ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও করণীয় কী হবে
Published: 24th, June 2025 GMT
বর্তমান বিশ্বের রাজনীতি এক ভয়ংকর ও অস্থির সময় পার করছে। ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত এবং পাল্টা হামলার রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং এই উত্তাপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।
আজকের দুনিয়ায় কোনো দেশ একা নয়, এক দেশের সংকট বা যুদ্ধের প্রভাব অন্য দেশের ওপরও পড়ে, বিশেষ করে যেসব দেশ ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ তাদেরই একটি। অথচ এই সংকটপূর্ণ সময়েও বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটাই নীরব এবং দুর্বলভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমরা কোনো বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছি না, কোনো জাতীয় সংলাপ হচ্ছে না, এমনকি সাধারণ মানুষকেও আমরা জানাচ্ছি না এই যুদ্ধ আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে।
এ মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল হচ্ছে হরমুজ প্রণালি। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের কারণে এ অঞ্চলটি চরম উত্তেজনায় রয়েছে। এই প্রণালি দিয়েই বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ তেল সরবরাহ হয়। সেখানে যদি যুদ্ধ হয় বা নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে, তাহলে তেলের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে, যা সরাসরি বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন এবং শিল্প খাতের বেশির ভাগই তেলের ওপর নির্ভরশীল। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেলের দাম বাড়ে, তাহলে দেশে বিদ্যুৎ ও পরিবহনের খরচ বাড়বে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নেমে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে পারে, রপ্তানি খরচ বাড়বে, আমদানি সংকুচিত হবে। ফলে অর্থনীতির এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি এসব চিন্তা করছি? আমরা কী ভাবছি, এই যুদ্ধ কীভাবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে? আমরা কি কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছি?
দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বাংলাদেশ এখনো কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই নীরব। কোনো ধরনের উচ্চপর্যায়ের আলোচনার খবর আসছে না, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো আলোচনা দেখা যাচ্ছে না এবং জাতীয়ভাবে এই আন্তর্জাতিক সংঘাত নিয়ে কোনো মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি আমাদের চোখে পড়ছে না। অথচ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা গ্লোবাল পাওয়ার পলিটিকস এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ‘চুপ থাকা’ একধরনের দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয়।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী হ্যান্স জে মরগেনথাউ তাঁর ‘পলিটিকস এমং নেশনস’ গ্রন্থে বলেছেন, রাষ্ট্রের শক্তি কেবল তার সামরিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে না, বরং প্রকৃতি, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় ঐক্য এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব—এসব মিলে গঠিত হয় একটি জাতির প্রকৃত শক্তি। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের শক্তির অনেক জায়গায় ফাঁক রয়েছে। আমরা কেবল জিডিপি বাড়ানো বা অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছি। অথচ আমাদের সমাজে রাজনৈতিক বিভাজন, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং জনমতের প্রতিফলনহীন রাষ্ট্রযন্ত্র আজও টিকে আছে।
বর্তমানে ইরান একসঙ্গে দুটি যুদ্ধ করছে। একটি হচ্ছে বাহ্যিক—ইসরায়েল ও আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে। আরেকটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ—যেখানে ইরানের ভেতরে বিভিন্ন গুপ্তচর, ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা প্রভাবিত রাজনৈতিক চক্র কাজ করছে। কিন্তু তারপরও ইরান এখনো টিকে আছে, কারণ তারা কৌশলগতভাবে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাধর্মী, তাদের সামরিক বাহিনী প্রযুক্তিনির্ভর এবং তাদের কূটনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত সক্রিয়। তারা শুধু আবেগ দিয়ে যুদ্ধ করছে না, বরং জ্ঞান ও দূরদর্শিতা দিয়ে যুদ্ধ করছে।
বাংলাদেশ কি সেই রকম কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা করেছে? আমাদের কি কোনো ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডকট্রিন’ আছে, যেটা এ ধরনের সংকটের সময়ে আমাদের দিকনির্দেশনা দেবে? আমাদের কি কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে, যারা এই সংঘাত বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে পরামর্শ দেয়? আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সামরিক বিশ্লেষক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় তৈরি করতে পেরেছি? যদি না করে থাকি, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে খুবই দুর্বল অবস্থানে আছি।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান খুবই স্পর্শকাতর। আমাদের চারপাশে ভারতের মতো বৃহৎ রাষ্ট্র, সীমান্ত সমস্যা, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আর সামুদ্রিক সম্পদের ওপর আন্তর্জাতিক আগ্রহ—এই সবকিছু মিলিয়ে আমরা একধরনের ‘স্ট্র্যাটেজিক প্রেশার জোন’-এর মধ্যে অবস্থান করছি। বিশেষত, ভারতের ‘নর্থ-ইস্ট’ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত করিডর ইস্যু, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ঘিরে চীন-আমেরিকা-জাপান-ভারতের আগ্রহ এখন স্পষ্ট। এ কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, এখন তা আন্তর্জাতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি এখনো আপডেট হয়নি। আমরা এখনো পুরোনো চিন্তা ও দলীয় রাজনীতির চশমা পরে দেশ চালাচ্ছি।
