বর্তমানে কয়েকজন নারী পর্বতারোহী পর্বতারোহণকে মনেপ্রাণে নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশি নারীদের এখনও পর্বতারোহণে অংশগ্রহণ সীমিত। পর্বতারোহণে বাংলাদেশি নারীদের এগিয়ে চলার পথে পথিকৃত
যে নামটি, তা অনেকাংশেই অকথিত; দেশের প্রথম নারী পর্বতারোহী সাদিয়া সুলতানা সম্পাকে নিয়ে লিখেছেন কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব
২০০৬ সালে যখন বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবে সদস্য হই, তখন থেকেই সাদিয়া সুলতানা সম্পাকে দেখেছি। আমি নতুন, তাই তাঁর সঙ্গে তেমন একটা কথা হতো না। তবে খুব শ্রদ্ধাভরে দেখতাম। এই নারী অভিযানে যান, কী সাহস! তাঁর মা-বাবা না জানি কত সাহসী! তাঁকে দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন। এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার তাদেরই একজন।
দেশের প্রথম নারী পর্বতারোহী সম্পর্কে নিশাত মজুমদার বলেন, ‘সাদিয়া সুলতানা সম্পা বাংলাদেশের পর্বতারোহণের একজন পথিকৃৎ। তাঁর সাহস, দৃঢ় সংকল্প এবং অগ্রণী মনোভাব কেবল লিঙ্গগত বাধা ভেঙেই নয়; বরং আমার মতো বাংলাদেশের অগণিত নারীকে বড় স্বপ্ন দেখতে এবং উচ্চ লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে তিনি ইতিহাসে স্থান পাবেন বলে বিশ্বাস করি।’
সম্পা যখন পর্বতারোহণে আসেন, তখন আমাদের দেশে মেয়েরা এমন অভিযানে যাওয়ার কথা ভাবত খুব সামান্যই। পর্বতারোহী হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে সম্পা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী, তখন থেকে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কার্যক্রম থেকে প্রতি সপ্তাহে নানা ধরনের মজার অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়ে পাহাড়, সমুদ্র, প্রকৃতির প্রতি এক আলাদা ভালো লাগা তৈরি হতে থাকে। আমার নানা ও দাদা দুইজনেই পশু চিকিৎসক ছিলেন। শুনেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে জার্মানিতে গিয়েছিলেন যুদ্ধে যোগ দিতে। বড় মামাকেও দেখেছি সুযোগ পেলেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হয়ে পড়তেন। সম্ভবত, ঘুরে বেড়ানোর বাসনা জন্মসূত্রেই রক্তে মিশে আছে। আমাদের বাড়ির কাছে মওলা বক্স মেমোরিয়াল চোখের হাসপাতাল। আমি সেখানের প্যারামেডিক্সের ছাত্রী ছিলাম। তখন সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। মওলা বক্সে ঢাকা কেন্দ্র নামের একটি সংগঠন আছে। সেখানে পাখিবিশারদ ও মেরু অঞ্চল ঘুরে আসা ইনাম আল হক আসেন তাঁর বিভিন্ন সময়ের পাখি দেখা ও বাংলাদেশের পাহাড়ে চড়ার গল্প নিয়ে। তাঁর গল্প শুনে আর ছবি দেখে আমি বিস্মিত। এতদিন বইয়ের পাতায় যাদের গল্প পড়েছি আমার চোখের সামনে সেই মানুষদের দেখা। যারা পাখি দেখতে পাহাড়, সমুদ্র চষে বেড়ান। সেখান থেকে ইনাম ভাইয়ের বাড়িতে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের আড্ডায় যাওয়া শুরু। ভ্রমণ বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে প্রথম ট্র্যাকিংয়ে যাওয়া সীতাকুণ্ড পাহাড়ে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এর পর ইনাম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং ও ট্র্যাকিং ক্লাবের মাধ্যমে ২০০৪ সালে ভারতের দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান মাউন্টেইনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে পর্বতারোহণের ওপর বেসিক ও অ্যাডভান্স দুটি প্রশিক্ষণ নেওয়া। এভাবেই পর্বতারোহণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।’
২০০৫ সালে ৬ হাজার মিটারের পর্বত মেরা পিক অভিযানে অংশ নেন সম্পা। ২০০৬ সালে নারীর একটি দল নিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে যান। সম্পার সঙ্গে আমার প্রথম অভিযানে যাওয়া শুরু হয় ২০১০ সালে, ৬ হাজার মিটারের পর্বত চেকিগো, নেপাল-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ চূড়া অভিযানের মধ্য দিয়ে। তিনি কিছুটা ধীরস্থির; কিন্তু ক্লান্ত হন না। সারাদিন সারারাত হাঁটতে পারেন।
কেয়াজো রি থেকে ফেরার পথে আমি সম্পার কিছুটা পেছনে হাঁটছিলাম, সামনের গ্রুপ অনেকটা দূরে চলে গেছে। হঠাৎ দেখতে পাই সম্পা এমন একটা জায়গায় আটকে গেছেন, যার নিচের অংশ পাহাড়ি পথের পানির তীব্র স্রোত। পড়লেই শেষ। আমি দেখে দৌড়ে গিয়ে কিছুটা নেমে সম্পার কাঁধের ব্যাগসহ তাঁকে ধরেছি। এবার আমিও আটকে যাই। পেছনে আমার কাঁধের ব্যাগ ওপরে পাহাড়ের অংশে এমনভাবে আটকে যায়, কোনোভাবে দাঁড়াতে পাড়ছিলাম না। আবার সম্পাকে এক হাতে ধরে রেখেছি। দেখলাম, সম্পা আমার হাতে ঝুলছেন।
আমার কাঁধের ব্যাগ কোনোভাবেই খোলা সম্ভব হচ্ছিল না। সম্পা খুব অনুরোধ করছিলেন, ‘ভাইয়া, আমাকে কোনোভাবেই ছাড়বেন না।’ এদিক দিয়ে আমার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। আমরা দু’জনে অন্যদের ডাকছিলাম সাহায্যের জন্য। কারও কোনো সাড়া নেই।
একবার মনে হয় সম্পাকে ছেড়ে দেব। হাতের শক্তি শেষ হয়ে আসছে। আবার চিন্তা করছি, কোনোভাবে ছাড়া যাবে না, প্রয়োজনে দু’জনে পানির স্রোতে চলে যাব। যখন হাতের শক্তি প্রায় শেষ– এমন সময় আমাদের হইচই আওয়াজের কারণে, প্রধান গাইড পেমবা দর্জি শেরপা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলেন। সম্পা ও আমি সে যাত্রায় বেঁচে যাই।
