বর্তমানে কয়েকজন নারী পর্বতারোহী পর্বতারোহণকে মনেপ্রাণে নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশি নারীদের এখনও পর্বতারোহণে অংশগ্রহণ সীমিত। পর্বতারোহণে বাংলাদেশি নারীদের এগিয়ে চলার পথে পথিকৃত
যে নামটি, তা অনেকাংশেই অকথিত; দেশের প্রথম নারী পর্বতারোহী সাদিয়া সুলতানা সম্পাকে নিয়ে লিখেছেন কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব
২০০৬ সালে যখন বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবে সদস্য হই, তখন থেকেই সাদিয়া সুলতানা সম্পাকে দেখেছি। আমি নতুন, তাই তাঁর সঙ্গে তেমন একটা কথা হতো না। তবে খুব শ্রদ্ধাভরে দেখতাম। এই নারী অভিযানে যান, কী সাহস! তাঁর মা-বাবা না জানি কত সাহসী! তাঁকে দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন। এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার তাদেরই একজন।
দেশের প্রথম নারী পর্বতারোহী সম্পর্কে নিশাত মজুমদার বলেন, ‘সাদিয়া সুলতানা সম্পা বাংলাদেশের পর্বতারোহণের একজন পথিকৃৎ। তাঁর সাহস, দৃঢ় সংকল্প এবং অগ্রণী মনোভাব কেবল লিঙ্গগত বাধা ভেঙেই নয়; বরং আমার মতো বাংলাদেশের অগণিত নারীকে বড় স্বপ্ন দেখতে এবং উচ্চ লক্ষ্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে তিনি ইতিহাসে স্থান পাবেন বলে বিশ্বাস করি।’
সম্পা যখন পর্বতারোহণে আসেন, তখন আমাদের দেশে মেয়েরা এমন অভিযানে যাওয়ার কথা ভাবত খুব সামান্যই। পর্বতারোহী হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে সম্পা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী, তখন থেকে সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কার্যক্রম থেকে প্রতি সপ্তাহে নানা ধরনের মজার অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়ে পাহাড়, সমুদ্র, প্রকৃতির প্রতি এক আলাদা ভালো লাগা তৈরি হতে থাকে। আমার নানা ও দাদা দুইজনেই পশু চিকিৎসক ছিলেন। শুনেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে জার্মানিতে গিয়েছিলেন যুদ্ধে যোগ দিতে। বড় মামাকেও দেখেছি সুযোগ পেলেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বের হয়ে পড়তেন। সম্ভবত, ঘুরে বেড়ানোর বাসনা জন্মসূত্রেই রক্তে মিশে আছে। আমাদের বাড়ির কাছে মওলা বক্স মেমোরিয়াল চোখের হাসপাতাল। আমি সেখানের প্যারামেডিক্সের ছাত্রী ছিলাম। তখন সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। মওলা বক্সে ঢাকা কেন্দ্র নামের একটি সংগঠন আছে। সেখানে পাখিবিশারদ ও মেরু অঞ্চল ঘুরে আসা ইনাম আল হক আসেন তাঁর বিভিন্ন সময়ের পাখি দেখা ও বাংলাদেশের পাহাড়ে চড়ার গল্প নিয়ে। তাঁর গল্প শুনে আর ছবি দেখে আমি বিস্মিত। এতদিন বইয়ের পাতায় যাদের গল্প পড়েছি আমার চোখের সামনে সেই মানুষদের দেখা। যারা পাখি দেখতে পাহাড়, সমুদ্র চষে বেড়ান। সেখান থেকে ইনাম ভাইয়ের বাড়িতে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের আড্ডায় যাওয়া শুরু। ভ্রমণ বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে প্রথম ট্র্যাকিংয়ে যাওয়া সীতাকুণ্ড পাহাড়ে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এর পর ইনাম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং ও ট্র্যাকিং ক্লাবের মাধ্যমে ২০০৪ সালে ভারতের দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান মাউন্টেইনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে পর্বতারোহণের ওপর বেসিক ও অ্যাডভান্স দুটি প্রশিক্ষণ নেওয়া। এভাবেই পর্বতারোহণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।’
