গত কয়েক মাসে আমি আমার ফোনে এমন কিছু ছবি ও ভিডিও দেখেছি, যা ভুলে যাওয়া কঠিন। সেখানে ছিল মৃত শিশু, আহত শিশু, অনাহারে কাতরানো নবজাতক। কেউ কেউ যন্ত্রণায় কাঁদছিল, কেউ ভয় ও আতঙ্কে চুপচাপ বসে ছিল। কারণ, তারা মা-বাবা বা ভাইবোনকে হারিয়েছিল। এক ছোট ছেলেকে দেখেছি, বিমান হামলার পর ভয়ে পুরো শরীর কাঁপছিল। এই দৃশ্যগুলো এতটাই ভয়াবহ যে আমার অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে। 

অনেক সময় এসব ছবি আমি স্কিপ করে দিই। কারণ, ভীত হই সামনে আরও কী দেখা যাবে। কিন্তু অনেক সময় মনে হয়, এগুলো দেখাই আমার দায়িত্ব। আমি যেন এসব অন্যায়ের সাক্ষী না হয়ে থাকতে পারি না।

আরও পড়ুনইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে১৯ মে ২০২৫

আমরা যারা নিরাপদে–আরামে আছি, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজার শিশুদের দুঃখজনক অবস্থা দেখি। আর পাশেই চোখে পড়ে হাসিখুশি মানুষের ছবি, মজার মিম। তখন গাজার শিশুরা আরও বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে। কারণ, তারা হতে পারত আমাদের সন্তানের মতোই, যদি জন্ম হতো অন্য কোনো জায়গায়। 

অনেক মানুষ চেষ্টা করছেন কিছু করার—কেউ রাজনৈতিক নেতাদের চিঠি লেখেন, কেউ দান করেন, কেউ প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন, তবু গাজার শিশুদের ওপর যুদ্ধ থামছে না। আমরা অসহায় বোধ করি। প্রতিদিন নতুন খবর আসে, অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ১৪ হাজার নবজাতক মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। এটি কোনো সাধারণ খাদ্যসংকট নয়, বরং ইচ্ছাকৃত—যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে শত্রুকে দুর্বল করতে। এটা যেন গণহত্যার একটা পদ্ধতি। 

যখন আমরা এত ভয়াবহ ঘটনা দেখি, কিন্তু কিছুই করতে পারি না, তখন আমাদের মনে নৈতিক আঘাত বা মোরাল ইনজুরি তৈরি হয়। এটার মানে হলো, আমাদের মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার সাংঘর্ষিক অবস্থায় আমরা মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করি। 

গাজার চিকিৎসক ও সাহায্যকর্মীরা সবচেয়ে বেশি এই মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন মানুষকে বাঁচাতে, কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাবার ও যন্ত্রপাতির অভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। 

শব্দটি আমি প্রথম শুনেছিলাম কোভিডের সময়, যখন ডাক্তার-নার্সরা বলেছিলেন, তাঁরা রোগীদের বাঁচাতে পারছেন না প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার কারণে। তাঁদের মনে অপরাধবোধ আর দুঃখ জমে যায়। 

এখন এই একই অনুভূতি আমাদের অনেকের মধ্যেই জেগে উঠছে—বিশেষ করে যখন দেখি গাজার শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচে কাঁদছে, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না। এটা শুধু মানবিক দুর্দশা নয়, সমাজের জন্যও এক বড় ধাক্কা। যদি আমরা এসব দেখে নীরব থাকি, তাহলে তা আমাদের ভেতরে ধ্বংস ডেকে আনে। 

গাজার চিকিৎসক ও সাহায্যকর্মীরা সবচেয়ে বেশি এই মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন মানুষকে বাঁচাতে, কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাবার ও যন্ত্রপাতির অভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। 

কাঁদতে থাকা মাকে সাহায্য করতে না পারা, আহত শিশুকে সঠিক চিকিৎসা না দিতে পারা—এই ব্যর্থতা তাঁদের মনের গভীরে ক্ষত তৈরি করে। গাজার মা–বাবার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর কষ্ট হলো নিজের সন্তানকে ক্ষুধায় কাঁদতে দেখে কিছু করতে না পারা। 

এই অসহায়তা আমাদের মন ও মূল্যবোধে একটি ভারী বোঝা নিয়ে আসে, যেটা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি না। এত বড় অন্যায়ের সাক্ষী হয়ে কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা আমাদের সমাজে কী প্রভাব ফেলবে? হয়তো এটি আমাদের অনুভূতির জায়গাকে ভেঙে দিচ্ছে। 

আমার মা আমার জন্মের পর খবর দেখা বন্ধ করেছিলেন। কারণ, তিনি এসব সহ্য করতে পারতেন না। আমি এখন মা হওয়ার পর অনেক সময় ভাবি, আমার সন্তানকে এই ভয়ানক পৃথিবীর বাইরে রাখাই ভালো। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে খবর আমাদের চোখের সামনে; দূরে থাকা যায় না।

রাতের অন্ধকারে আমি আমার ছেলেকে ঘুম পাড়াই, ভরা পেটে আরামদায়ক পায়জামায়। চুপচাপ কেঁদে যাই সেই শিশুদের কথা ভেবে, যাদের কেউ আদর করে শুইয়েও দিচ্ছে না। আমার ছেলে দুধ খেতে ওঠে, আমি দুধ গ্লাসে ঢালি। চারপাশে পাখির ডাক—বোমার শব্দ নয়। 

