কবিকে বলা হয় দ্রষ্টা; কেননা বহুকৌণিক অবস্থান থেকে তিনি দেখেন। দেখতে দেখতেই কবি-লেখকেরা এঁকে ফেলেন ভবিষ্যতের কোনো নকশা। এ কথা কাজী নজরুল ইসলাম জানতেন; তবু তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই ভবিষ্যতের নই নবী।’ এই উক্তি ছিল মূলত ‘কৈফিয়ত’। কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে তিনি প্রবলভাবেই তাকিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন কবির বড় একটি কাজ সময়ের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করা। পৃথিবীজুড়ে থাকা বড় কবিদের লক্ষণ তেমন সত্যই হাজির করে। ভবিষ্যতের পানে চোখ তুলে বড় কবিরা বর্তমানকে বিচার করেছেন। অতীতকে পাঠ করেছেন সূক্ষ্ম সংবেদনের মারফত। আর তাই আমরা নজরুলকে দেখতে পাই সময়ের সঙ্গে বোঝাপড়ার এক নিবিড় তৎপরতায় মগ্ন হতে।
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় নজরুলকে ভাবতে হয়েছে আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে। এক দিকে তাঁর বাঙালিত্ব, অন্যদিকে তাঁর মুসলমানত্ব; একদিকে তাঁর বাংলা, অন্যদিকে তাঁর সর্বভারতীয়তা। কোন দিকে যাবেন তিনি? চল্লিশের দশকের শেষ দিকে বাংলাভাগের সম্ভাবনার কথা শুনে বিমূঢ় হয়েছিলেন তিনি। সময়ের শর্ত মেনে তিনি হয়তো কংগ্রেসি হতে পারতেন কিংবা হতে পারতেন মুসলিম লীগার। কোনোটিই তাঁকে টানেনি। মুসলমান নেতাদের ভাষ্যে নজরুল কংগ্রেসি, হিন্দু নেতাদের কাছে নজরুল মুসলিম লীগার। মুসলমানরা বলছেন ‘কাফির’, হিন্দুরা বলছেন ‘যবন’। নজরুল আদতে কী? নজরুলকে বলতে হয়েছে তিনি ‘মানুষ’; মুসলমান তাঁর পরিচয়ের আরেকটি চিহ্ন। যেমন তাঁর পরিচয়ের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি ও বাংলা। প্রশ্ন হলো, নজরুলকে কেন বারবার এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করতে হয়? কেন তাঁকে পাড়ি হতে হয় বোঝাপড়ার খেয়াঘাট?
জবাব হলো, নজরুল দাঁড়িয়েছিলেন ইতিহাসের এক প্রলয়মুহূর্তে, গঠন ও ভাঙনের কালে। তাঁকে নির্মাণ করেছে ঔপনিবেশিক ইতিহাস। সঙ্গে ছিল হিন্দুর উপেক্ষা, মুসলমানের ভ্রুকুঞ্চিত সন্দেহ; নজরুলের সাহিত্য ও চিন্তার পরিগ্রহণে দুই পক্ষের অনেকেই ছিল অনিচ্ছুক। কিন্তু বিশ শতকে আত্মসত্তার আবিষ্কারে উন্মুখ বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত নজরুলকে গুরুত্ব না দিয়ে পারেনি। আবার নতুন জাগ্রত মুসলমানের অন্দর থেকে যখন উঠে এল চড়া সুরের সাহিত্য, তখন বিস্ময় দৃষ্টিতে হিন্দুসমাজকে তাকাতে হয়েছে নজরুলের দিকে। নজরুল তাই নিজের ঐতিহাসিক অবস্থান অনুসন্ধানের সমান্তরালে খুঁজে ফিরেছেন বাঙালি ও মুসলমানের জাতিক ইতিহাস। যুগের প্রবর্তনায় ঐতিহাসিক ধাঁধার মীমাংসা তাঁকে করতেই হয়েছে।
নজরুলকে পীড়ন করেছে উপনিবেশিত ভূখণ্ডের রাজনীতি ও অসন্তোষ। নড়বড়ে হয়ে গেছে দাঁড়ানোর পাটাতন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রণকৌশল ও মতাদর্শিক পার্থক্য ফাটল ধরিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যে, সংকীর্ণতার অন্ধগলিতে আটকে পড়েছে জাতীয়তার সংজ্ঞায়ন। উচ্চকিত স্বরে নজরুল আঘাত করে গেছেন প্রতিটি পরিস্থিতিকে। কারণ, তাঁর মানবিক বাসনা বিরাজমান অন্য এক দিগন্তে। সেই দিগন্তে নজরুল স্বপ্ন দেখেন সমতা, বৈষম্যমুক্তি, লৈঙ্গিক সহাবস্থান এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। জাতীয়তাবাদের প্রতিরোধী ধরনকে তিনি স্বাগত জানান। কিন্তু অবস্থান নেন আগ্রাসী রূপের বিরুদ্ধে। তিনি তাই ফ্যাসিস্ট ও সাম্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধংদেহী মনোভঙ্গির সমালোচনা করেছেন।