২০০৫ সালে ৬ হাজার মিটারের পর্বত মেরা পিক অভিযানে অংশ নেন সম্পা। ২০০৬ সালে নারীর একটি দল নিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে যান। সম্পার সঙ্গে আমার প্রথম অভিযানে যাওয়া শুরু হয় ২০১০ সালে, ৬ হাজার মিটারের পর্বত চেকিগো, নেপাল-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ চূড়া অভিযানের মধ্য দিয়ে। তিনি কিছুটা ধীরস্থির; কিন্তু ক্লান্ত হন না। সারাদিন সারারাত হাঁটতে পারেন।
কেয়াজো রি থেকে ফেরার পথে আমি সম্পার কিছুটা পেছনে হাঁটছিলাম, সামনের গ্রুপ অনেকটা দূরে চলে গেছে। হঠাৎ দেখতে পাই সম্পা এমন একটা জায়গায় আটকে গেছেন, যার নিচের অংশ পাহাড়ি পথের পানির তীব্র স্রোত। পড়লেই শেষ। আমি দেখে দৌড়ে গিয়ে কিছুটা নেমে সম্পার কাঁধের ব্যাগসহ তাঁকে ধরেছি। এবার আমিও আটকে যাই। পেছনে আমার কাঁধের ব্যাগ ওপরে পাহাড়ের অংশে এমনভাবে আটকে যায়, কোনোভাবে দাঁড়াতে পাড়ছিলাম না। আবার সম্পাকে এক হাতে ধরে রেখেছি। দেখলাম, সম্পা আমার হাতে ঝুলছেন।
আমার কাঁধের ব্যাগ কোনোভাবেই খোলা সম্ভব হচ্ছিল না। সম্পা খুব অনুরোধ করছিলেন, ‘ভাইয়া, আমাকে কোনোভাবেই ছাড়বেন না।’ এদিক দিয়ে আমার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। আমরা দু’জনে অন্যদের ডাকছিলাম সাহায্যের জন্য। কারও কোনো সাড়া নেই।
একবার মনে হয় সম্পাকে ছেড়ে দেব। হাতের শক্তি শেষ হয়ে আসছে। আবার চিন্তা করছি, কোনোভাবে ছাড়া যাবে না, প্রয়োজনে দু’জনে পানির স্রোতে চলে যাব। যখন হাতের শক্তি প্রায় শেষ– এমন সময় আমাদের হইচই আওয়াজের কারণে, প্রধান গাইড পেমবা দর্জি শেরপা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলেন। সম্পা ও আমি সে যাত্রায় বেঁচে যাই।
খালাম্মা (সম্পার মা) সবসময় উৎসাহ দিয়ে যেতেন। আমার এই বিষয়গুলো খুব ভালো লাগত। আমার মনে হতো, খালাম্মাকেই পাহাড়ে পাঠিয়ে দিই। তিনি জানেন, অভিযানে একমাত্র মেয়ের মৃত্যু হতে পারে, তার পরও তিনি মেয়েকে আটকে রাখেননি। বলতেন, ‘মৃত্যু তো এক দিন না এক দিন আসবেই; কিন্তু অভিযান মিস করো না।’ মায়ের এ রকম সাহস দেখে অবাক হতাম।
সম্পার সঙ্গে নেপালে ২০১৪ সালে ৬ হাজার মিটারের পর্বত কেয়াজো রিতে যাই। কেয়াজো রি অভিযানের সময় দীর্ঘদিন বাড়িতে যোগাযোগ না থাকায় আমার আব্বা সম্পাদের বাসায় যান আমাদের খোঁজ নিতে। খালাম্মা আমার আব্বাকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, ‘ওরা খুব ভালো আছে, চিন্তা করবেন না ভাই। আমার মেয়েও তো গিয়েছে। নেটওয়ার্ক না থাকাতে কারও সঙ্গেই যোগাযোগ সম্ভব ছিল না।’
২০১৬ সালে আবার মেরা পিক অভিযানে যান সম্পা। এটিই ছিল তাঁর শেষ অভিযান। এর পর শিক্ষকতা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই আর অভিযানের জন্য সময় বের করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে সম্পা বলেন, ‘২০০৬ সালে বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের আয়োজনে ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে আমরা আটজন নারী কেওক্রাডং গিয়েছিলাম। একই বছরে পাঁচজন নারীকে এভারেস্ট বেসক্যাম্প অভিযানে পাঠানো হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই দুটি অভিযানে আমি নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। নিশাত মজুমদার ছিলেন অভিযান দুটিতে। পরে নিশাত ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহণ করে পর্বতারোহণ ইতিহাসে বাংলাদেশের নারীদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত গড়ে তোলেন। এখনও দেশে নারী পর্বতারোহীর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য বলা চলে। তবু আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশ থেকে শুধু নারীর একটি দল এভারেস্ট অভিযানে যাবে। সঠিক প্রশিক্ষণ ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ স্বপ্ন অচিরেই পূর্ণ হওয়া সম্ভব।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র প রথম আম দ র র গল প র একট
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা
গণঅভ্যুত্থান সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। কেননা এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের সামাজিক হতাশা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার বহিঃপ্রকাশ। এই গণআন্দোলনের অভিঘাত শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিবাদের অভিঘাত কেবল শাসনব্যবস্থা নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর তলদেশেও অনুরণন তুলেছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অবস্থা ও আকাঙ্ক্ষাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও মোড় ঘুরেছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, যার ফাঁকে নতুন নেতৃত্ব ও বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার উত্থান ঘটছে। অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আগের সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার দিয়ে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের মূল লক্ষ্য সুষ্ঠু নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কার তথাপি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কাঁধে দায়িত্ব নিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে ‘আস্থা ফেরানোর সরকার’ হিসেবে বিবেচিত হলেও বছর শেষে তার সাফল্য মিশ্র। স্বচ্ছ নির্বাচনি রূপরেখা, প্রশাসনের দলীয়করণ রোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এই তিনটি অঙ্গীকারের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন প্রক্রিয়া আংশিক অগ্রগতি পেলেও, বাকিগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। প্রশাসনের মধ্যে পুরোনো গোষ্ঠীগত আনুগত্য এখনো প্রবলভাবে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে বলা যায়- দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সততা ও স্বচ্ছতার বার্তা' দিয়েছে। তাদের কিছু কর্মকাণ্ড জনগণের আস্থার ভিত্তি গড়েছে। মানুষ রাস্তায় কথা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়হীনভাবে লেখালেখি করছে, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সমাবেশ করছে যা ২০২৪ সালের তুলনায় এক বিশাল পরিবর্তন। এটি প্রমাণ করে, অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ‘শ্বাস নেওয়ার সুযোগ’ তৈরি করেছে।
আরো পড়ুন:
শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?
