বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুম এলেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যায়। প্রতিবছর এ সময়টায় ‘এডিস ইজিপ্টাই’ নামক মশাবাহিত ভাইরাস আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ডেঙ্গু মূলত একটি ভাইরাল ফ্লু জাতীয় অসুখ হলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে রক্তে প্লাটিলেট কমে যাওয়া এবং রক্তপাতজনিত জটিলতা। শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি ও জ্বরজনিত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ডেঙ্গুর লক্ষণ ও ঝুঁকি
ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে– হঠাৎ জ্বর, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশিতে যন্ত্রণা, চর্মে ফুসকুড়ি এবং ক্লান্তিভাব। রোগটি বাড়লে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গিয়ে নাক, মুখ বা দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সঠিক পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণই রোগ প্রতিরোধে এবং রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সহায়তা করতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরে খাদ্য নির্দেশনা
১.

পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার
ডেঙ্গুতে শরীরে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দ্রুত ঘটে। এ জন্য দিনে অন্তত ৩-৪ লিটার পানি পানের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতি ঘণ্টায় এক গ্লাস পানি, ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, ফলের জুস (চিনি ছাড়া), সবজির জুস এবং হালকা স্যুপ শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং রক্তে প্রয়োজনীয় ভলিউম বজায় রাখে।
২. সহজপাচ্য পরিজ জাতীয় খাবার
ডেঙ্গু রোগীর হজমক্ষমতা সাধারণত দুর্বল থাকে। তাই পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য খাবার সবচেয়ে বেশি উপযোগী। যেমন–
l চাল ও মুগ ডালের জাউ
l দুধ ও সুজি/সাবুদানা পরিজ
l ওটস, কলা, দই ও কিশমিশ দিয়ে পরিজ
এসব খাবার রোগীকে শক্তি জোগায়, হজমে সহজ এবং সুষম পুষ্টি প্রদান করে।
৩. প্রোটিন
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রোটিন থাকা অত্যন্ত জরুরি। তবে চর্বিবিহীন উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ করাই উত্তম। যেমন–
l স্কিন ছাড়া মুরগির মাংস l মাছ l ডিমের সাদা অংশ l ডাল l দুধ ও দই
এগুলো কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে এবং প্লাটিলেট উৎপাদন বাড়ায়।
৪. স্যুপ জাতীয় খাবার
সবজি, টমেটো, কর্ন ও মুরগির স্যুপ রোগীর জ্বরজনিত দুর্বলতা কমাতে সহায়ক। এগুলোয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মিনারেলস থাকে; যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
৫. আয়রনসমৃদ্ধ খাবার
ডালিম, কলিজা, পালংশাক, বিট ইত্যাদি আয়রনের ভালো উৎস। রক্তশূন্যতা ও প্লাটিলেট হ্রাস রোধে এগুলো খুবই কার্যকর। প্রতিদিন ১ কাপ ডালিমের রস, সপ্তাহে ২-৩ দিন কলিজা এবং পালংশাক খাওয়া উপকারী।
৬. পাকা পেঁপে ও পাতার রস
গবেষণায় দেখা গেছে, পাকা পেঁপে ও পেঁপে পাতার নির্যাস প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। পাকা পেঁপের জুসের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
৭. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন সি আয়রন শোষণে সহায়ক এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন লেবু, আমলকী, কমলা, মালটা, কিউই, টমেটো, ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, পেয়ারা খাওয়া উচিত।
৮. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা প্লাটিলেট উৎপাদনে সহায়ক। প্রতিদিন ১ গ্লাস দুধ এবং দই বা ছানা খাওয়া রোগীর জন্য উপকারী।
৯. বিট ও গাজরের জুস
প্রাকৃতিক আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর বিট ও গাজরের রস রক্তের গুণগত মান উন্নত করে ও প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে।
১০. হারবাল চা
জ্বরজনিত ক্লান্তি দূর করতে দিনে ১-২ বার হারবাল চা পান করা যেতে পারে। যেমন–
l আদা-লেবুর চা
l মধু-তুলসী পাতার চা
l এলাচ ও দারচিনি যুক্ত চা
এসব পানীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং গলাব্যথা বা দুর্বলতা দূর করতে সহায়ক।
এড়িয়ে চলুন যেসব খাবার
ডেঙ্গু রোগীর খাবারে কিছু নির্দিষ্ট উপাদান পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এসব খাবার রোগ প্রতিরোধে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা হজমে সমস্যা তৈরি করে।
বর্জনীয় খাবার:
l অতিরিক্ত তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার
l অতিমাত্রায় ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার
l ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (প্যাকেটজাত স্ন্যাকস, ইনস্ট্যান্ট নুডলস ইত্যাদি)
l ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় (কফি, কোলা)
l অ্যালকোহল 
l অপরিষ্কার, কাঁচা বা অর্ধসেদ্ধ খাবার (যা পেটের সমস্যা তৈরি করতে পারে)
এসব খাবার হজমপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে এবং শরীরের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক ওষুধ না থাকায় সচেতনতাই এর প্রধান প্রতিরোধ। যথাসময়ে বিশ্রাম, তরল খাবার ও সুষম পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে শরীরকে শক্তিশালী করে তোলা যায়। পাশাপাশি প্লাটিলেটের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ, ঘরের ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা এবং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সঠিক খাদ্য গ্রহণ– এ তিনটি বিষয় সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত।
সতর্ক থাকুন, সচেতন হোন– সঠিক খাদ্যাভ্যাসে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব।
[ক্লিনিক্যাল পুষ্টিবিদ, বায়োজিন কস্মোসিউটিক্যালস]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ র বলত ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

