জুলাই সনদ–ঘোষণাপত্র হলে ঘোষিত সময়ে নির্বাচনে আপত্তি নেই: এনসিপি
Published: 6th, June 2025 GMT
আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে যদি জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে ঘোষিত এই সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসবে। তারপরও প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের যে সময়সীমার কথা বলেছেন, যদি এই সময়কালের মধ্যে জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি বিভিন্ন সময়ে একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন দাবি করেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিও জানাতে দেখা গেছে দলটিকে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের দাবিও তারা সামনে এনেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে আওয়ামী লীগের বিচার ও রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারকে এনসিপির রাজনীতির প্রধান এজেন্ডা হিসেবে দেখা গেছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্প কি রাজার শাসন চালাচ্ছেন
রাজারা সাধারণত জন্মগত অধিকারে এবং জনগণের স্বাভাবিক আনুগত্যধন্য হয়ে শাসন করেন। অনেক সময় তাঁরা ভয় দেখিয়েও শাসন চালান। গত মাসে যখন যুক্তরাষ্ট্রে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে ‘আমরা রাজার শাসন চাই না’ বলে স্লোগান দেন, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি করা ওই ভিডিওতে তাঁর মাথায় রাজার মতো করে মুকুট পরাতে দেখা যায়। কিন্তু পরের দিনই তিনি আরেক পোস্টে বলেন, ‘আমি কোনো রাজা নই।’
তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে, আসলে কোনটি সত্য? তিনি কি রাজা, নাকি তা নন। তরুণ পডকাস্টার ব্রাইলিন হলিহ্যান্ড এ প্রশ্নকে সরলভাবে দেখেছেন। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে কোনো রাজতন্ত্র নেই আর ট্রাম্পের ভিডিওগুলো নিছকই একধরনের মজা বা ‘ট্রলিং’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প কি এমন সব ক্ষমতা হাতের মুঠোয় নিতে চাইছেন, যা একসময় রাজাদের হাতে থাকত?
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরকারের করা ‘ট্রাম্প বনাম যুক্তরাষ্ট্র’খ্যাত মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তার বলে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা এখন তাঁদের সংবিধানসম্মত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ‘সম্পূর্ণ দায়মুক্ত’ এবং অন্যান্য সরকারি কাজের ক্ষেত্রে ‘আংশিক দায়মুক্ত’। অর্থাৎ এ রায়ের পর প্রেসিডেন্টের ওপর আইনি চ্যালেঞ্জ তোলা এখন অনেক কঠিন।
তবে ট্রাম্পের সমর্থকদের চোখে তাঁর এই আচরণগুলো শক্তিশালী ও দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাঁদের যুক্তি, ট্রাম্প তো সর্বশেষ নির্বাচনে পপুলার ভোটে জিতে এসেছেন। তাঁদের মতে, ট্রাম্প একজন সফল সিইওর মতো কাজ করছেন; অপ্রয়োজনীয় বাধা দূর করে জনগণের জন্য ‘সুফল’ এনে দিচ্ছেন।
কাগজে-কলমে ট্রাম্প যদিও কোনো রাজা নন, তবে তাঁর শাসনকৌশলে রাজাদের মতো ক্ষমতা খাটানোর বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি আসলে দেশ চালাচ্ছেন টিউডর রাজা হেনরি সপ্তমের মতো। রাজা হেনরি তাঁর অভিজাত গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিপক্ষদের দুর্বল করে, রাজকোষের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত করে এবং প্রশাসনের কাঠামো বদলে দিয়ে নিজের হাতে সব ক্ষমতা নিয়েছিলেন।
রাজা হেনরি রাজস্ব আদায়ের জন্য বন্ধকিপত্র, চাঁদা আর জরিমানার মতো কিছু গোপন পদ্ধতি চালু করেছিলেন, যাতে পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়াই তিনি রাজকোষ ভরতে পারেন। ঠিক একইভাবে ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের জন্য সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ করা কয়েক শ কোটি ডলার সম্প্রতি ‘স্থগিত’ করে রেখেছে। ওই অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড় না করলে সে বরাদ্দ বাতিল হয়ে যাবে।
