গণঅভ্যুত্থানের গণআকাঙ্ক্ষা কি পূরণ হয়েছে?
Published: 31st, May 2025 GMT
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক গভীর হতাশা ও বিপন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, অসন্তোষ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তার মূল সুর ছিল– মুক্তি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। অথচ মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যেসব সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে– বিশেষ করে মাজার ভাঙা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, নারীর প্রতি প্রকাশ্য ঘৃণা ও সহিংসতা– সেগুলোর একটি ঘটনাও বিচারের মুখোমুখি হয়নি। এর মধ্য দিয়ে এক অশুভ বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে– অপরাধীরা রেহাই পাচ্ছে, কারণ তারা শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এসব অপরাধে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর মূল হোতারা জামায়াত-শিবির কিংবা এনসিপিসংশ্লিষ্ট। কখনও ছদ্মনামে ‘তৌহিদি জনতা’ বা ‘অমুক ঐক্য মঞ্চ’, আবার কখনও নীরব রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে পরিচালিত নানা গোষ্ঠী এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। তা না হলে অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসবে না কেন?
এসব অপরাধের বিচারহীনতাই প্রমাণ করে যে, এগুলো শুধু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত। যে রাষ্ট্র সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, মৌলবাদী শক্তির হাতে নিরপরাধ জনগণকে তুলে দিচ্ছে পরোক্ষভাবে, সেই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপ পুরোপুরি ব্যর্থ; বরং তা চলছে বিপরীত দিকে।
শুধু বিচারহীনতা নয়, বরং এসব গোষ্ঠীকে সরকার প্রকাশ্যেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। ন্যূনতম মানবিক বিবেচনাতেও প্রশ্ন জাগে: কেন এই মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এমন আপস? এই সরকার তো ছিল সবার সমর্থনপুষ্ট নির্দলীয় সরকার– যেখানে সব রাজনৈতিক দল তাকে সমর্থন দিয়েছে বিনাবাক্যে।
মানুষ চেয়েছিল দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ– যেখানে নারীর অধিকার, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পরপরই সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে চমকে দিয়েছেন দেশবাসীকে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের জামিন বা ক্ষমা, ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রকাশ্য প্রশ্রয়– এসব সিদ্ধান্তে স্পষ্ট যে সরকার কোন দিকে যাচ্ছে। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কারামুক্তির ঘটনা, মন্ত্রণালয় বিভিন্ন স্তরে নিয়োগ কিংবা এনসিপি-জামায়াত নেতাদের একসঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ– এসবই স্পষ্ট বার্তা দেয় যে কারা সরকার পরিচালনায় প্রভাব রাখছে।
আরও উদ্বেগজনক হলো এনসিপি নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ। দলীয় তহবিলের অপব্যবহার, প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়া– এসব অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত শুরু হয়েছে কিনা, তা অজানা।
অথচ এই সরকার গণআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে ক্ষমতায় এসেছিল। জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে, তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সুযোগকে নিজের দল ও মতাদর্শ বিস্তারের কাজে লাগানো হাজার হাজার শহীদদের প্রতি এবং আহত পরিবারের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের উদাহরণ।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ হলো: একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত নির্বাচন আয়োজন। যতই কৌশলের রাজনীতি খেলতে চাওয়া হোক, গণমানুষের চেতনা আজ অনেক বেশি সংবেদনশীল। তাদের বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে, তাদের চোখ খুলে গেছে। তাই ক্ষমতা ধরে রাখার যতই চেষ্টা হোক, সেটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
একটি রাজনৈতিক সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করা। কিন্তু এই সরকার বরং সেই ইচ্ছাকে বিকৃত করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে যে রাজনৈতিক ধারা চালু হয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধী। নারীর অগ্রযাত্রার জায়গায় এসেছে অবদমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গায় এসেছে ভয়, আর সহনশীলতার জায়গায় এসেছে উগ্রতা।
এত সব সত্ত্বেও বর্তমান সরকার এখনও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে চাইছে। না। কারণ কি এই যে, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ জামায়াত-এনসিপিকে সমর্থন করবে না। সেজন্যই কি সময়ক্ষেপণ চলছে। কিন্তু এবার দেশের মানুষও সম্ভবত জানে, স্বাধীনতার পর এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ কার্যত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই এবার নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রশ্ন নয়, এটি একটি জাতীয় পুনর্জাগরণের প্রশ্ন। একটি অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ নির্বাচনই হবে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংস্কার। এটিই হবে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একমাত্র পথ।
বস্তুত ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আর এই জাতির আত্মত্যাগ, সংগ্রাম এবং বিবেক বারবার প্রমাণ করেছে– যেখানে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে, সেখানেই উঠে দাঁড়ায় এক অপ্রতিরোধ্য জনতার শক্তি।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও মানবাধিকারকর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক সরক র র প রক শ অপর ধ ক ষমত এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে: নাহিদ
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “জুলাই সনদ হতে হবে, জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। নির্বাচিত যে সরকার আসুক এই সদন বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা থাকবে।”
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সন্ধ্যায় গাজীপুরের রাজবাড়ি সড়কে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’র সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র হতেই হবে। এর বিকল্প আমরা দেখতে চাই না। সরকার সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে। জুলাই সনদ শুধু সংস্কার হলে হবে না, এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে ঐক্যমত হতে হবে।”
আরো পড়ুন:
ভাসানীরা না থাকলে শেখ মুজিব কখনো তৈরি হতেন না: নাহিদ
গণঅভ্যুত্থান না হলে নির্বাচনের স্বপ্নই দেখতে পারতেন না: নাহিদ
তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, ৫ আগস্টের আগেই অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং সব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করতে পারবেন। আমরা সবাই মিলে আকাঙ্ক্ষিত গণঅভ্যুত্থানের একবছর উদযাপন করতে পারব।”
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন- এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, কেন্দ্রীয় সংগঠক আব্দুল্লাহ আল মুহিম, মো. মহসিন উদ্দিন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গাজীপুরের সাবেক আহ্বায়ক নাবিল আল ওয়ালিদ।
এনসিপির পথসভাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সকাল থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন মোড়ে ও সমাবেশস্থলে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাতে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হয়। রাজবাড়ীর সড়কে বন্ধ থাকে সব ধরনের যান চলাচল।
এর আগে, এনপিপির কেন্দ্রীয় নেতরা টাঙ্গাইলের পথসভা শেষে গাজীপুরে কালিয়াকৈরে উপজেলা হয়ে শ্রীপুর উপজেলার মাওনা যান। সেখানে বিকেলে পথসভা শেষে গাজীপুর শহরের রাজবাড়িতে আসেন তারা।
ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