ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও করণীয় কী হবে
Published: 24th, June 2025 GMT
বর্তমান বিশ্বের রাজনীতি এক ভয়ংকর ও অস্থির সময় পার করছে। ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত এবং পাল্টা হামলার রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং এই উত্তাপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।
আজকের দুনিয়ায় কোনো দেশ একা নয়, এক দেশের সংকট বা যুদ্ধের প্রভাব অন্য দেশের ওপরও পড়ে, বিশেষ করে যেসব দেশ ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ তাদেরই একটি। অথচ এই সংকটপূর্ণ সময়েও বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটাই নীরব এবং দুর্বলভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমরা কোনো বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছি না, কোনো জাতীয় সংলাপ হচ্ছে না, এমনকি সাধারণ মানুষকেও আমরা জানাচ্ছি না এই যুদ্ধ আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে।
এ মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল হচ্ছে হরমুজ প্রণালি। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের কারণে এ অঞ্চলটি চরম উত্তেজনায় রয়েছে। এই প্রণালি দিয়েই বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ তেল সরবরাহ হয়। সেখানে যদি যুদ্ধ হয় বা নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে, তাহলে তেলের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে, যা সরাসরি বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন এবং শিল্প খাতের বেশির ভাগই তেলের ওপর নির্ভরশীল। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেলের দাম বাড়ে, তাহলে দেশে বিদ্যুৎ ও পরিবহনের খরচ বাড়বে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নেমে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে পারে, রপ্তানি খরচ বাড়বে, আমদানি সংকুচিত হবে। ফলে অর্থনীতির এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি এসব চিন্তা করছি? আমরা কী ভাবছি, এই যুদ্ধ কীভাবে আমাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে? আমরা কি কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছি?
দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, বাংলাদেশ এখনো কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই নীরব। কোনো ধরনের উচ্চপর্যায়ের আলোচনার খবর আসছে না, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো আলোচনা দেখা যাচ্ছে না এবং জাতীয়ভাবে এই আন্তর্জাতিক সংঘাত নিয়ে কোনো মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি আমাদের চোখে পড়ছে না। অথচ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা গ্লোবাল পাওয়ার পলিটিকস এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ‘চুপ থাকা’ একধরনের দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয়।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী হ্যান্স জে মরগেনথাউ তাঁর ‘পলিটিকস এমং নেশনস’ গ্রন্থে বলেছেন, রাষ্ট্রের শক্তি কেবল তার সামরিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে না, বরং প্রকৃতি, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় ঐক্য এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব—এসব মিলে গঠিত হয় একটি জাতির প্রকৃত শক্তি। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের শক্তির অনেক জায়গায় ফাঁক রয়েছে। আমরা কেবল জিডিপি বাড়ানো বা অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছি। অথচ আমাদের সমাজে রাজনৈতিক বিভাজন, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং জনমতের প্রতিফলনহীন রাষ্ট্রযন্ত্র আজও টিকে আছে।
বর্তমানে ইরান একসঙ্গে দুটি যুদ্ধ করছে। একটি হচ্ছে বাহ্যিক—ইসরায়েল ও আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে। আরেকটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ—যেখানে ইরানের ভেতরে বিভিন্ন গুপ্তচর, ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা প্রভাবিত রাজনৈতিক চক্র কাজ করছে। কিন্তু তারপরও ইরান এখনো টিকে আছে, কারণ তারা কৌশলগতভাবে নিজেদের প্রস্তুত করেছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাধর্মী, তাদের সামরিক বাহিনী প্রযুক্তিনির্ভর এবং তাদের কূটনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত সক্রিয়। তারা শুধু আবেগ দিয়ে যুদ্ধ করছে না, বরং জ্ঞান ও দূরদর্শিতা দিয়ে যুদ্ধ করছে।
বাংলাদেশ কি সেই রকম কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা করেছে? আমাদের কি কোনো ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডকট্রিন’ আছে, যেটা এ ধরনের সংকটের সময়ে আমাদের দিকনির্দেশনা দেবে? আমাদের কি কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে, যারা এই সংঘাত বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে পরামর্শ দেয়? আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সামরিক বিশ্লেষক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় তৈরি করতে পেরেছি? যদি না করে থাকি, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে খুবই দুর্বল অবস্থানে আছি।
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান খুবই স্পর্শকাতর। আমাদের চারপাশে ভারতের মতো বৃহৎ রাষ্ট্র, সীমান্ত সমস্যা, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আর সামুদ্রিক সম্পদের ওপর আন্তর্জাতিক আগ্রহ—এই সবকিছু মিলিয়ে আমরা একধরনের ‘স্ট্র্যাটেজিক প্রেশার জোন’-এর মধ্যে অবস্থান করছি। বিশেষত, ভারতের ‘নর্থ-ইস্ট’ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত করিডর ইস্যু, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ঘিরে চীন-আমেরিকা-জাপান-ভারতের আগ্রহ এখন স্পষ্ট। এ কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, এখন তা আন্তর্জাতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি এখনো আপডেট হয়নি। আমরা এখনো পুরোনো চিন্তা ও দলীয় রাজনীতির চশমা পরে দেশ চালাচ্ছি।