কিন্তু এই অর্থ স্থগিত বা ফ্রিজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আসলে কংগ্রেসের, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী ‘অর্থের নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘পাওয়ার অব দ্য পার্স’ নামে পরিচিত। গত সেপ্টেম্বরে এক ফেডারেল বিচারক সরকারকে এই অর্থ ছাড় করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের সেই স্থগিতাদেশের বেশির ভাগ অংশই বহাল রাখেন এবং অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত বরাদ্দ আটকে রাখার অনুমতি দেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প সরাসরি ‘রাজকোষের’ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। এটি রাজা হেনরি সপ্তমের সময়কে মনে করিয়ে দেয়।
ট্রাম্পের আমলে দেখা যাচ্ছে, যে পদগুলোর জন্য সিনেটের অনুমোদন দরকার, সেসব পদে ‘ভারপ্রাপ্ত’ কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নীতিমালা প্রকাশের আগে মন্তব্য করার সময়সীমা আগে ছিল ৬০ দিন। এখন তা কমিয়ে ৩০ দিন করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘোষণা এত তাড়াহুড়ায় দেওয়া হচ্ছে যে সঠিক পর্যালোচনার সুযোগই থাকছে না।ট্রাম্পের সমর্থকদের মতে, এ ধরনের ‘অর্থ বরাদ্দ স্থগিতকরণ’ পুরোপুরি বৈধ। তাঁদের চোখে ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ তাঁর ভোটারদের স্বার্থে নেওয়া দৃঢ় ও কার্যকর সিদ্ধান্ত। তাঁদের যুক্তি, কংগ্রেস চাইলে তো আইন করে এমন কোনো বরাদ্দ পুনর্বহাল করতে পারে, তাই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে পুরোপুরি লাগামছাড়া বলা যাবে না।
ট্রাম্প প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদ পুনঃ শ্রেণীকরণ করেছে, সরকারি কর্মচারীদের সেবা সুরক্ষা দুর্বল করেছে এবং অভিজ্ঞ পেশাদারদের কাছ থেকে কর্তৃত্ব সরিয়ে তা বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠদের হাতে দিয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরের আইনজীবীরা এখন নতুন করে নীতিমালা লিখছেন, বিজ্ঞানীরা পরিবেশ বিপর্যয়জনিত বিপদের মাত্রা কমিয়ে দেখাচ্ছেন আর নৈতিকতা-সংক্রান্ত কর্মকর্তারা ট্রাম্পের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের মতামত বারবার সংশোধন করে চলেছেন।
এখন আর আগের মতো প্রকাশ্য শুনানি বা মহাপরিদর্শকের তদন্তে বিষয়গুলোর মীমাংসা হয় না। এখন এসব গোপনে নিষ্পত্তি হচ্ছে। ফলে জনসমক্ষে কোনো রেকর্ডই থাকছে না। একটি মেধাভিত্তিক সরকারি ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো সরকার যেন রাজদরবারের মতো না চলে, আনুগত্যের চেয়ে দক্ষতা যেন বেশি মূল্য পায়। কিন্তু যখন বিশ্বস্ত লোকদের অভিজ্ঞদের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যোগ্যতার বদলে সম্পর্কের ভিত্তিতে। এতে তদারকি বা জবাবদিহি দুর্বল হয়ে পড়ে।
ট্রাম্পের আমলে দেখা যাচ্ছে, যে পদগুলোর জন্য সিনেটের অনুমোদন দরকার, সেসব পদে ‘ভারপ্রাপ্ত’ কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নীতিমালা প্রকাশের আগে মন্তব্য করার সময়সীমা আগে ছিল ৬০ দিন। এখন তা কমিয়ে ৩০ দিন করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘোষণা এত তাড়াহুড়ায় দেওয়া হচ্ছে যে সঠিক পর্যালোচনার সুযোগই থাকছে না।
যেভাবে রাজা হেনরি তাঁর বিশ্বস্ত লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতেন বা কোনো কোনো পদ ফাঁকা রেখেই শাসন চালাতেন, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেও ইন্সপেক্টর জেনারেলদের পদ দীর্ঘদিন খালি পড়ে থাকার কারণে তদন্তের গতি কমে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁদের রাজনৈতিক সমর্থন দুর্বল, তাঁরা আইন প্রয়োগে অনাগ্রহী।
ট্রাম্পকে রাজা ঘোষণা করা হয়নি। কারণ, একজন প্রেসিডেন্ট কখনো রাজা হতে পারেন না। তিনি নির্বাচন ছাড়া শাসন করতে পারেন না, সংসদের অনুমোদন ছাড়া অর্থ খরচ করতে পারেন না, আদালত ভেঙে দিতে পারেন না বা অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষমতা বিলুপ্ত করতে পারেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো এখনো টিকে থাকলেও তাদের কার্যকারিতা বদলে গেছে। ট্রাম্পের মাথায় রাজমুকুট না থাকলেও তিনি কার্যত রাজা হয়েই আছেন বলে মনে হচ্ছে।
● কারলা নরলফ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত