ভ্যাপসা গরম। কখনও আচমকা বৃষ্টি। হুট করেই বয়ে যায় দমকা হাওয়া। কখনও আবার লাল টকটকে লিচু ঝুলে থাকা গাছের ছায়ায় জিরানো। দিগন্ত বিস্তৃত নীলাভ জল, পৌরাণিক কাহিনিসমৃদ্ধ নদীর ধার, সারি সারি পাম গাছের ফাঁক গলে হেঁটে যাওয়া, সড়কপথের কলিজা কাঁপানো বাঁক– এসব মিলিয়ে স্বল্প সময়ে ঘুরে আসার মতো এক স্থান প্রকৃতিকন্যা কাপ্তাই।
তারিখটা ছিল ৩০ এপ্রিল। পরপর তিন দিন ছুটি। ছুটি মানে ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য মন থাকে পাগলপারা। রাত ১১টায় বাস। দে-ছুট ভ্রমণসংঘের সঙ্গী সবাই বাস কাউন্টারে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১০টা ছুঁইছুঁই করলেও আমার তখনও যাওয়া হয়নি। পরদিন ১ মে শ্রমিক দিবসে অনুষ্ঠান ছিল। পরে নানা ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে শেষ মুহূর্তে জনপথ মোড়ে পৌঁছাই। প্রচণ্ড জ্যামের কারণে বাস একটু দেরিতে ছাড়ল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সিটে বসলাম বেশ আয়েশ করে। ভোরে পৌঁছাই কাপ্তাই। বন্ধু রতনের কল্যাণে সরকারি এক বিশ্রামাগারে আগেভাগে রুম ঠিক করা ছিল। রুমে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গেলাম আসাম বস্তির দিকে। যেতে যেতে বাঙাল হালিয়া পাহাড়ি বাজারে ব্রেক। কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই লেকের মাছ আর ফলের পসরা মেলে রেখেছেন পাহাড়িরা। টক-মিষ্টি লিচুর স্বাদ নিই। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি হাটবাজারের ভিন্নমাত্রার বৈশিষ্ট্য থাকে, যা ভ্রমণপিপাসুকে বেশ আকৃষ্ট করে। তরতাজা মাছ কেনার ইচ্ছা দমিয়ে ছুটলাম মূল গন্তব্যে। পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলা সড়ক। উঁচু-নিচু, ঢালু। এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে কাপ্তাই লেকের নীলাভ জলরাশি। বয়ে চলা পানির বুকে ছোট্ট করে মাথা জাগিয়ে রাখা মাটি। সেই মাটি ভেদ করে শিরদাঁড়া উঁচু করে রয়েছে বৃক্ষরাজি। চমৎকার সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে মুগ্ধ নয়নে যেতে যেতে হঠাৎ লাল টসটসে লিচু বাগান দেখে চোখ আটকায়। গাড়ি থামিয়ে চলল ফটোশুট। কোথাও কোথাও পথের ধারে কৃত্রিম ও প্রকৃতির সম্মিলনে পর্যটকদের জন্য সাজগোজ করে রাখা হয়েছে নানা স্থাপনা। কোথাওবা সড়কের পাশে কংক্রিটের বেঞ্চ। তবে কাঠ-বাঁশের হলে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে যেত বেশ। ব্রিজ পর্যন্ত যেতে আরও কয়েকবার থেমেছি। পথের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমাদের থামতে বাধ্য করেছে। জুমের কলা, পেঁপে, আনারসের ছিল সেই স্বাদ। যেতে যেতে কাঙ্ক্ষিত ব্রিজ। সত্যিই অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা সর্পিল আসাম বস্তি ব্রিজ। মাথার ওপরে নীল আসমান। ডানে-বামে কাপ্তাই লেকের টলটলে পানি। সামনে তাকালে এঁকেবেঁকে যাওয়া ব্রিজটি চলে গেছে বহুদূর। তপ্ত রোদেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমুগ্ধ নয়নে ব্রিজের রেলিং ধরে তাকিয়ে থাকা যাবে লেকের জলে। ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ। বর্তমানে এই হ্রদ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। অথচ এর পেছনের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। বাঁধটি নির্মাণের সময় রাঙামাটি জেলার প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে ডুবে সৃষ্টি হয় হ্রদ। বাদ যায়নি রাঙামাটির রাজবাড়িটিও। এক রাতের মধ্যে বহু বসতবাড়ি পানির তোড়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সব সুন্দরের পেছনের ইতিহাস হয়তো অনেকটা এ রকমই হয়ে থাকে। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদ দেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট হ্রদ। এর গভীরতা ১০০ ফুট থেকে কোথাও কোথাও প্রায় ১৭৫ ফুট পর্যন্ত। সবুজের সঙ্গে মিতালি করা কাপ্তাই লেকের আয়তন ৪ হাজার ২৯৪ বর্গমাইল। এই লেকের মাছ বেশ সুস্বাদু। রাঙামাটির স্থানীয় বাসিন্দাসহ ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের রসনা মেটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হয়ে থাকে এ মাছ। বিশেষ করে, রুই ও চাপিলা মাছের জুড়ি মেলা ভার।
বেশ মজা করে দুপুরের খাবার সারলাম এক রেস্তোরাঁয়। এরপর নামমাত্র বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম শীলছড়ির পথে। কাপ্তাই বাজার থেকে সড়কের রোমাঞ্চকর বাঁকগুলো পেরিয়ে ২৫ মিনিটে হাজির হলাম কর্ণফুলী নদীর তীরে লুসাই পাহাড়ের সন্নিকটে, শীলছড়ি ৩৫ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের মূল ফটকে। এক বন্ধু সেখানকার কর্মকর্তা। সে এসে অভ্যর্থনা জানায়। এতে যারপরনাই আন্দোলিত হই। গেস্টরুমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ক্যাম্পাসের সোনালি অতীতের স্মৃতিচারণ চলে। এরই মধ্যে মৌসুমি নানা ফল আর শরবতের গ্লাস দিয়ে ডাইনিং সয়লাব। এত কিছু খেতে গেলে সুন্দর বিকেলটাই হারিয়ে যাবে। সেই ভয়ে সেলিমকে তাড়া দিতে আমাদের নিয়ে গেল কর্ণফুলীর কূলে। জায়গাটা এত বেশি নয়নাভিরাম ও পরিচ্ছন্ন, প্রথম দেখাতে মনে হবে না যে এটি আমাদের দেশ। সারি সারি পাম গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দৃষ্টিসীমায় মাথা উঁচু করা লুসাই পাহাড়। সবুজের গালিচা দিয়ে মোড়ানো। সেই পাহাড়ে বসবাস করে নানা আদিবাসী গোষ্ঠী। পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, ঝিরঝির বাতাসের দোল, জুম ঘরের আদলে তৈরি ছাউনিতে বসে চায়ের আড্ডা– সব মিলিয়ে সুন্দর একটি বিকেলের সাক্ষী হলাম। সময়ের পরিক্রমায় লাল টকটকে সূর্যটা লুসাইর বুকে থাকা গহিন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমরাও ওই দিনের স্মরণীয় ভ্রমণের ইতি টেনে বিশ্রামাগারে ফিরি। চাইলে কেউ এক দিন ঘোরাঘুরি করে রাতের বাসে ঢাকায় ফিরতে পারেন। ঈদের ছুটিতেও কাপ্তাইয়ে হতে পারে দু-এক দিনের একটি ভ্রমণ।
আমরা পরদিন সকালে গিয়েছিলাম কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। পরিচিত একজনের মাধ্যমে প্রবেশের অনুমতি মেলে। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। হাঁটতে হাঁটতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে এসে হাজির। পাশাপাশি দুটো ভবন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৪ সাল। এর পুরোনা ভবনে আশির দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির শুটিং হয়েছিল। ভ্রমণ বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা লাভেরও একটি বড় মাধ্যম। পুরো পৃথিবীই একটি আদর্শ বই, যা ভ্রমণের দ্বারা পাঠ করা সম্ভব। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস