি।

ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী

১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট মুম্বাইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) জন্ম নেন রাজীব গান্ধী। নানা জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হলে পরিবার লক্ষ্ণৌ থেকে দিল্লি চলে আসে। স্কুলজীবন শেষে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ এবং কিছুদিন পরে ইম্পেরিয়াল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি যন্ত্রকৌশলে পড়াশোনা করেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও রাজনীতির প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না রাজীবের।

পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরেই বাণিজ্যিক পাইলটের লাইসেন্স নেন রাজীব। পরে ভারতের রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে পাইলট হিসেবে চাকরি নেন। কেমব্রিজে পড়াশোনার সময় রাজীবের পরিচয় হয় ইতালি বংশোদ্ভূত সোনিয়া ম্যাইনোরের সঙ্গে। পরে ১৯৬৮ সালে তাঁরা দিল্লিতে বিয়ে করেন। দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে রাজীব মা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে থাকতেন।

ভাই সঞ্জয় গান্ধী বেঁচে থাকতে কখনো রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষেননি রাজীব। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় ভাই নিহত হলে মা ইন্দিরা গান্ধী এবং নানামুখী চাপে তাঁকে মনোভাব পাল্টাতে হয়। পরের বছরের জুনে উত্তর প্রদেশের আমেথি থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে লোকসভায় আসেন। একই সময়ে তিনি কংগ্রেসের যুব সংগঠন ইন্ডিয়ান যুব কংগ্রেসের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন।

পাঞ্জাবের খালিস্তানপন্থী আন্দোলন দমনে কঠোর ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনকারীদের নেতা ভিন্দ্রানওয়ালেসহ তাঁর অনুসারীদের ধরতে শিখদের পবিত্র স্থান গোল্ডেন টেম্পলে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তে শিখ সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। মায়ের মরদেহ রেখে ওই দিনই রাজীব গান্ধীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে শপথ নিতে হয়েছিল। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। এখন পর্যন্ত তিনি ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী।

উদারতার সুযোগ নিয়ে যেভাবে হত্যা

মা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর মাত্র সাত বছর পর একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল ছেলে রাজীব গান্ধীকে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগার বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত জাফনা অঞ্চলে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইপিকেএফ) পাঠিয়েছিল তাঁর সরকার। কিন্তু তাঁর এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি তামিলরা। ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তামিলদের আত্মঘাতী বোমায় প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।

সরকারের নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করেন রাজীব গান্ধী। ওই বছর অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হয়। তিনি হন লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা। তবে ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বেশি দিন স্থিতিশীল হতে পারেনি। ১৯৯১ সালে সেই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়।

চেন্নাইয়ে সেই সমাবেশে সমর্থকদের সঙ্গে রাজীব গান্ধী। এখানেই একটু পর বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি

সম্পর্কিত নিবন্ধ