আমার ছেলের নিরাপত্তা আর গাজার শিশুর ভয়াবহ অবস্থা আমাকে অন্যায় ও অশ্লীল মনে হয়। এটি কি একধরনের মানসিক আঘাত নয়? যখন আপনি ছোট শিশুর সঙ্গে সময় কাটান, তাদের সরলতা দেখে, আর অন্য কোনো শিশুর ওপর নির্যাতন দেখলে মনে হয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপমান। 

আমার ছেলের নিরাপত্তা আর গাজার শিশুর ভয়াবহ অবস্থা আমাকে অন্যায় ও অশ্লীল মনে হয়। এটি কি একধরনের মানসিক আঘাত নয়? যখন আপনি ছোট শিশুর সঙ্গে সময় কাটান, তাদের সরলতা দেখে আর অন্য কোনো শিশুর ওপর নির্যাতন দেখলে মনে হয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপমান। 

শুধু মা-বাবাই নয়, যেকোনো ভালোবাসাপূর্ণ মানুষ এসব দেখে দুঃখ পায়। শিশুদের রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব, যা দেশের সীমানার বাইরে যায়। 

কিন্তু এত বড় অন্যায় দেখে কিছুই করতে না পারার যন্ত্রণা আমাদের বিশ্বাসে ফাটল ধরায়। আমরা ভাবতে শুরু করি—এই দুনিয়ায় ন্যায়ের জায়গা আছে তো? 

রিয়ানন লুসি কসলেট দ্য গার্ডিয়ান-এর একজন কলাম লেখক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ছ ল দ র মন আম দ র অন য য় অবস থ করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

সালমান, শিবলী ও সায়ান পুঁজিবাজারে ‘আজীবন অবাঞ্ছিত’

বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তাঁর ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামকে পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএসইসির সাবেক কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টসের সাবেক প্রধান নির্বাহী ইমরান আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজারে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে।

বিএসইসি জানিয়েছে, সালমান রহমান ও তাঁর ছেলেকে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাশাপাশি দেড় শ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টেড শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড ও বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের অর্থ উত্তোলন-সংক্রান্ত নানা অনিয়মের জন্য এসব ব্যক্তিকে জরিমানার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিএসইসির ৯৬৫তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্তের কথা আজ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে বিএসইসি। সংস্থাটি জানায়, আড়াই হাজার কোটি টাকার শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডটি ২০২৩ সালের ৪ জুন বিএসইসির কমিশন সভায় অনুমোদিত হয়। আর ওই বছরের ১২ জুলাই কমিশনের পক্ষ থেকে সম্মতিপত্র ইস্যু করা হয় শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের নামে। অথচ কোম্পানিটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় ২০২৩ সালের ২ মার্চ। নিবন্ধনের মাত্র এক মাস পরই ১১ এপ্রিল শ্রীপুর টাউনশিপের পক্ষ থেকে বন্ড ইস্যুর আবেদন করা হয়।

বিএসইসি আরও জানায়, বন্ডটির জামিনদার বা গ্যারান্টার ছিল আইএফআইসি ব্যাংক। পরামর্শক ও অ্যারেঞ্জার ছিল মার্চেন্ট ব্যাংক আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টস। ট্রাস্টি ছিল সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স, নিরীক্ষক ছিল এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোং এবং ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ছিল এমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড। আইএফআইসি ব্যাংক এই বন্ড ইস্যু না করলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে বন্ডের নাম হিসেবে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নাম ব্যবহার করে। এভাবে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা হয়েছিল। পুঁজিবাজার অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

এই বন্ড ইস্যুতে অনিয়মের জন্য আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে ১০০ কোটি টাকা জরিমানা ও পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে ব্যাংকটির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা ও পুঁজিবাজারে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। আইএফআইসি ইনভেস্টমেন্টসের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী ইমরান আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ারের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। তবে তাঁর বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।

একই ঘটনায় ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান এমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেডকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর বাইরে শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ডের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বিএসইসি।

বিএসইসির ওই সভায় বেক্সিমকোর ৩ হাজার কোটি টাকার পাঁচ বছর মেয়াদি অ্যাসেট-ব্যাকড গ্রিন সুকুক বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে বিধিবহির্ভূতভাবে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় শিবলী রুবাইয়াতকে আজীবন এবং শেখ শামসুদ্দিন আহমেদকে পাঁচ বছরের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

আজীবন অবাঞ্ছিত হওয়া ব্যক্তিরা শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট কী কী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন বা পারবেন না, তার বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। এ সিদ্ধান্ত কীভাবে কার্যকর করা হবে, তারও সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা ঘোষণা করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কমিশনের পক্ষ থেকে আলাদা নির্দেশনা জারি করা হবে। সে অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।

তবে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আইনি ভিত্তি ও সক্ষমতা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত এসব সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেগুলো বাস্তবে সহজে প্রয়োগযোগ্য এবং ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের মধ্যে না পড়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বাস্তবভিত্তিক। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন নয়, যা কার্যকর করা যাবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘোষণার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু পুঁজিবাজার ও সিকিউরিটিজ আইনে এ ধরনের ভাষা ও শাস্তির মানে কী, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এমনকি এর অর্থও আমি বুঝতে অক্ষম।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