‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
Published: 14th, June 2025 GMT
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স গঠনট র রক ত দ য় রক ত দ ত র রহম ন ন স গঠন রক ত র র জন য আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভয়ে’ সরকারি তালিকায় নাম না তোলা ইমরান চলে গেলেন নীরবে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ময়মনসিংহের নান্দাইলের ইমরান হোসেনের (২৬) বুক, পিঠ, চোখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছররা গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। গতকাল শুক্রবার তিনি অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন। আজ শনিবার তাঁকে দাফন করা হয় নিজ গ্রামে।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আওয়ামী লীগ কখনো ফিরে এলে সমস্যা হবে—এমন আশঙ্কায় সরকারিভাবে কোনো চিকিৎসা নেননি কিংবা সরকারি তালিকাভুক্তও হননি ইমরান।
ইমরানের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে শনিবার গ্রামের বাড়িতে যান এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আশিকিন আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইমরান জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেখে আমরা নিশ্চিত হয়েছি; কিন্তু সরকারি কোনো তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আন্দোলনে আহত হওয়ার বিষয়টিও ইমরান কাউকে বলেননি। এখন আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।’
ইমরান হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুশলী ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামে। স্বজনেরা জানান, স্ত্রী ও ১৮ মাসের সন্তান নিয়ে গাজীপুরের তারগাছ এলাকায় বসবাস করতেন ইমরান। প্রায় সাত বছর ধরে তিনি পাশের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ২৮ জুলাই গাজীপুরের তারগাছ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। পরে তাঁকে উদ্ধার করে পাশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গোপনে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়ে শরীর থেকে বেশ কিছু ছররাগুলি বের করলেও যন্ত্রণা কমছিল না। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে গাজীপুরের ভাড়া বাসায় বুকে ব্যথা অনুভব করলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
ইমরানের স্ত্রী রিতা আক্তার জানান, জুলাই আন্দোলনে তাঁর স্বামী আহত হলেও ভয়ে সরকারি তালিকায় নাম তোলেননি। টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও করানো যায়নি। তাঁর সঙ্গে যাঁরা আহত ও নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই তালিকাভুক্ত হওয়া ছাড়াও সরকারের সব ধরনের অর্থ বরাদ্দ পেয়েছেন; কিন্তু তাঁর স্বামীর কেউ খবর নেয়নি।
নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ফয়জুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইমরান কোথাও তালিকাভুক্ত হননি। তবে তাঁর চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র দেখে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি তিনি আন্দোলনে আহত। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমাদের পক্ষে থেকে পরিবারটিকে যে ধরনের সহযোগিতা করা দরকার তা করা হবে।’
ইমরানকে জুলাই আন্দোলনের শহীদ উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে পোস্ট করেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ময়মনসিংহ জেলা শাখার সদস্যসচিব মো. আলী হোসেন বলেন, ‘ইমরান আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সে ছবি আমাদের কাছে রয়েছে। অনেকটা নীরবে বিনা চিকিৎসায় একজন জুলাইযোদ্ধা আজ মারা গেছেন; কিন্তু সরকারি কোনো তালিকায় তাঁর নাম নেই।’