অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সবার হতে পারছে
Published: 26th, May 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টা ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পদত্যাগ করতে পারেন, এমন একটি খবর সম্প্রতি রাজনীতিতে বেশ উদ্বেগের জন্ম দেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ঢাকায় প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে কাজ করতে না পারার প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়েও এখনো তেমন কিছু হলো না। তাহলে তিনি কেন থাকবেন। (প্রধান উপদেষ্টা হতাশ-ক্ষুব্ধ, ‘পদত্যাগ’ নিয়ে আলোচনা, প্রথম আলো, ২৩ মে ২০২৫)
প্রধান উপদেষ্টা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ না করলেও প্রশ্নটা এখনো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ৯ মাসের বেশি সময় পার হলো, কিন্তু সংস্কারের অগ্রগতি নেই। প্রথম ছয়টি কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও এগুলো বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন রকম অবস্থান। তবে সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করার দায়িত্বও অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তায়।
রাজনৈতিক দলগুলো এতে সহযোগিতা না করলে সরকারের উচিত সেটা খোলাসা করা এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করা। কিন্তু সংস্কারগুলো দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া, সেগুলোর ভালো–মন্দ ব্যাখ্যা করার কোনো উদ্যোগ কি সরকারের আছে? তাহলে মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি কীভাবে হবে!
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য ছাড়াও একটা বড় সমস্যা হলো, সরকার ও সরকার–সমর্থকদের আচরণে সংস্কারের ছাপ না থাকা। আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার বিভাগ সবকিছুই চলছে আগের মতো। মানুষের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে। পাইকারি গ্রেপ্তার বন্ধ হয়নি। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ঘটেনি। হাইওয়েতে নিয়মিত ডাকাতি হচ্ছে। মব তৈরি করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা হচ্ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। এর পেছনে বিভিন্ন পক্ষের অসহযোগিতা যেমন আছে, সরকারের নিজেরও ব্যর্থতা আছে।
রাস্তাঘাটে আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের দাবিদাওয়া থাকা স্বাভাবিক। সময়মতো সরকার এসব দাবিদাওয়ার ব্যাপারে যথাযথ মনোযোগ দিলে, আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করলে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে রাস্তায় নামতে হতো না, শাহবাগ বা যমুনা ঘেরাও করতে হতো না।
প্রশ্ন হলো, প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ কে দিয়েছে? কোনো স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া বা মানদণ্ড অনুসরণ না করে বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপি বা নাগরিক কমিটির কথায় সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি তো সরকার নিজে দিয়েছে। তাহলে এখন তার দায় নিতে না চাইলে তো হবে না।কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শাহবাগ বা যমুনা ঘেরাও না করা পর্যন্ত সরকার–সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে এসব দাবিদাওয়ার কথা শোনার ও সমাধান করার নানা ধরনের মেকানিজম থাকে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ৯ মাসেও এ রকম কোনো ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারেনি বলেই রাস্তাঘাট আটকানো বন্ধ হচ্ছে না। সরকারকে বরং অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে দেখা গেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি যমুনা ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ সহনশীল আচরণ করলেও অন্যদের ক্ষেত্রে বেশ মারমুখী আচরণ করতে দেখা গেছে। এ ধরনের পক্ষপাত সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে। শ্রমিক আন্দোলন থামাতে আগের মতোই গ্রেপ্তার–লাঠিচার্জ করা হচ্ছে। একদিকে মব তৈরি করে অল্পতেই দাবি আদায় হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ দিনের পর দিন আন্দোলন করেও সরকারের মনোযোগ পাচ্ছে না। একদিকে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে অনেক নিরীহ মানুষ জামিন পাচ্ছেন না। এর মধ্যে বম জনগোষ্ঠীর নারী-শিশুও রয়েছে।
সমস্যা আরও আছে। প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সব জায়গায় বিএনপিপন্থীরা রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দায় অধ্যাপক ইউনূস নিতে চান না। (বিভিন্ন দল নিজেদের মতো তৎপর, উপদেষ্টারা চুপ, সমকাল, ২৪ মে ২০২৫)
