সমাবেশটি আগের মতো ছুটির দিনেও হতে পারত
Published: 28th, May 2025 GMT
দুপুর থেকে গোটা কাওরানবাজার এলাকাটি স্থবির হয়ে আছে। কোনো গাড়ি চলছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চললেও একটু এগোচ্ছে তো, আবার থেমে যাচ্ছে। প্রখর রোদ ও প্রচণ্ড গরমে গণপরিবহনের ভেতরে মানুষ ঘেমেনেয়ে একাকার। অনেকে যানবাহন থেকে নেমে হাঁটা ধরেছে।
কাওরানবাজারের পূর্ব দিকে হাতিরঝিলের মুখের সামান্য আগে নেমেছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সেখান থেকে শুরু করে মগবাজার এলাকায়ও একই পরিস্থিতি; বরং আগে যে পরিস্থিতি কখনো দেখা যায়নি, তা হলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে পার্কিং করে রাখা বাস। মূলত যানজটের কারণে বাসগুলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপরেই আটকে পড়েছিল। যাই হোক, ফলে কয়েক ঘণ্টা ধরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটিও অনেকটা স্থবির হয়ে যায়।
রাজধানী ঢাকা শহর কখন কী কারণে এমন স্থবির হয়ে যায়, রাস্তায় নামা ছাড়া তা বোঝা মুশকিল। তবে যে কেউ ধারণা করে নেন যে হয়তো কোথাও আন্দোলন-মিছিল বা দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে রাস্তা আটকে রাখা হয়েছে। এটিই যেন এ শহরের ‘স্বাভাবিক’ চিত্র। এ কারণে যে দিনের পর দিন দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয় ঢাকাবাসীকে, তা–ও যেন গা–সওয়া হয়ে গেছে বলা যায়; কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবে একটি রাজধানী শহর কীভাবে চলতে পারে?
আজকের পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, সকালে জামায়াতে ইসলামী নেতা আজহারুল ইসলামের মুক্তির পর জামায়াতের সমাবেশ ছিল। সেখানে দলটির বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মী জড়ো হয়েছিলেন। ফলে শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় যানজট তৈরি হয়। তবে বেলা গড়াতে না গড়াতে সেই যানজটের তীব্রতা মিরপুর ও উত্তরার কিছু এলাকা ছাড়া গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে মূলত বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশের কারণে।
আয়োজকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এই সমাবেশে ঢাকা, সিলেট, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ১৫ লাখ তরুণের জমায়েত হওয়ার কথা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর আটকে থাকা গাড়িগুলো মূলত বিএনপির সমাবেশে কর্মীদের নিয়ে আসা বাস। সারি সারি বাসগুলো থেকে বিএনপি কর্মীরা নেমে পড়ছেন এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধরে হেঁটেই নেমে আসছেন মূল রাস্তায়।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন কার্যদিবস শেষ। মানুষ অফিস থেকে বের হয়ে আসছেন। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাওরানবাজার এলাকা তখনো অনেকটা স্থবির। জামায়াতের সমাবেশ শেষ দুপুরের আগে, অর্থাৎ সকাল সাড়ে ১০টার আগেই; আর বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশ শুরু হয়েছে বেলা দুইটার পর। বিকেল পাঁচটায় শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ধারণা করি প্রায় সন্ধ্যাই হবে। এরই মধ্যে সমাবেশে আগত লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করবেন। একই সময়ে রাজধানীর লাখ লাখ কর্মজীবীর ঘরে ফিরবেন। স্বাভাবিক কর্মদিবসেই যানজটের কারণে অনেক কর্মজীবীই ঠিক সময়ে ঘরে ফিরতে পারেন না। আর আজকের কথা ভাবুন তো!
বিষয়টি এমন নয় যে বিএনপির কারণে রাজধানীবাসী আজ সারা দিন চরম দুর্ভোগে পড়েছেন, সেই করুণ অবস্থা চিত্রায়িত করতেই এ লেখার উদ্দেশ্য। এটি শুধু বিএনপি বা জামায়াতের সমাবেশের বিষয় নয়; এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি-জামায়াত বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা-সমাবেশে নানা বাধার মুখে পড়তে হতো। সে সময় সমাবেশের অনুমতি নিতে কী পরিমাণ টালবাহানার শিকার হতে হয়েছে আমরা দেখেছি!
