আল্লাহর নামের ওপর ইমান আনতে হয় কেন
Published: 11th, June 2025 GMT
আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ, তাঁর অসীম মহিমা ও পবিত্রতার স্বীকৃতি, মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালায়। তাওহিদের মধ্যে লুকিয়ে আছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলির এককতা, যা আমাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে এবং জীবনকে অর্থপূর্ণ করে।
তাওহিদে আল্লাহর অসামান্য নাম ও গুণাবলির প্রতি ইমান আনা হয়, যা কোরআন মাজিদ ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। এই বিশ্বাসে কোনো বিকৃতি, অস্বীকৃতি, সীমাবদ্ধতা বা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা নেই। আল্লাহর নাম ও গুণাবলির তাওহিদ হলো তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানে অধিষ্ঠিত করা, তাঁর মহানুভবতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ।
একত্ববাদের ভিত্তি
আল্লাহর নাম ও গুণাবলি শুধু কোরআন ও সুন্নাহর উৎস থেকেই গ্রহণ করা যায়। মানুষের কল্পনা বা ধারণা থেকে কোনো নাম বা গুণাবলি আরোপ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মতো কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা শুরা, আয়াত: ১১)
এই আয়াত তাঁর অতুলনীয়তা ও পূর্ণতার ঘোষণা দেয়। তাওহিদের তিনটি মৌলিক ভিত্তি হলো:
এই বিশ্বাসে কোনো বিকৃতি, অস্বীকৃতি, সীমাবদ্ধতা বা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা নেই। আল্লাহর নাম ও গুণাবলির তাওহিদ হলো তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানে অধিষ্ঠিত করা, তাঁর মহানুভবতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ।১.
২. আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সৃষ্টির সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়।
৩. তাঁর সব গুণ পরিপূর্ণ, ত্রুটিমুক্ত।
ইমাম মালিকের শিষ্য রবিআহ বলেছেন, ‘ইস্তিওয়া (আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া) জানা, কীভাবে তা অজানা। আল্লাহর কাছ থেকে আসছে ব্যাখ্যা, রাসুলের কাছ থেকে আসছে প্রচার, আর আমাদের ওপর দায়িত্ব হলো ইমান আনা।’
আরও পড়ুনপ্রতিবেশীকে কষ্ট দিলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না১৪ এপ্রিল ২০২৫কোরআন ও সুন্নাহতে একত্বের প্রমাণ
কোরআনের প্রতিটি সুরায় আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রতিফলন রয়েছে। সুরা ইখলাস এর সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। ‘বলো, তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’ এই সুরা আল্লাহর একত্ব, পূর্ণতা ও অতুলনীয়তার সাক্ষ্য বহন করে। এ ছাড়া ‘বলো, আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবক রুপে গ্রহণ করব, তিনিই জীবিকা দেন কিন্তু তাঁকে কেউ জীবিকা দেয় না।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৪)
এই আয়াতগুলো তাঁর নিখুঁত পবিত্রতা ও ত্রুটিমুক্ততার প্রমাণ।
হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর ৯৯টি নাম রয়েছে, যে তা স্মরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ বুখারি: ২৭৩৬)
ইস্তিওয়া (আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া) জানা, কীভাবে তা অজানা। আল্লাহর কাছ থেকে আসছে ব্যাখ্যা, রাসুলের কাছ থেকে আসছে প্রচার, আর আমাদের ওপর দায়িত্ব হলো ইমান আনা।রাবিআহ, ইমাম মালিকের (রহ.) শিষ্যএই নামগুলো কোরআন ও সুন্নাহ থেকে সংগৃহীত এবং কিছু নাম আল্লাহ তাঁর অদৃশ্য জ্ঞানে রেখেছেন, যা শুধু তিনিই জানেন।
নাম ও গুণাবলির প্রভাব
আল্লাহর নাম ও গুণাবলি শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়, এগুলো আমাদের চরিত্র ও আচরণকে রূপান্তরিত করে। শায়খ ইজ্জুদ্দিন ইবনু আবদুস সালাম তাঁর গ্রন্থ শাজারাতুল মা‘আরিফ–এ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে আল্লাহর গুণাবলি মানুষের আখলাককে উন্নত করে। উদাহরণস্বরূপ:
