সচিবালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চলমান আন্দোলনের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা এবং ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যু’ (প্রশাসনিক ক্যু) করার চক্রান্ত দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এর পেছনে বড় রাজনৈতিক

দলের ইন্ধন থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। যে কারণে এসব আন্দোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন তাঁরা।

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল সোমবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের চলমান আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের দোসররা থাকতে পারে; আবার সরকারকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাও থাকতে পারে। তবে এসব আন্দোলন নিয়ে দলীয়ভাবে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা তাঁরা ভাবেননি।

‘সচিবালয়ের সংস্কারবিরোধী আমলাদের অপসারণ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের দাবিতে’ আজ মঙ্গলবার ঢাকায় গণসমাবেশ ডেকেছে ‘জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’। সচিবালয়সংলগ্ন ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনে বেলা সাড়ে ১১টায় গণসমাবেশ হবে। এই কর্মসূচির প্রতি এনসিপির কয়েকজন নেতা ব্যক্তিগতভাবে সংহতি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সংহতি জানানোর বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি।’

সরকারি চাকরি (সংশোধিত) অধ্যাদেশ-২০২৫ বাস্তবায়ন হলে আমলারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন বলে মনে করেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। গতকাল সকালে তিনি ফেসবুকে লেখেন, দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধ, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ থাকলে আমলাদের চাকরিচ্যুতির মুখোমুখি হতে হবে, এমন সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কারণে সচিবালয় অচল করে দিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গণবান্ধব সংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁরা অবস্থান নিয়েছেন।

যেসব আমলা এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাঁদের এই অধ্যাদেশের মাধ্যমেই বরখাস্ত করে নতুন নিয়োগ দেওয়ারও দাবি জানান সারোয়ার তুষার। পাশাপাশি আমলাদের এই আন্দোলনের পেছনে কাদের ইন্ধন আছে, গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তা জনসম্মুখে আনার আহ্বান জানান তিনি।

হুঁশিয়ারি

গতকাল এনসিপির পথসভা ছিল চট্টগ্রামে। এই কর্মসূচি শুরুর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম শহরের বিপ্লব উদ্যানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। সচিবালয়ে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার টিকে গেলে আপনারা ঠিকই পদলেহন করে চাকরি করতেন। সুতরাং ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে আপনারা যদি জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ সরকারকে হুমকি দেন ও সংস্কার কার্যক্রমে বাধা দেন, তবে মনে রাখবেন, জনগণই আপনাদের বিকল্প খুঁজে নেবে।’

আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে হাসনাত বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে আপনারা কালো ব্যাজ ধারণ করে শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এখন আপনারা অফিস চলতে দেবেন না বলে হুমকি দেন। ৫ আগস্টের আগে শেখ হাসিনার চোখে আঙুল দিয়ে, শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আপনারা কেউ কিন্তু পদত্যাগ করেননি।’

হাসনাত বলেন, সংস্কার কার্যক্রমে যদি বাধা আসে, সেটি কঠোর হাতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ করা হবে। পরে বিকেলে এক ফেসবুক পোস্টে হাসনাত লিখেছেন, ‘সচিবালয়ের ক্যু সম্পর্কে সচেতন থাকুন।.

..জনগণ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। সুতরাং, সাবধান!’

সচিবালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদও। তিনি লিখেছেন, ‘আজ সচিবালয়, এনবিআর কিংবা পোর্টে যাঁরা স্ট্রাইক করছেন, তাঁদের বলছি, বিপ্লব ওখানেও হবে। আপনারা দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বাধীনতা চাচ্ছেন, কিন্তু চব্বিশ-পরবর্তী সময়ে এটা আর পাবেন না। হাসিনার পুরো শাসনামলের প্রতিটি গুম, খুন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার—সবকিছুর সহযোগী আপনারা। ভাববেন না, পার পেয়ে গেছেন।...পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব দুর্নীতিগ্রস্তকে অপসারণ করে নিরপেক্ষ কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া।’

নতুন অধ্যাদেশের পক্ষে এনসিপি

‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল টানা তৃতীয় দিনের মতো সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। নিজেদের দপ্তর ছেড়ে বিপুলসংখ্যক কর্মচারী এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। প্রশাসন ক্যাডার বাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদও দাবি আদায়ে আজ থেকে দুই দিনের কলমবিরতি কর্মসূচিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণের জন্য তিন দিন সময় বেঁধে দিয়েছে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন ও দল কর্মসূচি পালন করছে।

এসব আন্দোলনের বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সংশোধিত সরকারি চাকরি আইনটি তাঁদের কাছে ভালো মনে হয়েছে। তাঁরা দলীয়ভাবে এই আইনের পক্ষেই থাকবেন। নতুন করে একসঙ্গে এত আন্দোলন ‘সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যু’র চেষ্টা কি না, এখন সেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এনস প র আপন র সরক র গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনে জোট গঠনে সতর্ক থাকার পরামর্শ হেফাজত আমিরের

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট গঠনের ক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।

মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা যাবে না, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে বুজুর্গানে দ্বীন ও পূর্বপুরুষেরা আগেই সতর্ক করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন ২০২৫’–এ লিখিত বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এ কথা বলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজত আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থ থাকায় তিনি কথা বলেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হক আজিজ।

ইসলামের মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে দলগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে হেফাজত আমির বলেন, সহিহ আকিদার সব ইসলামি দলকে এক হওয়ার জন্য আগেও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, একদিকে যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র চলছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বহু রকম চক্রান্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।

অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে বাবুনগরী বলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তি দেশের স্বাধীনতার অখণ্ডতার জন্য এবং ধর্মীয় কৃষ্টির জন্য এক অশনিসংকেত। এ চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।

সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিল আহমদ কুরাইশী। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, সামনে কালো তুফান দেখা যাচ্ছে। কালো তুফানের সঙ্গে মোলাকাত নয়, মোকাবিলা করতে হবে। জনগণকে ওলামাদের নেতৃত্ব কবুল করতে হবে। তখনই তুফানকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, যারা ফ্যাসিবাদী আমলে পাখা দিয়ে নৌকাকে বাতাস করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না। জুলাই আন্দোলন ছিল ভোটের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। সেই পাঁয়তারা রুখে দিতে হবে।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ইসলামের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলেমদের মতামত উপেক্ষা করলে হাসিনার মতো পরিণতি হবে।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। এ সময় আরও বক্তব্য দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আলেম এবং ওলামারা।

১৫ দফা প্রস্তাবনা

সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। প্রস্তাবনা পাঠ করেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া।

১৫ দফার মধ্যে আছে—ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের চুক্তি বাতিল করা, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, ঘোষিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; বিতর্কিত নারী কমিশনের সুপারিশ বাতিল ও শরিয়ার সীমারেখার আলোকে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