ইতিহাসের সূক্ষ্মতর নিরিখ থেকে নজরুল বাংলার মুসলমানদের নিয়ে বিশেষভাবে ভেবেছেন। এই মুসলমানের সামনে আছে বাধার শত প্রাচীর—শিক্ষায় অনগ্রসরতা, সামাজিক অনুশাসনের বেড়াজাল; মুসলমান তাই পিছিয়ে আছে চাকরিতেও। নজরুল অবশ্য চাকরিমুখী নন; তিনি বলেছেন, শিক্ষা যদি হয় চাকরিনামক ‘দাসখত লিখার কায়দা-কানুন’, তাহলে ‘জাহান্নামে যাক তোমাদের এই শিক্ষাপদ্ধতি, এই শিক্ষালয়।’ কিন্তু মুসলমানকে জাগাতে চেয়েছেন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সংস্পর্শে এনে, বদলে দিতে চেয়েছেন মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রথাশাসিত চিন্তা খাত। এই ভাবনার কেন্দ্রে কাজ করেছে নজরুলের জাতিকল্পনা; মাজহাব ও মতবাদে বিভক্ত বাঙালি মুসলমানকে তিনি বাঁধতে চেয়েছেন একটি জাতির বৃন্তে।
নজরুলের প্রকল্পনায় তরুণেরা হলো ‘ভাবী নেশনের নিশানবরদার’। মুসলমানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে তিনি কল্পনা করেছেন ‘নেশন’–এর কাঠামো ধরে। সে কারণেই শান্তিনিকেতনের আদলে ‘কালচারাল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেছেন, যেখান থেকে মুসলমানের ইতিহাস, সাহিত্য, শাস্ত্র ও সভ্যতার অনুবাদ ও সম্প্রচার ঘটবে। নজরুলের এই বিবেচনাকে কেবলই ধর্মতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বলে বিবেচনা করার সুযোগ নেই, তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, তার একটি কারণ ‘রাজনৈতিক’। এ কালের পরিভাষা প্রয়োগ করে বলতে পারি, ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’। সে লক্ষ্যেই নজরুল ভেবেছিলেন সংস্কৃতিকেন্দ্রের মাধ্যমে মুসলমানের জাতীয় জীবনকে চিহ্নিত করা যাবে, ঘোচানো যাবে হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক অপরিচয়ের দূরত্ব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের বোঝাপড়ায় ধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ধর্মের সাংস্কৃতিক প্রকাশ ও অনুশীলন সম্পর্কে তিনি ছিলেন সতর্ক, যদিও অভিযোগ উঠেছিল লেখাপত্র দিয়ে ধর্মকে তিনি আঘাত করেছেন। অথচ তাঁর আঘাত ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মসম্পৃক্ত ক্ষমতার বিরুদ্ধে—যে ক্ষমতা ধর্মের অপব্যবহার করে, ধর্মকে করে তোলে শোষণের হাতিয়ার। নজরুলকে লিখতে হয়েছিল, ‘জননায়ক হইবার নেশায় হিন্দু-মুসলমান নেতাগণ আজ জনসাধারণকে কেবলই ধর্মের নামে উগ্র মদ পান করাইয়া করাইয়া মাতাল করিয়া তুলিয়াছেন।’