আল-কুদ্দুস (পবিত্র): আমাদেরকে ত্রুটি ও দোষ থেকে মুক্ত থাকতে শেখায়।
আস-সালাম (শান্তি): সালাম ছড়িয়ে দেওয়ার প্রেরণা দেয়, যা ইসলামের শ্রেষ্ঠ গুণ।
আল-হালিম (সহিষ্ণু): আমাদেরকে ধৈর্য ও ক্ষমার পথে চলতে উৎসাহিত করে, যদি অপমানিতও হই।
আল-লাতিফ (সূক্ষ্মদর্শী): আমাদেরকে আল্লাহর সর্বজ্ঞতার প্রতি সচেতন করে, যা হৃদয়ে ভয় ও লজ্জার জন্ম দেয়।
এই গুণাবলি আমাদেরকে নৈতিকতার শিখরে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা কেবল আল্লাহর জন্যই জীবন গঠন করি।
আরও পড়ুনআল্লাহ যেভাবে গুনাহ ক্ষমা করেন০৮ মার্চ ২০২৫যদি তোমরা সৎকর্মশীল হও, তবে তিনি তাওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।’সুরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৫ক্ষমা পাপের ছাড়পত্র নয়
আল্লাহ নিজেকে আল-গাফফার ও আল-গাফুর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আয-যুমার: ৫৩)
কিন্তু এই ক্ষমা পাপে লিপ্ত হওয়ার ছাড়পত্র নয়। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা সৎকর্মশীল হও, তবে তিনি তাওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।’ (সুরা আল-ইসরা: ২৫)
তাই তওবা ও সৎকর্মের মাধ্যমেই এই ক্ষমা অর্জন সম্ভব।
একত্ববাদের আলোয় জীবন
আল্লাহকে এক জানার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতার সঙ্গে সংযুক্ত হই। তাঁর নাম ও গুণাবলি আমাদের হৃদয়ে শান্তি, মনে স্থিরতা এবং জীবনে দিকনির্দেশনা দেয়। এটি শুধু বিশ্বাস নয়, বরং একটি জীবনব্যবস্থা, যা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যের পথে চালিত করে। তাই আসুন, আমরা তাঁর নাম ও গুণাবলির প্রতি পূর্ণ ইমান রেখে, তাঁর সন্তুষ্টির পথে জীবন গঠন করি।
সূত্র: আলজাজিরা ডটনেট। অনুবাদ মনযূরুল হক
আরও পড়ুনহিজরি কালপঞ্জি: ইসলামি পরিচয়ের ধারণা২৩ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ন ম ও গ ণ বল র ন ম ও গ ণ বল র প ক রআন ও স ন ন হ আল ল হ আম দ র র ওপর একত ব
এছাড়াও পড়ুন:
আল্লাহর ‘আল মুমিন’ নামের মহিমা
আল্লাহর সুন্দর নামগুলোর মধ্যে ‘মুমিন’ নামটি এমন একটি রত্ন, যা আমাদের হৃদয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার স্পর্শ নিয়ে আসে। মুমিন অর্থ তিনি, যিনি তাঁর বান্দাদের ভয় থেকে মুক্তি দেন, তাঁদের অন্তরে ইমানের স্নিগ্ধতা প্রবাহিত করেন এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণের মাধ্যমে তাঁদের আশা অটুট রাখেন।
এই নাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের নিরাপত্তা কেবল আল্লাহর কাছেই পাওয়া যায়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যিনি তাদের ক্ষুধা নিবারণ করেছেন এবং ভয় থেকে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন।’ (সুরা কুরাইশ: ৪)
‘আল–মুমিন’ তিনি, যাঁর কাছ থেকে নিরাপত্তা ও শান্তি আসে, তিনি ভয়ের পথ বন্ধ করে নিরাপত্তার উপায় দান করেন।ইমাম গাজালি (রহ.)মুমিন নামের মহিমা‘আল–মুমিন’ নামটি কোরআনে সুরা হাশরের শেষে এসেছে, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি মালিক, পবিত্র, শান্তিদাতা, মুমিন।’ (সুরা হাশর: ২৩) এই নামের কয়েকটি অর্থ—
১. নিরাপত্তার উৎস: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে নিরাপত্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি তাদের ক্ষুধা মেটান এবং ভয় থেকে মুক্তি দেন। যেমন তিনি সুরা কুরাইশে বলেন, কুরাইশদের তিনি ক্ষুধা নিবারণ করেছেন এবং ভয় থেকে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন।
এ ছাড়া তিনি ইমানদারদের ভয়কে নিরাপত্তায় রূপান্তর করার কথা বলেছেন সুরা নুরে, ‘এবং তিনি তাদের ভয়ের পরিবর্তে নিরাপত্তা দেবেন।’ (সুরা নুর: ৫৫)
আখিরাতে তিনি তাঁর বান্দাদের জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে বলবেন, ‘তোমাদের ওপর কোনো ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিত হবে না।’ (সুরা: আ’রাফ: ৪৯)
