চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় মোট ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। ৯ মাসে সার্বিকভাবে বাজেট বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ছিল ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এদিকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে উন্নয়ন ব্যয় কমেছে। তবে পরিচালন ব্যয় বেশ খানিকটা বেড়েছে। পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে বরাদ্দের ৬২ শতাংশ; যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ। উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বাজেট বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট দেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে তা সংশোধন করে ৭ লাখ ৪৪ হাজারে নামিয়ে আনে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে মূল বাজেটকে আমলে নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ৯ মাসে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ে চলতি বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। ৯ মাসে খরচ হয়েছে ৭১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৭৯ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাটছাঁট হয়েছে। অর্থবছরের শুরু থেকে আন্দোলন ও পরে আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্টি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি প্রশাসনে রদবদলের কারণে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি রয়েছে। সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী পদক্ষেপ থাকলেও গত সরকারের নেওয়া অনিয়ন্ত্রিত ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এ কারণে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। তা ছাড়া পরিচালন বাজেটে কাটছাঁটের খুব একটা সুযোগ থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড.
সরকারের খাতভিত্তিক ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি ৭৫ দশমিক ৪১ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এ খাতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৪২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। সুদের হার বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঋণের বিপরীতে সরকারের সুদ পরিশোধ যার মূল কারণ বলে মনে করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
প্রথম ৯ মাসে সুদ পরিশোধ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে ৯৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৭৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এ সময়ে সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণের বিপরীতে ৮১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করা হয়েছে। যেখানে আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৬৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৩৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৩৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। এ সময়ে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কৃষি খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ সময়ে এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৯ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা।
প্রতিরক্ষা খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ২১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৮ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ। জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৬ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৬ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। এ ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ।
সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। ৯ মাসে সরকার ৩ লাখ ৯ হাজার ৫৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। ফলে বাজেট ঘাটতি হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এ সময়ে সরকার ৮০ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬৫ হাজার ৪৪৭ কোটি ও বিদেশি উৎস থেকে ১৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স দ পর শ ত অর থ এ সময় দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।
অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।