খালাম্মা (সম্পার মা) সবসময় উৎসাহ দিয়ে যেতেন। আমার এই বিষয়গুলো খুব ভালো লাগত। আমার মনে হতো, খালাম্মাকেই পাহাড়ে পাঠিয়ে দিই। তিনি জানেন, অভিযানে একমাত্র মেয়ের মৃত্যু হতে পারে, তার পরও তিনি মেয়েকে আটকে রাখেননি। বলতেন, ‘মৃত্যু তো এক দিন না এক দিন আসবেই; কিন্তু অভিযান মিস করো না।’ মায়ের এ রকম সাহস দেখে অবাক হতাম।
সম্পার সঙ্গে নেপালে ২০১৪ সালে ৬ হাজার মিটারের পর্বত কেয়াজো রিতে যাই। কেয়াজো রি অভিযানের সময় দীর্ঘদিন বাড়িতে যোগাযোগ না থাকায় আমার আব্বা সম্পাদের বাসায় যান আমাদের খোঁজ নিতে। খালাম্মা আমার আব্বাকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘ওরা খুব ভালো আছে, চিন্তা করবেন না ভাই। আমার মেয়েও তো গিয়েছে। নেটওয়ার্ক না থাকাতে কারও সঙ্গেই যোগাযোগ সম্ভব ছিল না।’
২০১৬ সালে আবার মেরা পিক অভিযানে যান সম্পা। এটিই ছিল তাঁর শেষ অভিযান। এর পর শিক্ষকতা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই আর অভিযানের জন্য সময় বের করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে সম্পা বলেন, ‘২০০৬ সালে বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের আয়োজনে ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে আমরা আটজন নারী কেওক্রাডং গিয়েছিলাম। একই বছরে পাঁচজন নারীকে এভারেস্ট বেসক্যাম্প অভিযানে পাঠানো হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই দুটি অভিযানে আমি নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। নিশাত মজুমদার ছিলেন অভিযান দুটিতে। পরে নিশাত ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহণ করে পর্বতারোহণ ইতিহাসে বাংলাদেশের নারীদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন। এখনও দেশে নারী পর্বতারোহীর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য বলা চলে। তবু আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশ থেকে শুধু নারীর একটি দল এভারেস্ট অভিযানে যাবে। সঠিক প্রশিক্ষণ ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ স্বপ্ন অচিরেই পূর্ণ হওয়া সম্ভব।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র প রথম আম দ র র গল প র একট
এছাড়াও পড়ুন:
পূজার ছুটির পর গকসুর অভিষেক
৭ বছরের বিরতির পর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) অনুষ্ঠিত হলো চতুর্থ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন নতুন নেতৃত্ব।
তবে পূজার ছুটি শেষ না হওয়ায় এখনও হয়নি অভিষেক ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ফলে দায়িত্বভার নিতে পারছেন না নবনির্বাচিতরা।
আরো পড়ুন:
গকসুর জিএস, এজিএসের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আপত্তি, পুনর্নির্বাচন দাবি
চাকসু নির্বাচন: দুই নারী প্রার্থীকে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপূজার পর অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের অভিষেক। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। এতে নির্বাচনের পর যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা এখন রূপ নিয়েছে অপেক্ষার আবহে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ২৫ সেপ্টেম্বর দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৭ বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নেন। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রার্থীদের প্রচারণা আর ভোটের দিন ক্যাম্পাসজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তোলে।
ভোট শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হলেও আনুষ্ঠানিক অভিষেক না হওয়ায় এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি তারা।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রেশমা আক্তার বলেন, “গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলেও নির্বাচিত সদস্যরা এখনও শপথ গ্রহণ করেননি। এই বিলম্বের সুযোগে কিছু মহল নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে সফল করতে এবং অপপ্রচার রোধে নির্বাচিত সদস্যদের দ্রুত শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করতে পারেন।”
সদ্য নির্বাচিত সহ-সভাপতি ইয়াছিন আল মৃদুল দেওয়ান বলেন, “নির্বাচনের পরের দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল এবং দুর্গাপূজার ছুটির কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম ছিল। উপাচার্য স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি জানিয়েছেন পূজার ছুটির পর যতদ্রুত সম্ভব অভিষেক ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, “ছুটি শেষে শপথ গ্রহণ ও অভিষেক অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এখন পর্যন্ত কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়নি।”
২০১৩ সালে প্রথমবার গকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২৫ সেপ্টেম্বর চতুর্থ নির্বাচনে সম্পাদকীয় ও অনুষদ প্রতিনিধি মিলিয়ে মোট ১২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৫৮ জন প্রার্থী। ভোটার ছিলেন ৪ হাজার ৭৬১ জন।
ঢাকা/সানজিদা/মেহেদী