নজরুলকে মীমাংসা করতে হয়েছে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণির প্রশ্ন। ময়মনসিংহের নিখিল বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনী উপলক্ষে কৃষকদের উদ্দেশে নজরুল বলেছেন, ‘আপনারাই দেশের প্রাণ, দেশের আশা, দেশের ভবিষ্যৎ।’ শ্রমিকেরা ‘বিন্দু বিন্দু রক্ত দান’ করে গড়ে তুলেছে ‘হুজুরদের অট্টালিকা’; শ্রমিকদের ‘অস্থি মজ্জা ছাঁচে ঢালিয়া রৌপ্যমুদ্রা তৈরি হইতেছে’। নজরুলের কথাগুলো কবিসুলভ আলংকারিক উচ্চারণমাত্র নয়; রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে তিনি হাজির থেকেছেন বাংলার কৃষক-শ্রমিক সমাবেশে। আবার এই নজরুলকেই অবস্থান নিতে হয়েছে জাতভেদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। এর উৎসে আছে হিন্দুসমাজ, অন্যদিকে বহিরাগত ঔপনিবেশিক শক্তি। নজরুল দুই শক্তিকেই ফেলে দিয়েছেন প্রশ্নের মুখে।
স্বীকার করতে হবে যে নজরুলের সব বোঝাপড়ার কেন্দ্রে ছিল মূলত ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতা। তাঁর সমকালীন তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে যখন উপনিবেশিত বাস্তবতাকে মোটাদাগে মেনে নিয়েছেন, নজরুল তখন ঘোষণা করেছেন, ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের অধীন থাকবে না। নবীন লেখকের পক্ষ থেকে এই উচ্চারণ কতটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু নৈঃশব্দ্যের বদলে নজরুল উচ্চারণকেই বেছে নিয়েছিলেন, প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন প্রতিরোধের ভাষা।
ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে নজরুলের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কেবল বিশিষ্ট অর্থে ‘রাজনৈতিক’ নয়, নন্দনতাত্ত্বিকও। নজরুল তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন ইউরোপীয় আদলে গড়ে ওঠা আধুনিকতাবাদী সাহিত্যচিন্তাকে। আধুনিকতার নামে ‘মর্বিড’ ভাবনার পরিগ্রহণে তিনি একান্ত অনিচ্ছুক। নজরুল বরং চোখ ফেলেছেন অন্যতর উৎসে—আরব ও পারস্যের নন্দনতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে। বাঙালি সংস্কৃতির গঠন এবং বাঙালি মুসলমানের পরিগঠনে অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী উপাদান জুগিয়েছে এই দুই উৎস। নজরুল তা বুঝতে পেরেছিলেন—বিদ্যায়তনিক পরিসরে যেমন বুঝতে পেরেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো কেউ কেউ।
নজরুল হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মুসলমানের বাসনার প্রকাশ। কারও কারও দাবি ছিল নজরুল লিখবেন ইসলাম ও মুসলমানের জন্য, তাঁর লেখাকে হতে হবে ‘মুসলিম-সাহিত্য’। ১৯২৫ সালে নওরোজ পত্রিকায় নজরুলের উদ্দেশে ইব্রাহিম খাঁ একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল খানিকটা এ রকম—নজরুল এ পথে পা বাড়াননি। প্রত্যুত্তরে ১৯২৭ সালে সওগাত পত্রিকায় তিনি একটি লম্বা চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিতে উঠে এসেছে নজরুলের রাজনীতি, নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থান, এমনকি ভাষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি জানিয়েছেন, ‘সাহিত্য যদি সত্যিকার সাহিত্য হয়, তবে তা সকল জাতিরই হবে।’ ‘সাহিত্য’–এর সংজ্ঞায়নেই নজরুল খুঁজে ফিরেছেন আত্ম-অপরের সম্মিলন। তিনি ভেবে দেখেছেন, বাংলা ভাষা থেকে যদি ‘হিন্দু-ভাবধারা’ বাদ দেওয়া হয়, তাহলে এই ভাষার অর্ধেক শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। আবার হিন্দুরা যদি ‘মুসলমানি শব্দ’ দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকান, তাহলে তা–ও হয়ে উঠবে ‘অন্যায়’।