এই বাস্তবতায় আমাদের সামরিক বাজেট ও প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলতে হয়। আমরা কি কেবল বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, নাকি নিজস্ব প্রযুক্তি, গবেষণা এবং নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলব? ইরান, উত্তর কোরিয়া বা এমনকি তুরস্ক পর্যন্তও স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা কৌশলে বিনিয়োগ করছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি গবেষণাভিত্তিক সামরিক প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে কোনো কার্যকর বিভাগ চালু করেছে? আমরা কি আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং জাতীয় নিরাপত্তাবোধের বীজ বুনে দিতে পেরেছি? তাদের জন্য কি আমরা কোনো স্কুল ক্যাম্প, বিজ্ঞান উৎসব বা সামরিক সচেতনতা কর্মসূচি তৈরি করেছি? ভবিষ্যতের লড়াই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়—মানসিকতা, মেধা ও কৌশলে।
আমরা কি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছি এই ইস্যুতে? এমন বৈঠক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে এবং জাতীয় কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করে। ভারতের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়—তারা কৌশলগত ইস্যুতে দল-মতনির্বিশেষে আলোচনায় বসে। তারা ইতিমধ্যেই এ ধরনের সংকটে কীভাবে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখা যায়, তা নিয়ে বিকল্প উৎসের দিকে যাচ্ছে। তারা তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার সঙ্গে নতুন চুক্তি করছে।
চীন ও ভারত উভয়েই তাদের রিজার্ভ ও ডিপ্লোমেটিক কৌশলকে আরও সক্রিয় করেছে। তুরস্ক ও মালয়েশিয়া এই ইস্যুতে জোরালো কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে মুসলিম বিশ্বে ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া ও চীন এই যুদ্ধ থেকে শিখেছে যে ভবিষ্যতের লড়াই শুধু সামরিক শক্তির নয়—তথ্য, প্রভাব এবং প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণের। তাই তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের কৌশলে মনোযোগী হয়েছে।
এ ছাড়া আমাদের এখনই চিন্তা করা উচিত যে ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট সেবা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এটি এক দিকে উন্নত ইন্টারনেট–সেবা দিলেও অন্যদিকে এটি আমাদের জাতীয় তথ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আমাদের সব সরকারি–বেসরকারি তথ্য যদি ভবিষ্যতে বিদেশি সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা বিপজ্জনক হতে পারে। আমরা কি এই বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয় আলোচনায় বসেছি? আমরা কি জানি, আমাদের তথ্য কোথায় সংরক্ষিত হচ্ছে এবং কে তা নিয়ন্ত্রণ করছে? প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক, যদি তার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে সেটি একসময় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
আমাদেরও উচিত ‘বাংলাদেশ প্রথম’ নীতি গ্রহণ করা—যেখানে কোনো দলীয় বা আদর্শিক বিবেচনার চেয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থই অগ্রাধিকার পায়। এই নীতি মানে, যেকোনো সিদ্ধান্তে আগে দেখা হবে—তা দেশের নিরাপত্তা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও ভবিষ্যতের জন্য উপকারী কি না।
এখন অনেক তরুণ শুধু টিকটক, ইউটিউব বা ইন্টারনেট সেলিব্রিটির পেছনে সময় দিচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা কৌশলগত চিন্তায় পিছিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া মতো দেশগুলো তরুণদের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির শিক্ষায় যুক্ত করছে। তাদের পাঠ্যক্রমে জাতীয় নিরাপত্তা, বিজ্ঞান গবেষণা ও কৌশলগত সচেতনতাবিষয়ক শিক্ষা রয়েছে। ফলে তাদের তরুণ প্রজন্ম কেবল বিনোদন নয়, বরং রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়। আমাদেরও সেই রকম পরিকল্পনা দরকার, যেখানে ‘বাংলাদেশ প্রথম’ চিন্তাধারা শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং নাগরিক দায়িত্ববোধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
একটি ছোট রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে কেবল তখনই, যখন তার অভ্যন্তরে ঐক্য থাকে, কৌশল থাকে এবং সে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা বুঝে আগেভাগেই পদক্ষেপ নেয়। ইতিহাস আমাদের এ বিষয়ে অনেক কিছু শিখিয়েছে। খিলাফতে ওমর (রা.