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগের মাসে ডিসেম্বরে বিএনপি পল্টন ময়দানে মহাসমাবেশের কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। পল্টনে সেই সমাবেশ তো করতে দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার, তার আগেই পুলিশের বাধা ও বিএনপি নেতা–কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন বিএনপির কর্মী নিহত হয়েছিলেন। এরপর গোলাপবাগে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ২৬টি শর্তে। চারদিক থেকে সরকারের তীব্র বাধা সত্ত্বেও সমাবেশের আগের দিন রাতেই গোলাপবাগ মাঠ ভরে গিয়েছিল বিএনপির নেতা–কর্মীতে। আর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী মহাসমাবেশ তো হলোই। সেদিন ছিল শনিবার।
হ্যাঁ, সবার স্মরণে থাকার কথা। বিএনপি তখন ভোটের অধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলন শুরু করেছিল দেশজুড়ে। রাজধানীতে একের পর এক মহাসমাবেশের ডাক দিয়ে যাচ্ছিল। সেসব কর্মসূচি থাকত হয় শুক্রবার, নয়তো শনিবার। ২০২৩ সালের ১২ জুলাই, ২৭ জুলাই, ২৮ অক্টোবর এবং এরপর ১০ ডিসেম্বর—এসব তারিখে আয়োজিত প্রতিটি মহাসমাবেশে রাজনৈতিক জোয়ার ফিরে পেয়েছিল বিএনপি। এসব তারিখের প্রতিটি দিন ছিল শুক্রবার বা শনিবার। পাঠক, পুরোনো ক্যালেন্ডার ধরে তারিখ ঘেঁটে দেখতে পারেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের চাপ ছাড়াও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কর্মসূচি ফেলার বিএনপির একটি উদ্দেশ্য ছিল সমাবেশে দলীয় নেতা–কর্মী ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করা, অফিস বা ব্যবসার ব্যস্ততা ছাড়াই ছুটির দিনে সবাই যেন সমাবেশে যোগ দিতে পারেন; সেই সঙ্গে কর্মদিবসে সমাবেশের আয়োজন করে মানুষকে দুর্ভোগের মুখে না ফেলা। বিএনপি মনে করেছিল, কর্মদিবসে কর্মসূচি করলে তারা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি হারাতে পারে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের কাছেও সেটি হতো তখন রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার। সে সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যগুলো খেয়াল করলেও সেটি স্পষ্ট হয়।
এখন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আয়োজনে কোনো বাধানিষেধ নেই; কিন্তু বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে সুন্দর চর্চা তৈরি করেছিল, সেটি থেকে কেন বিচ্যুত হলো? এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বিএনপি যদি এই চর্চা অব্যাহত রাখত, বাকি দলগুলোর মধ্যেও বিষয়টি অনুসরণীয় হতো নিঃসন্দেহে। রাজনৈতিক দলগুলোরই তো সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করার কথা—মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে তো আসলে রাজনীতি হয় না। মানুষও সেই রাজনীতি কখনো পছন্দ করে না।
রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করা যেকোনো রাজনৈতিক দলের অধিকার। সংবিধানেও সেই অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সেখানে জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কর্মসূচির আগে প্রশাসন বা পুলিশ থেকে অনুমতি নেওয়ারও একটি নিয়ম আছে। সরকার নিজ থেকে বাধা তৈরি না করলে সাধারণত সেই অনুমতি খুব একটা সমস্যা হয় না কারও।
আর আমরা এ–ও চাই না, সরকার বা পুলিশ কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির আয়োজনে বাধা দেবে বা অনুমতি দেবে না; কিন্তু জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে তারা চাইলে কর্মদিবসে বড় সভা-সমাবেশ করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।
আর রাজনৈতিক দলগুলো তো বলেই থাকে, তারা রাজনীতি করে মানুষের কল্যাণের স্বার্থে। তো, তারাও কেন কর্মদিবসের ক্ষেত্রে বড় কর্মসূচির ঘোষণা করতে সেই বিবেচনা করবে না?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ব এনপ র র এল ক র কর ম ব র হয় আওয় ম সরক র য নজট
এছাড়াও পড়ুন:
৬৫ শিল্পীর কর্ম নিয়ে 'রবীন্দ্রনামা'
দেশের ৬৫ জন শিল্পীর কর্ম নিয়ে ঢাকায় শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী- ‘রবীন্দ্রনামা’। বৃহস্পতিবার ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এ প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন।
প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু একজন কবি, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, নাট্যকার, সুরকার, শিক্ষাবিদ এবং সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না, তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চিরন্তন সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধও ছিলেন। আমাদের দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা হিসেবে তার উত্তরাধিকার আমাদের ঐক্যের প্রতীক।
প্রদর্শনীর কিউরেটর সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, রবীন্দ্রনামা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে নবপ্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রয়াস। আমরা চাই, রবীন্দ্রচেতনা হোক সকলের জন্য উন্মুক্ত ও বিশ্লেষণযোগ্য।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন পর্ব শেষে সংগীতানুষ্ঠানে অংশ নেন ধ্রুপদী ও রবীন্দ্রসংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী দম্পতি ড. ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী ও ড. সুভীর কুমার চক্রবর্তী।
এতে অংশ নেন রফিকুন নবী, আবুল বারাক আলভী, জামাল আহমেদ, রঞ্জিত দাস, শহিদ কবীর, ঢালী আল মামুন, মুস্তাফা খালিদ পলাশ, বিপাশা হায়াত সহ আরও বহু গুণী শিল্পী। প্রদর্শনীটি কিউরেট করা হয়েছে প্রফেসর হামিদুজ্জামান খান, প্রফেসর আবুল বারক আলভী ও প্রফেসর নিসার হোসেনের দিকনির্দেশনায়।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে যাত্রা শুরু করা ‘রবীন্দ্রনামা’ প্রজেক্টটি ১৪ বছর পরে আজ নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। শিল্পী ও শিক্ষক ওয়াকিলুর রহমান, প্রফেসর নিসার হোসেন ও রশিদ আমিনের সহায়তায় এটি প্রথমে একটি প্রিন্ট ফোলিও আকারে প্রকাশ পায়। সময়ের সঙ্গে এই প্রজেক্টটি হয়ে উঠেছে রবীন্দ্র ভাবনার এক দৃষ্টিনন্দন দালিলিক নিদর্শন।