প্রশ্ন হলো, প্রশাসন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ কে দিয়েছে? কোনো স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া বা মানদণ্ড অনুসরণ না করে বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপি বা নাগরিক কমিটির কথায় সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি তো সরকার নিজে দিয়েছে। তাহলে এখন তার দায় নিতে না চাইলে তো হবে না।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট আসার আগেই নির্বাচন কমিশন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই গঠন করেছিল। খোদ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনসহ অনেকেই তখন বলেছিলেন যে আগে সংস্কারের সুপারিশগুলো আসুক, তারপর সংস্কারের সুপারিশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনটা গঠন করুন। কিন্তু সরকার তখন বিএনপি ও জামায়াতের সুপারিশ করা ব্যক্তিদের নিয়ে আগের মডেলেই নির্বাচন কমিশন গঠন করে ফেলল।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপর প্রশাসনের বিভিন্ন পদে ঢালাও বদলি ও পদোন্নতি দেওয়া হলো। এর পেছনেও কয়েকটি সংগঠনের প্রভাব ছিল। তখন কি সরকার বলেছিল যে এভাবে বিভিন্ন দলের কথায় প্রশাসনে কিংবা পুলিশে নিয়োগ–বদলি করব না! বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির কথামতো বৃক্ষ রোপণ করে এখন ফল নিজের পছন্দমতো পেতে চাইলে তো হবে না। গাছ যেমন লাগানো হয়েছে, ফল তো তেমনই ফলবে! কাজেই প্রশাসন, বিচার বিভাগ আর নির্বাচন কমিশন এখন যা কিছু করবে, তার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর গিয়েই পড়বে।
অন্তর্বর্তী সরকার এনসিপির সরকার নাকি দেশের সব মত ও পথের মানুষের সরকার—এ প্রশ্নও উঠছে। সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি তাঁদের পদত্যাগ চেয়েছে। এদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রতি–অভিযোগ তুলে সরকারের অন্য তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে।
আবার দেখা যাচ্ছে, অতি ডানপন্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে নিজেদের সরকার ভাবছে। অবশ্য সে রকম তারা ভাবতেই পারে! সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা নিশ্চিন্ত মনে মাজার ভাঙছে, নারীদের রাস্তাঘাটে হেনস্তা করছে, মেলা-ওরস-গান-নাটকের প্রোগ্রাম বন্ধ করছে, পাঠাগারে হামলা করছে, বিভিন্ন সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা–নিপীড়ন করছে। কিন্তু সরকার সেগুলো বন্ধ করতে কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেকটা যেমন খুশি তেমন ভাঙো অবস্থা চলছে।
এ রকম একটা পটভূমিতেই কিন্তু বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তাদের অনেকেই মনে করছে, এই সরকার একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সরকার। এনসিপির প্রতি রয়েছে সরকারের বিশেষ পক্ষপাত। সংস্কার বিষয়ে সরকার ও সরকার–সমর্থক এনসিপির কথা ও কাজে মিল নেই। করিডর-বন্দর নিয়ে সরকারের কারও কারও অতি আগ্রহও অনেকের মনে সন্দেহ তৈরি করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে এবং তা জনগণের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে। শুধু কথায় নয়, সরকারের কাজেও সংস্কারের ছাপ থাকতে হবে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর নয়; অন্তর্বর্তী সরকারকে তার কাজের মধ্য দিয়ে দেশের সব গণতন্ত্রকামী মানুষের সরকার হয়ে উঠতে হবে।
● কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত র সরক র সরক র স এনস প র সরক র এ পদত য গ সরক র র মন য গ ব এনপ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় সংসদের জন্য ২৩২ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জাতীয় সংসদের জন্য ২৩২ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সংসদ সচিবালয় কমিশন। মঙ্গলবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিশনের সভায় এ বাজেট অনুমোদন করা হয়।
সংসদ সচিবালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন খাতে ১৫৪ কোটি ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে ২৩২ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট প্রাক্কলন, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ২৫৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বাজেট প্রক্ষেপণ অনুমোদন করা হয়।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বাজেট অনুমোদন করা হয়।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব হাফিজ আহমেদ চৌধুরী এবং অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।