ডেঙ্গুর মৌসুম: কী খাবেন কী খাবেন না

বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুম এলেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যায়। প্রতিবছর এ সময়টায় ‘এডিস ইজিপ্টাই’ নামক মশাবাহিত ভাইরাস আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ডেঙ্গু মূলত একটি ভাইরাল ফ্লু জাতীয় অসুখ হলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে রক্তে প্লাটিলেট কমে যাওয়া এবং রক্তপাতজনিত জটিলতা। শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি ও জ্বরজনিত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ডেঙ্গুর লক্ষণ ও ঝুঁকি
ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে– হঠাৎ জ্বর, চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশিতে যন্ত্রণা, চর্মে ফুসকুড়ি এবং ক্লান্তিভাব। রোগটি বাড়লে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গিয়ে নাক, মুখ বা দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সঠিক পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণই রোগ প্রতিরোধে এবং রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সহায়তা করতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরে খাদ্য নির্দেশনা
১. পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার
ডেঙ্গুতে শরীরে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দ্রুত ঘটে। এ জন্য দিনে অন্তত ৩-৪ লিটার পানি পানের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতি ঘণ্টায় এক গ্লাস পানি, ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, ফলের জুস (চিনি ছাড়া), সবজির জুস এবং হালকা স্যুপ শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং রক্তে প্রয়োজনীয় ভলিউম বজায় রাখে।
২. সহজপাচ্য পরিজ জাতীয় খাবার
ডেঙ্গু রোগীর হজমক্ষমতা সাধারণত দুর্বল থাকে। তাই পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য খাবার সবচেয়ে বেশি উপযোগী। যেমন–
l চাল ও মুগ ডালের জাউ
l দুধ ও সুজি/সাবুদানা পরিজ
l ওটস, কলা, দই ও কিশমিশ দিয়ে পরিজ
এসব খাবার রোগীকে শক্তি জোগায়, হজমে সহজ এবং সুষম পুষ্টি প্রদান করে।
৩. প্রোটিন
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রোটিন থাকা অত্যন্ত জরুরি। তবে চর্বিবিহীন উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ করাই উত্তম। যেমন–
l স্কিন ছাড়া মুরগির মাংস l মাছ l ডিমের সাদা অংশ l ডাল l দুধ ও দই
এগুলো কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে এবং প্লাটিলেট উৎপাদন বাড়ায়।
৪. স্যুপ জাতীয় খাবার
সবজি, টমেটো, কর্ন ও মুরগির স্যুপ রোগীর জ্বরজনিত দুর্বলতা কমাতে সহায়ক। এগুলোয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মিনারেলস থাকে; যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
৫. আয়রনসমৃদ্ধ খাবার
ডালিম, কলিজা, পালংশাক, বিট ইত্যাদি আয়রনের ভালো উৎস। রক্তশূন্যতা ও প্লাটিলেট হ্রাস রোধে এগুলো খুবই কার্যকর। প্রতিদিন ১ কাপ ডালিমের রস, সপ্তাহে ২-৩ দিন কলিজা এবং পালংশাক খাওয়া উপকারী।
৬. পাকা পেঁপে ও পাতার রস
গবেষণায় দেখা গেছে, পাকা পেঁপে ও পেঁপে পাতার নির্যাস প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। পাকা পেঁপের জুসের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
৭. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার
ভিটামিন সি আয়রন শোষণে সহায়ক এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন লেবু, আমলকী, কমলা, মালটা, কিউই, টমেটো, ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, পেয়ারা খাওয়া উচিত।
৮. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা প্লাটিলেট উৎপাদনে সহায়ক। প্রতিদিন ১ গ্লাস দুধ এবং দই বা ছানা খাওয়া রোগীর জন্য উপকারী।
৯. বিট ও গাজরের জুস
প্রাকৃতিক আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর বিট ও গাজরের রস রক্তের গুণগত মান উন্নত করে ও প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে।
১০. হারবাল চা
জ্বরজনিত ক্লান্তি দূর করতে দিনে ১-২ বার হারবাল চা পান করা যেতে পারে। যেমন–
l আদা-লেবুর চা
l মধু-তুলসী পাতার চা
l এলাচ ও দারচিনি যুক্ত চা
এসব পানীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং গলাব্যথা বা দুর্বলতা দূর করতে সহায়ক।
এড়িয়ে চলুন যেসব খাবার
ডেঙ্গু রোগীর খাবারে কিছু নির্দিষ্ট উপাদান পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এসব খাবার রোগ প্রতিরোধে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা হজমে সমস্যা তৈরি করে।
বর্জনীয় খাবার:
l অতিরিক্ত তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার
l অতিমাত্রায় ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার
l ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (প্যাকেটজাত স্ন্যাকস, ইনস্ট্যান্ট নুডলস ইত্যাদি)
l ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় (কফি, কোলা)
l অ্যালকোহল 
l অপরিষ্কার, কাঁচা বা অর্ধসেদ্ধ খাবার (যা পেটের সমস্যা তৈরি করতে পারে)
এসব খাবার হজমপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে এবং শরীরের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক ওষুধ না থাকায় সচেতনতাই এর প্রধান প্রতিরোধ। যথাসময়ে বিশ্রাম, তরল খাবার ও সুষম পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে শরীরকে শক্তিশালী করে তোলা যায়। পাশাপাশি প্লাটিলেটের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ, ঘরের ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা এবং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সঠিক খাদ্য গ্রহণ– এ তিনটি বিষয় সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত।
সতর্ক থাকুন, সচেতন হোন– সঠিক খাদ্যাভ্যাসে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব।
[ক্লিনিক্যাল পুষ্টিবিদ, বায়োজিন কস্মোসিউটিক্যালস]

সম্পর্কিত নিবন্ধ