বাংলার ইতিহাসও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন—এসব শাসক সব সময় তাদের প্রকৃতি, জনশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে কাজে লাগিয়ে বাইরের আক্রমণ ঠেকিয়েছেন। মুসলিম সুলতানরাও দুর্গ নির্মাণ, নদীকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত বন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ কি এই ঐতিহাসিক শিক্ষা কাজে লাগাচ্ছে?
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ জন মিয়ারশেইমার ‘টি ট্র্যাজেডি অব গ্রেট পাওয়ার পলিটিকস’ বইয়ে বলেছেন, একটি ছোট দেশ তখনই টিকে থাকে, যখন সে কৌশলগত বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষা করে। বাংলাদেশের এখন সেই দুটি জিনিসই দরকার। আমরা শুধু আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে বিদেশনীতি চালাতে পারি না। আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল যেখানে সামরিক, বেসামরিক, একাডেমিক ও রাজনৈতিক স্তরে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে।
ফরিদ জাকারিয়া, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক । তিনি সিএনএনে ‘ফরিদ জাকারিয়া জিপিএস’ নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তিনি বারবার বলেছেন, আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আর আগের মতো ‘জিরো-সাম’ খেলা নয়, অর্থাৎ যেখানে এক পক্ষ জিতলে অপর পক্ষ হারবেই—এমন নয়। বরং এখনকার বিশ্বে সম্পর্ক তৈরি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস, কৌশল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমে। অর্থাৎ, এখন যুদ্ধ নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে দেশগুলো তাদের শক্তি ও প্রভাব বাড়ায়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের উচিত হবে নিজের ছোট ভূখণ্ডকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা। যেমন সিঙ্গাপুর একটি ছোট দেশ হয়েও কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশলে অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশও তার সমুদ্রপথ, ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে কৌশল নির্ধারণ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
অতএব আজকের বাংলাদেশে একটি সর্বদলীয় সংলাপ খুব জরুরি, যেখানে রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং নাগরিক সমাজ একত্রে বসে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবে। এ আলোচনার ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তা রূপরেখা’ তৈরি করতে হবে, যেটা শুধু সরকারের নয়, বরং জাতির রূপরেখা হবে। এই রূপরেখার ভিত্তিতে আমরা সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারব, আমাদের আন্তর্জাতিক অবস্থান জোরদার করতে পারব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নিরাপদ রাষ্ট্র উপহার দিতে পারব।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ক অবস থ ন প রস ত ত র জন ত ক ক টন ত ক দ র বলত ইসর য় ল ক শলগত দ র বল আম দ র আজক র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক থেকে কত রাজস্ব পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কী হবে সেই অর্থ দিয়ে
এমন কোনো দিন নেই, যেদিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গর্ব করে বলেন না—তিনি প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় করছে।
প্রচুর অর্থ আসছে—দেশের ইতিহাসে এত অর্থ আগে কখনো আসেনি, শুক্রবার শুল্ক রাজস্বের প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
সিএনএনের সংবাদে বলা হয়েছে, ট্রাম্প ভুল বলছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে মার্কিন সরকার প্রায় ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহ করেছে; গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় যা ২৪২ শতাংশ বেশি।
এপ্রিল মাসে প্রায় সব ধরনের পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। পাশাপাশি পরবর্তী মাসগুলোতে আরও কিছু উচ্চ শুল্ক কার্যকর হয়। বাস্তবতা হলো, তখন থেকে জুলাই পর্যন্ত সরকার মোট ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহ করেছে—গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি। প্রশ্ন হলো—এই বিপুল অর্থ সরকার কোথায় ব্যয় করছে?