২. প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা: আল্লাহ তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেন। তিনি বলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি মানুষকে একটি দিনে একত্র করবে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’ (সুরা আল-ইমরান: ৯)
তিনি দুনিয়ায় রিজিক, ক্ষমা এবং সুস্থতা দান করেন আর আখিরাতে সৎকর্মের প্রতিদান দেন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী তার কাছে থাকি, সে যেন আমার সম্পর্কে যা ইচ্ছা ধারণ করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭৫)
৩. একত্বের সাক্ষী: আল্লাহ মুমিন হিসেবে তাঁর একত্বের সাক্ষ্য দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীরাও ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্য দিয়েছেন।’ (সুরা আল-ইমরান: ১৮)
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে নিরাপত্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি তাদের ক্ষুধা মেটান এবং ভয় থেকে মুক্তি দেন।তিনি রাসুল ও কিতাব প্রেরণ করে তাঁর একত্বের প্রমাণ স্থাপন করেছেন।
৪. ন্যায়বিচারক: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের আখিরাতে কোনো অবিচার থেকে নিরাপদ রাখেন। তিনি বলেন, ‘আজ প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের প্রতিদান পাবে, আজ কোনো অবিচার নেই।’ (সুরা গাফির: ১৭)
তিনি মজলুমকে জালিম থেকে রক্ষা করেন এবং জালিমকে সময় দেন, কিন্তু যখন শাস্তি দেন, তখন কাউকে ছাড়েন না। তিনি বলেন, ‘বলো, কার হাতে সবকিছুর সার্বভৌমত্ব? তিনি আশ্রয় দেন, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কেউ আশ্রয় পায় না।’ (সুরা মুমিনুন: ৮৮)
আরও পড়ুনআল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নাম ‘আল্লাহ’০২ জুন ২০২৫‘আল–মুমিন’ নামের প্রভাব‘মুমিন’ নামে ইমান আনার ফলে আমাদের জীবনে তিনটি গভীর প্রভাব পড়ে—
১. আল্লাহর একত্বে দৃঢ় বিশ্বাস: এই নাম আমাদের বোঝায়, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা এবং তাঁরই ইবাদত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের আমাদের নিদর্শন দেখাব জগতের মাঝে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে, যতক্ষণ না তাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে এটিই সত্য।’ (সুরা ফুসসিলাত: ৫৩)
এই নাম আমাদের নিশ্চিত করে, সত্যের পথ স্পষ্ট এবং এর শেষ জান্নাত। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ইমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আমি তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাব, যার নিচে নদী প্রবাহিত।’ (সুরা নিসা: ১২২)২. আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা: মুমিন নাম আমাদের আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ভরসা শেখায়। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘আমি আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী তার কাছে থাকি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭৫)
৩. সত্যের পথে অটল থাকা: এই নাম আমাদের নিশ্চিত করে, সত্যের পথ স্পষ্ট এবং এর শেষ জান্নাত। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ইমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আমি তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাব, যার নিচে নদী প্রবাহিত।’ (সুরা নিসা: ১২২)
ইবন তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বাধ্য বান্দাদের প্রতিদান দেওয়ার এবং প্রার্থনায় সাড়া দেওয়ার ওয়াদা করেছেন এবং তিনি সত্যবাদী, কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’ (ইসলাম ওয়েব, ১৭৬০৩৯)
ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘আল–মুমিন’ তিনি, যাঁর কাছ থেকে নিরাপত্তা ও শান্তি আসে, তিনি ভয়ের পথ বন্ধ করে নিরাপত্তার উপায় দান করেন।’ (আল-মাকসাদ আল-আসনা, পৃ. ৭০)
আল–জাজিরা ডটনেট থেকে অনুবাদ মনযূরুল হক
আরও পড়ুনআল্লাহর নামের ওপর ইমান আনতে হয় কেন১১ জুন ২০২৫