মূলত নজরুলের বাসনার জগতে বাস করে মানুষ। বোঝাপড়ার জগতেও থাকে মানবিক কল্যাণের ধারণা। নজরুলের ভাষায় তা হলো, ‘সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব’, ‘সর্বজনগণের মুক্তি’। আর তাই ধর্মের দাগ টেনে ভাষাকে তিনি আলাদা করতে পারেন না। প্রবল আবেগে তিনি ধারণ করতে পারেন আত্মপরিচয়ের বহুরৈখিক চিহ্ন। ঢাকার গণমাধ্যমে শ্যমাসংগীত, আর কলকাতার গণমাধ্যমে ইসলামি গান না বাজলেও আমরা জানি, নজরুল দুটিরই উৎসারক। তিনি তাই লিখতে পেরেছেন সাঁওতালি সুরের গান, গজল, শ্যামাসংগীত, হামদ, নাত, হিন্দুস্তানি গান। কেন লিখেছেন? নজরুল পৌঁছাতে চান জনতার বহুরৈখিক পরিচয়ের কাছে। তিনি এক, কিন্তু মিলতে চান বহুর সঙ্গে। তিনি মুসলমান, বাঙালি ও বাংলাভাষী; কিন্তু তাঁর সামনে থাকা জনতার পরিচয় বহু—শ্রেণি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষার দিক থেকে বিচিত্র; বৈচিত্র্যকে তিনি মেলাতে চান একই অঙ্গে। নারীকে তিনি গ্রহণ করেন চিরায়ত সহচর হিসেবে। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো যা করতে সক্ষম হয়নি, নজরুল তা করতে চেয়েছেন সাহিত্যিক পন্থায়। তার প্রমাণ মেলে নজরুলের সাহিত্যচিন্তায়, যার অভিমুখ ছিল জনসাহিত্যের দিকে।
সত্যিকার অর্থে নজরুলের একটি গ্রহণমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল—আমি সবার, সবাই আমার। প্রাচ্যের দার্শনিক ঐতিহ্যে এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মেলে। নজরুলের সাহিত্য, গান, চিঠিপত্রে সবাইকে নিয়ে সবার সঙ্গে মেলার স্বাক্ষর সুচিহ্নিত। বাঙালি মধ্যবিত্তের সৃষ্টিশীল, উদারনৈতিক ও বিপ্লবী অংশকে তিনি প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। এই অংশ ছিল গভীরভাবে দেশপ্রেমী ও সম্প্রদায়নিরপেক্ষ। তাঁদের জন্য নজরুল ছিলেন অক্ষয় প্রেরণা। এখানে এসে নজরুলের জাতিকল্পনা বৃহত্তর দিকে মোড় নিয়েছে। নজরুল হাজির করেছেন হিন্দু ও মুসলমানের সমন্বয়ে এক ‘মহাজাতি’ গঠনের প্রস্তাব; এর মূলে ছিল নিরঙ্কুশ দেশপ্রেম।
সে কালের পূর্ববঙ্গের মনীষীদের কেউ কেউ নজরুলের জাতীয় ভূমিকার কথা স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমান্তরালে নজরুলকে আসন দিয়ে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ লিখেছিলেন, ‘জ্বলন্ত স্বদেশ-প্রেম ছিল বলিয়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল জাতীয় কবির মর্যাদা লাভ করিয়াছেন।’
পাকিস্তানি পটভূমিতে আবদুল করিম লিখেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি-ধ্বংসের যে হীন আয়োজন নেপথ্যে চলিতেছে, তাহা ব্যর্থ করিতে পারেন কেবল আপনারাই। কারণ নির্ব্বাণোন্মুখ দীপ-শিখা আবার আপনারাই জ্বালাইতে পারেন। একটি কথা আপনারা প্রায়ই শুনিয়া থাকেন—জীবনবোধ। কিন্তু দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছবি সম্মুখে থাকিলেই শুধু জীবনবোধ জাগ্রত হইতে পারে। এই পথে অগ্রসর হইতে হইলে দেশের ও মানুষের ইতিহাস জানা দরকার। এককথায় স্বদেশ-প্রেমের মালা গাঁথিয়া গলায় পরা আবশ্যক।’ ত্রিকালের পটভূমিতে স্থির থেকেই নজরুল বাঙালির জন্য উপহার দিতে পেরেছিলেন ‘জীবনবোধ’; ওই বোধের মর্মমূল গাঁথা আছে দেশ, অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের মনোভূমিতে।
নজরুলের বিবেচনায় কোনো ফাঁক ছিল না। লেখক-বুদ্ধিজীবীর সত্যিকার কর্তব্য যা, তিনি তা-ই পালন করেছেন—ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছেন, জবাব খুঁজেছেন, বাতলে দিয়েছেন সম্ভাব্য পথের নিশানা। অর্থাৎ নজরুলকে বুঝতে হয়েছে সময়ের স্বর, বহুরৈখিক উচ্চারণের ভেতর আনতে হয়েছে ঐকতানের আবহ। সেই তান এককালে বাঙালির চৈতন্যকে সংগঠিত করেছে। এই কালেও নজরুলের সমাজ-রাজনৈতিক চৈতন্য ও ‘জীবনবোধ’–এর উপযোগিতা কমেনি।
আজকের এই ক্রান্তিকালীন বাংলাদেশে নজরুল ঘোরতরভাবে প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধ, সংঘাত ও বিপর্যয়ের তাণ্ডবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র যখন উথালপাতাল, নজরুল তখনো প্রাসঙ্গিক। ধুন্ধুমার এ সময়ে কখনো কখনো মনে হচ্ছে, অনিশ্চিত কোনো পথরেখায় আটকে পড়েছি আমরা। আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ধর্ম, জাতীয়তা, সম্প্রদায় কিংবা আঞ্চলিকতার প্রশ্ন। ইতিহাসের সাবেকি বাক্স খুলে আমরা খুঁজে ফিরে দেখতে চাইছি দেশভাগের দায়, পাক-ভারত সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধের অন্দরমহল। ইতিহাসের শিকড় অভিমুখে নজরুলও প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, সমাজসত্তার সঙ্গে মিশে তৈরি করেছিলেন দরকারি জবাব। তিনি দেখিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে কখনো অমৃত ফল ধরে না, ধর্ম-শ্রেণি-অভিজাততন্ত্রের একদেশদর্শিতা সৃজন করতে পারে না কোনো মানবিক ‘দেশ’, ‘অবিচ্ছিন্ন মহাত্মা’র বোধ যেখানে নেই, সেখানে তৈরি হয় না জাতীয় ঐক্যের মিলনবিন্দু।
সমকালীন ঘটনা কখনো কখনো ইতিহাসের অংশীজনকে সংশয়ের দোলাচলের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর তখনই নিতে হয় বোঝাপড়ার উদ্যোগ, ফিরে যেতে হয় প্রাজ্ঞ প্রতিভার কাছে। নজরুল সেই ‘প্রতিভার খেলা’। তাঁর কাছে গিয়ে আমরা দেখতে পারি, কোন মন্ত্রবলে তিনি অতিক্রম করেছিলেন ক্রান্তিকাল। আমরা যদি সত্যিই বহুস্বরিক ও বহুসাংস্কৃতিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবতে চাই, তাহলে নজরুলের সাহিত্য হতে পারে প্রেরণাদায়ী উপাদান। সাংস্কৃতিক রাজনীতির দিক থেকে এ মুহূর্তে নজরুল হতে পারেন জাতীয় ঐক্যের প্রাণভোমরা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নজর ল র স হ ত য ম সলম ন র স নজর ল র ব ঔপন ব শ ক র জন ত ক নজর ল ত জ বনব ধ নজর ল ব ই নজর ল অবস থ ন কর ছ ন র স মন আপন র সময় র
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকায় বিডিএফ ডায়ালজিক বিতর্কের গ্র্যান্ড স্লাম শুরু
বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের (বিডিএফ) ডায়ালজিক-২০২৫ এর স্কুল-কলেজ অধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়েছে। শুক্রবার ঢাকায় এ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়েছে সারাদেশের শীর্ষস্থানীয় ৪০টি স্কুল ও কলেজের বিতর্ক দল। দুই দিনব্যাপী এই গ্র্যান্ড স্লাম হবে যুক্তি, প্রকাশ ও সমালোচনামূলক চিন্তার এক মহোৎসব, যার লক্ষ্য হলো তরুণ কণ্ঠে একটি জাতীয় সংলাপের