ট্রাম্প ও আইএমএফ—এই দুই পায়ের ওপর দাঁড়ানো এবারের বাজেট: আনু মুহাম্মদ
Published: 14th, June 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত বাজেটে ট্রাম্প প্রশাসন ও আইএমএফের প্রভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প এবং আইএমএফ—এই দুইয়ের পায়ের ওপর দাঁড়ানো এবারের বাজেট।’
আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাজেট: দেড় দশকের অভিজ্ঞতা ও অর্থনীতির গতিপথ’ শীর্ষক এক সভায় আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। বাজেট পর্যালোচনার এ সভা আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। সভায় সভাপতিত্ব করেন আনু মুহাম্মদ।
আনু মুহাম্মদ বলেন, আইএমএফের প্রভাবে দেশের ক্ষুদ্র স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি হ্রাস পেয়েছে, কর অব্যাহতি বাতিল হয়েছে, গৃহস্থালির জিনিসপত্রের ওপর কর আরোপ হয়েছে। পাশাপাশি অনলাইনে পণ্য বিক্রিতে নতুন করে শুল্কারোপ করে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এ চাপ আরও বাড়ছে ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করার জন্য—মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি ঘোষণার পর তাঁর প্রশাসনকে খুশি করতে তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা নিতেও দেখে গেছে। তিনি বলেন, সেটি করতে গিয়ে বাজেটে ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হয়েছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, সম্পদ আনতে হবে বিত্তবানদের থেকে এবং তা পুনর্বণ্টন করতে হবে। তবে বাজেটে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। অন্তবর্তী সরকারের বাজেটে আগের সরকারের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা শোনা গেলেও সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন বাজেটে নেই। বাজেটের শিরোনামে বলা হচ্ছে উন্নয়ন; কিন্তু ভেতরে আছে জনগণের জন্য বিপদ।
বাজেটে অস্বচ্ছতা ও প্রতারণামূলক ঘোষণা থাকবে না, এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সভায় আনু মুহাম্মদ বলেন, আগামী ২২ তারিখ বাজেট পাসের আগে সরকারের দায়িত্ব, বাজেটের বড় বড় জায়গার ত্রুটি সংশোধন করা। সেই সঙ্গে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে ন্যূনতম উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক মাহতাব উদ্দীন আহমেদ। এতে বলা হয়, গত ১৬ বছরের বাজেট জনগণের ছিল না। গত দেড় দশকের বাজেটে প্রধান সাতটি সমস্যা ছিল। এগুলো হলো বাজেট স্বচ্ছ ও জবাবদিহি ছিল না; এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, এ ধারাবাহিকতা থেকে বর্তমান বাজেটও বেরোতে পারেনি; জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে; করের মাধ্যমে গরিবের পকেট কাটা হয়েছে; অর্থ লুটপাট হয়েছে; সর্বজনের প্রতি হুমকি তৈরি হয়েছে; উন্নয়ন ব্যয়ের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
সভায় বাজেট নিয়ে লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন, দেশে বিদ্যমান করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। নতুন বাজেটে কর ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসেনি।
কল্লোল মোস্তফা বলেন, বাজেটে পেনশন, কৃষি ভর্তুকি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো হয়েছে। কোনো বিবেচনায় এগুলো সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ভেতর পড়ে না। এ বরাদ্দগুলো বাদ দিলে এ খাতের প্রকৃত বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশও নয়।
সভায় গত পাঁচ দশকে শিল্পায়নের ব্যর্থতা ও কর্মসংস্থানহীনতা নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ও শিক্ষক মাহা মির্জা। তিনি বলেন, সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ১৭ গুণ। বেসরকারি খাত যেভাবে সুবিধা পেয়েছে, সে পরিমাণে শিল্পায়ন হয়নি; বরং অর্থ লুট হয়েছে।
কৃষি খাতে বাজেট জিডিপির ৫ শতাংশের কম উল্লেখ করে মাহা মির্জা বলেন, কৃষি খাত বিপর্যস্ত; কিন্তু বাজেটে কোনো সমাধান আসেনি।
সভায় আরও বক্তব্য দেন চিকিৎসক হারুণ অর রশিদ, গবেষক গোলাম রসুল। এ সময় তাঁরা গত দেড় দশকে স্বাস্থ্য, কৃষি প্রভৃতি খাতে বাজেট বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।