দেশের তরুণরা রাজনীতি নিয়ে ভাবছে, কিছু নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ‘নেতৃত্বশূন্যতা’র ফাঁকা জায়গায় আলো দেখা যাচ্ছে। এরা দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতার দাবিকে কেন্দ্র করে নিজেদের কর্মসূচি সাজাচ্ছে। অনেক তরুণ, বিশেষ করে যারা সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, তারা এই নতুন বিকল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও, পুরোনো দলগুলো বারবার অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়তে সরকার সফল হয়নি। বিচার ও জবাবদিহিতায় স্পষ্ট অগ্রগতি নেই, জনগণ চেয়েছিল, র্যাব, ডিবি বা পুলিশকে আরও মানবিক ও নিরপেক্ষ করা হোক। কিন্তু বাহিনীগুলোর আচরণ ও কাঠামোয় দৃশ্যমান কোনো সংস্কার আসেনি। বরং কিছু এলাকায় এখনও পুরোনো ভীতি বজায় রয়েছে। জনগণ চেয়েছিল, সব রাজনৈতিক শক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একমত হয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করুক। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ এবং সংলাপে অনীহার কারণে জনগণের এই প্রত্যাশা আদৌও পূরণ হবে কি না, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে! এই সংস্কারপ্রক্রিয়া জনগণের সম্পূর্ণ আশা পূরণ করতে পারবে— এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু এটি একটি ভাঙা সিস্টেমে ‘আস্থার সূচনা’ করতে পেরেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য হয়ত বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে।
গণআন্দোলনের পর মানুষ যে ‘শুদ্ধিকরণ ও ন্যায়বিচার’-এর স্বপ্ন দেখেছিল তা এখনও অসম্পূর্ণ। এখনও প্রশাসনের দলীয় আনুগত্য ভাঙা যায়নি। তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্য বা গোষ্ঠীস্বার্থ এখনও বহাল আছে। অনেক স্থানে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অস্থায়ী’ ভেবে আগের অভ্যাসেই চলছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশীয় কয়েকটি রাষ্ট্র অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উদ্যোগ (বিশেষত নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি) প্রশংসা করেছে। তবে বিচারিক স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকারিতার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
এই অভ্যুত্থান এক ধরনের শ্রেণিচেতনাকে সামনে নিয়ে আসে। সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর (যেমন: দিনমজুর, পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, পোশাকশ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়) ওপর রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নিপীড়ন এবার মিডিয়া ও আন্দোলনে বেশি করে চিত্রিত হয়। গণঅভ্যুত্থান একটি বৃহত্তর নাগরিক জাগরণ সৃষ্টি করে। শিক্ষক, চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী, আইনজীবী; যারা এতদিন নিঃশব্দ ছিলেন, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আমরা ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ আমরা চাই যেখানে রাষ্ট্র ও প্রশাসন আইনের শাসনের প্রতি বাধ্য থাকবে, গরিব-বড়লোক, ক্ষমতাবান-সাধারণ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না, গায়েবি মামলা, ক্রসফায়ার, হয়রানি, বিনাবিচারে আটক এসবের কোনো স্থান থাকবে না। সরকার নয়, ন্যায় হবে সবচেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ। আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন সমাজ চাই, যেখানে ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি, অঞ্চল, ভাষা কিংবা রাজনৈতিক মতভেদ কখনো নাগরিক অধিকার কেড়ে নেবে না, হিজড়া, দলিত, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু, পাহাড়ি সবার জন্য থাকবে সমান সুযোগ। আমরা চাই মর্যাদা-ভিত্তিক নাগরিকত্ব, করুণার নয়।
গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ছিল তরুণরা। তাই আমরা চাই, একটি জিজ্ঞাসু সমাজ, যেখানে প্রশ্ন করা 'অপরাধ' নয়। শিক্ষা হবে কেবল সার্টিফিকেটের জন্য নয়, মানুষ গড়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র, ছাত্রাবাস হবে নিপীড়নের স্থান নয়। অভ্যুত্থানের সময় আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা চাই, সেই সহানুভূতির চর্চা আমাদের সমাজব্যবস্থায় স্থায়ী হোক। একজন রিকশাচালকের মৃত্যু যেন কেবল 'সংখ্যা' না হয় বরং দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠুক; দুর্যোগে সাহায্য, প্রতিবাদে সংহতি, শোকেও ভাগাভাগি হোক। কারও বাড়িতে ‘সোয়া দুই কোটি টাকার চেক’ আবার কেউ চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারে না। আমরা এই বৈষম্যমূলক চর্চার বাইরে সমাজটিকে দেখি। শ্রমিকের ঘামে যে অর্থনীতি চলে, সে অর্থনীতির মালিকও শ্রমিকই হবে,সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্যসেবা থাকবে। আমরা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাই না, আমরা ‘ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন’ চাই।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কৃতির চেহারায় এক নতুন জাগরণ প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গোঁজামিল, ফ্যাসিবাদের ছায়া এবং দমন-পীড়নের সংস্কৃতি সংস্কারপ্রবণ সমাজে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে গণমানুষের অংশগ্রহণ, প্রশ্ন করার সাহস এবং নতুন এক নৈতিক বোধের উন্মেষ। শিল্প, সাহিত্য, নাটক ও সংগীতে পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা জাগছে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষা ফিরে আসছে কবিতায়, গান ও চিত্রকলায়। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র মানুষ এখন সংস্কৃতিকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মতপ্রকাশ ও সামষ্টিক চেতনার বাহক হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তবে কোথাও কোথাও সংস্কৃতির চিন্তা রুদ্ধ হয়েছে। মাজার ভাঙা, সংগীত-নাটকে বাধার ঘটনাও ঘটেছে। এরকম চর্চা অনাকাঙ্ক্ষিত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতি সবসময়ই ছিল প্রগতির বাহক, বৈচিত্র্য ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ধারার বিপরীতে একটি শক্তি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট: সমাজকে একমাত্রিক, সংকীর্ণ ও অচল চিন্তার খাঁচায় আবদ্ধ করা, যেখানে প্রশ্ন নেই, ভিন্নমত নেই, কল্পনা বা সৃজনশীলতার জায়গা নেই। মৌলবাদের আঘাত প্রথম আসে চিন্তার ওপর। তারা সাহিত্যে ‘অশ্লীলতা’ খোঁজে, চিত্রকলায় ‘অবমাননা’ খুঁজে বেড়ায়, গানকে ‘নিষিদ্ধ’ করে, নাটককে ‘পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা চায় না, মানুষ স্বতন্ত্রভাবে ভাবুক, ইতিহাস জানুক, নিজের পরিচয় ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। এই আঘাত শুধু মননে নয়, কখনো কখনো প্রাণঘাতীও হয়েছে মঞ্চে হামলা, শিল্পীর ওপর হামলা এ সব কিছু তার প্রমাণ।
মৌলবাদী আঘাতের আরেকটি দিক হলো সংস্কৃতির বিকৃতি। তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং সেই নামে প্রচলিত লোকসংস্কৃতিকে অস্বীকার করে। বাউল, কবি, সংস্কৃতি মেলা- সবকিছুকেই তারা খারিজ করে দিতে চায়। এতে করে সংস্কৃতি শুধু সংকুচিতই হয় না, জনগণের ঐতিহ্যবাহী আত্মপরিচয়ও হারাতে বসে। তবে আশার কথা হলো, প্রতিবাদ তো হচ্ছে। প্রতিবাদী কবিতা, বিকল্প চলচ্চিত্র, তরুণদের নেতৃত্বে সংস্কৃতির নতুন জাগরণ আশাবাদী হতে শেখাচ্ছে আমাদের। সংস্কৃতি হলো মানুষের মনের আয়না, যা কখনোই একরৈখিক শাসনের কাছে পরাজিত হয় না।
এই নবজাগরণে তরুণরা পুরোনো দাসত্বমনা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে, নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। সামাজিক গণমাধ্যম, ছোট পত্রিকা, পথনাটক এবং বিকল্প সাহিত্যমাধ্যম এখন তাদের হাতিয়ার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে; তথ্য, ইতিহাস ও স্মৃতি রচনার দায়িত্বের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং সংস্কৃতিতে দিয়েছে নতুন ভাষা ও মননচর্চার দিগন্ত। এখন প্রশ্ন, এই জাগরণ কতটা টিকে থাকবে এবং কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে? তবে এটুকু নিশ্চিত যে, নিপীড়ন আর আত্মবিক্রয়ের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে এক নতুন সাংস্কৃতিক দিগন্তের দিকে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনগণের সংস্কৃতি হবে অধিকতর সচেতন, অংশগ্রহণমূলক ও আত্মমর্যাদাশীল। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতির আবহে যে সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। মানুষ এখন আর সংস্কৃতিকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু বলে মনে করে না, বরং তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির নির্মাতা। সবচেয়ে বড় কথা, এই নতুন জনগণের সংস্কৃতি হবে রাষ্ট্রনির্ভর নয়, বরং জনগণনির্ভর। এর উৎস থাকবে জনগণের সংগ্রামে, সাহসে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্পে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
তারা//