সূচনা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিরা তরুণদের নেতৃত্বে বিতর্ক ও সংলাপের রূপান্তরমূলক শক্তিকে তুলে ধরে বলেন, এমন উদ্যোগ একটি ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভবিষ্যতমুখী সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের সভাপতি এবং ডায়ালজিক ২০২৫-এর অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী প্লাবন গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়াও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দি আর্থ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস চেয়ারম্যান শাকিলা সাত্তার তৃণা, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি)-এর যৌথ পরিচালক (গবেষণা) সানজিদা রহমান, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোঃ আবদুল মতিন এবং বিডিএফ-এর সাবেক সভাপতি ও খ্যাতিমান গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডাঃ আবদুন নূর তুষার।
অভিনন্দন বক্তব্যে প্লাবন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, বিডিএফ কেবল প্রতিযোগিতার আয়োজক নয়, আমরা একটি জাতীয় মঞ্চ নির্মাণ করেছি যেখানে তরুণরা মনোযোগ দিয়ে শোনে, নৈতিকভাবে যুক্তি তুলে ধরে এবং নির্ভীকভাবে কথা বলে। আজকের খণ্ডিত সময়ে এই তরুণদের সম্মেলন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শ্রদ্ধাশীল ও গঠনত্মক সংলাপের মধ্যেই রয়েছে সত্যিকারের পরিবর্তনের সম্ভাবনা।
অতিথি ডা. আবদুন নূর তুষার বলেন, বিতর্ক কেবল একটি দক্ষতা নয়, এটি একটি মানসিকতা—যা সহানুভূতি, বৌদ্ধিক নম্রতা ও সত্যের নিরন্তর অনুসন্ধানে গড়ে ওঠে।
তিনি বলেন, বিডিএফ তরুণদের শুধু মঞ্চে কথা বলতে নয়, অর্থবহ আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাজ বদলাতে উদ্বুদ্ধ করছে।
শাকিলা সাত্তার তৃণা জলবায়ু ন্যায়বিচার ও কমিউনিটি ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সংলাপের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং তরুণদের আহ্বান জানান, তারা যেন তাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়।
অন্যদিকে, সুনজিদা রহমান প্রমাণভিত্তিক যুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, আজকের তরুণরাই আগামী দিনের নীতিনির্ধারক।
মো. আবদুল মতিন বলেন, শব্দের কোলাহলে ভরা এই সময়ে যারা বিতর্ক বেছে নিয়েছে, তারা আসলে চিন্তার পথকে বেছে নিয়েছে।
বিডিএফ ডায়ালজিক ২০২৫-এর মূল ভাবনা হলো—তথ্যভিত্তিক গণতন্ত্র, পরিবেশ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও যুক্তির মাধ্যমে মতভেদ মোকাবিলার ক্ষমতার ওপর। আগামী তিন দিন ধরে প্রতিযোগীরা বিতর্কের নানা রাউন্ডে অংশ নেবে, যেখানে আলোচ্য বিষয়গুলো সমাজের প্রচলিত ধারা চ্যালেঞ্জ করবে, গভীর চিন্তায় আহ্বান জানাবে এবং ভিন্ন মতকে উদযাপন করবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিডিএফের হেড অব পার্টনারশিপ এইচ এম সাবির নূর এবং সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈম আহমেদ। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিডিএফের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল মেহেদী।