ট্রাম্প দুটি সম্ভাবনার কথা বলেছেন। প্রথমত, সরকারের লাখ লাখ কোটি ডলারের ঋণ শোধ করা ও আমেরিকানদের হাতে ‘ট্যারিফ রিবেট চেক’ বা শুল্কছাড়ের চেক (শুল্ক রাজস্ব সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া) তুলে দেওয়া।
গত মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, তিনি যা করছেন তার মূল উদ্দেশ্য ঋণ শোধ করা; অঙ্কের দিক থেকে তা বেশ বড়ই হবে। কিন্তু তাঁর মনে হয়, এত বেশি অর্থ আসছে যে মানুষকে হয়তো লভ্যাংশ দেওয়া যাবে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত দুটোর কোনোটি-ই ঘটেনি। অনেক আমেরিকানের মনে হতে পারে, বিদেশি পণ্য আমদানির প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে গিয়ে যে অর্থ মূলত মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেট থেকে বেরোচ্ছে, সেই শত শত কোটি ডলার শুল্ক রাজস্বের গায়ে হয়তো শুধু ধুলো জমছে।
সরকার যে রাজস্ব সংগ্রহ করে—তা হোক সাধারণ কর থেকে কিংবা শুল্ক থেকে—সবই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের নিয়ন্ত্রিত সাধারণ তহবিলে জমা হয়। তারা এই তহবিলকে বলে ‘আমেরিকার চেকবই’, কারণ, সেখান থেকেই সরকারের খরচ মেটানো হয়, যেমন কর ফেরত দেওয়া।
যখন রাজস্বের পরিমাণ সরকারের খরচের চেয়ে কম হয়, অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সরকার ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে। বর্তমান সরকারের ওপর মোট ঋণের পরিমাণ ৩৬ ট্রিলিয়ন বা ৩৬ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। এই ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে বলছেন, এই ঋণের বোঝা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দিচ্ছে।
যেভাবে একজন সাধারণ আমেরিকান ঋণ নিলে সুদ দেন, সেভাবে সরকারকেও ঋণের ওপর সুদ দিতে হয়। যত বেশি ঋণ, তত বেশি সুদ। ফলে মহাসড়ক উন্নয়ন বা মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার মতেো অর্থে টান পড়ে।
বর্তমান অর্থবছরে মার্কিন সরকারের ১ দশশিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে এই শুল্ক রাজস্ব যথেষ্ট নয়। তবে এটাও সত্য, শুল্ক বাবদ প্রাপ্ত অর্থের কারণে ঘাটতির অঙ্ক কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ শুল্ক রাজস্ব না থাকলে যতটা ঋণ নিতে হতো, এখন সরকারকে ততটা নিতে হচ্ছে না।
ডয়েচে ব্যাংকের সিনিয়র মার্কিন অর্থনীতিবিদ ব্রেট রায়ান বলেন, এই অর্থের আরও ভালো ব্যবহারের সুযোগ আছে, বিষয়টি এমন নয়। বাজেট ল্যাব অ্যাট ইয়েলের পরিচালক ও বাইডেনের হোয়াইট হাউসের সাবেক অর্থনীতিবিদ আর্নি টেডেস্কির মতে, যদি কংগ্রেস ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে শুল্ক রাজস্ব ‘রিবেট চেক’ আকারে জনগণকে ফেরত দেয়, তাহলে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে।
বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে রিপাবলিকান সিনেটর জশ হাওলি বিল পেশ করেছেন। তিনি বলেন, এটা এখন অনুসরণ করার মতো নীতি নয়, বরং এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ বিষয়ে সিএনএনের প্রশ্নের জবাব দেয়নি হোয়াইট হাউস।
বুমেরাং হতে পারেকাগজে-কলমে শুল্ক রাজস্বের কল্যাণে সরকারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলেও এর প্রভাব সব সময় ভালো হয় না। বেশির ভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এখনো বাড়তি খরচ নিজেরা বহন করছে, দাম বাড়াচ্ছে না। সব ব্যবসার ক্ষেত্রে তা আবার প্রযোজ্য নয়। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি, খেলনা, ভোক্তা ইলেকট্রনিকসের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতিবিষয়ক মার্কিন সরকারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে তা দেখা গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন ওয়ালমার্ট ও প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, আরও দাম বৃদ্ধির সতর্কতা দিয়েছে।
শুল্কসংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। ফলে চাকরির সুযোগ কমছে—এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে বেশ কিছু অর্থনৈতিক জরিপ।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ‘শুল্ক মার্কিন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ ইয়েল বাজেট ল্যাবের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্পের শুল্কের প্রভাবে এ বছর ও আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আধা শতাংশ কমে যাবে।
এতে শুল্ক রাজস্বের একটি অংশ হারিয়ে যাবে; কেননা, যদি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম গতিতে হয়, তাহলে শুল্ক রাজস্ব থাকলেও আয়কর ও বেতন কর থেকে পাওয়া অর্থ কমে যাবে।
ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখছে। তাঁদের যুক্তি, সদ্য কার্যকর হওয়া বিশাল কর ছাড় ও ব্যয় বিলের সঙ্গে শুল্ক রাজস্ব মিলিয়ে মার্কিন অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সময়ের পরিক্রমায় তা হবে।