এই বাস্তবতায় আমাদের সামরিক বাজেট ও প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলতে হয়। আমরা কি কেবল বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, নাকি নিজস্ব প্রযুক্তি, গবেষণা এবং নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলব? ইরান, উত্তর কোরিয়া বা এমনকি তুরস্ক পর্যন্তও স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা কৌশলে বিনিয়োগ করছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি গবেষণাভিত্তিক সামরিক প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে কোনো কার্যকর বিভাগ চালু করেছে? আমরা কি আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং জাতীয় নিরাপত্তাবোধের বীজ বুনে দিতে পেরেছি? তাদের জন্য কি আমরা কোনো স্কুল ক্যাম্প, বিজ্ঞান উৎসব বা সামরিক সচেতনতা কর্মসূচি তৈরি করেছি? ভবিষ্যতের লড়াই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়—মানসিকতা, মেধা ও কৌশলে।
আমরা কি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছি এই ইস্যুতে? এমন বৈঠক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে এবং জাতীয় কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করে। ভারতের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়—তারা কৌশলগত ইস্যুতে দল-মতনির্বিশেষে আলোচনায় বসে। তারা ইতিমধ্যেই এ ধরনের সংকটে কীভাবে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখা যায়, তা নিয়ে বিকল্প উৎসের দিকে যাচ্ছে। তারা তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার সঙ্গে নতুন চুক্তি করছে।
চীন ও ভারত উভয়েই তাদের রিজার্ভ ও ডিপ্লোমেটিক কৌশলকে আরও সক্রিয় করেছে। তুরস্ক ও মালয়েশিয়া এই ইস্যুতে জোরালো কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে মুসলিম বিশ্বে ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া ও চীন এই যুদ্ধ থেকে শিখেছে যে ভবিষ্যতের লড়াই শুধু সামরিক শক্তির নয়—তথ্য, প্রভাব এবং প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণের। তাই তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের কৌশলে মনোযোগী হয়েছে।
এ ছাড়া আমাদের এখনই চিন্তা করা উচিত যে ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট সেবা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এটি এক দিকে উন্নত ইন্টারনেট–সেবা দিলেও অন্যদিকে এটি আমাদের জাতীয় তথ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আমাদের সব সরকারি–বেসরকারি তথ্য যদি ভবিষ্যতে বিদেশি সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তা বিপজ্জনক হতে পারে। আমরা কি এই বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয় আলোচনায় বসেছি? আমরা কি জানি, আমাদের তথ্য কোথায় সংরক্ষিত হচ্ছে এবং কে তা নিয়ন্ত্রণ করছে? প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক, যদি তার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে সেটি একসময় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
আমাদেরও উচিত ‘বাংলাদেশ প্রথম’ নীতি গ্রহণ করা—যেখানে কোনো দলীয় বা আদর্শিক বিবেচনার চেয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থই অগ্রাধিকার পায়। এই নীতি মানে, যেকোনো সিদ্ধান্তে আগে দেখা হবে—তা দেশের নিরাপত্তা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও ভবিষ্যতের জন্য উপকারী কি না।
এখন অনেক তরুণ শুধু টিকটক, ইউটিউব বা ইন্টারনেট সেলিব্রিটির পেছনে সময় দিচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা কৌশলগত চিন্তায় পিছিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া মতো দেশগুলো তরুণদের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির শিক্ষায় যুক্ত করছে। তাদের পাঠ্যক্রমে জাতীয় নিরাপত্তা, বিজ্ঞান গবেষণা ও কৌশলগত সচেতনতাবিষয়ক শিক্ষা রয়েছে। ফলে তাদের তরুণ প্রজন্ম কেবল বিনোদন নয়, বরং রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়। আমাদেরও সেই রকম পরিকল্পনা দরকার, যেখানে ‘বাংলাদেশ প্রথম’ চিন্তাধারা শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং নাগরিক দায়িত্ববোধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
একটি ছোট রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে কেবল তখনই, যখন তার অভ্যন্তরে ঐক্য থাকে, কৌশল থাকে এবং সে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা বুঝে আগেভাগেই পদক্ষেপ নেয়। ইতিহাস আমাদের এ বিষয়ে অনেক কিছু শিখিয়েছে। খিলাফতে ওমর (রা.
বাংলার ইতিহাসও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন—এসব শাসক সব সময় তাদের প্রকৃতি, জনশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে কাজে লাগিয়ে বাইরের আক্রমণ ঠেকিয়েছেন। মুসলিম সুলতানরাও দুর্গ নির্মাণ, নদীকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত বন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ কি এই ঐতিহাসিক শিক্ষা কাজে লাগাচ্ছে?
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ জন মিয়ারশেইমার ‘টি ট্র্যাজেডি অব গ্রেট পাওয়ার পলিটিকস’ বইয়ে বলেছেন, একটি ছোট দেশ তখনই টিকে থাকে, যখন সে কৌশলগত বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষা করে। বাংলাদেশের এখন সেই দুটি জিনিসই দরকার। আমরা শুধু আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে বিদেশনীতি চালাতে পারি না। আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত কৌশল যেখানে সামরিক, বেসামরিক, একাডেমিক ও রাজনৈতিক স্তরে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে।
ফরিদ জাকারিয়া, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক । তিনি সিএনএনে ‘ফরিদ জাকারিয়া জিপিএস’ নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তিনি বারবার বলেছেন, আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আর আগের মতো ‘জিরো-সাম’ খেলা নয়, অর্থাৎ যেখানে এক পক্ষ জিতলে অপর পক্ষ হারবেই—এমন নয়। বরং এখনকার বিশ্বে সম্পর্ক তৈরি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস, কৌশল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমে। অর্থাৎ, এখন যুদ্ধ নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে দেশগুলো তাদের শক্তি ও প্রভাব বাড়ায়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের উচিত হবে নিজের ছোট ভূখণ্ডকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা। যেমন সিঙ্গাপুর একটি ছোট দেশ হয়েও কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশলে অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশও তার সমুদ্রপথ, ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে কৌশল নির্ধারণ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
অতএব আজকের বাংলাদেশে একটি সর্বদলীয় সংলাপ খুব জরুরি, যেখানে রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং নাগরিক সমাজ একত্রে বসে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবে। এ আলোচনার ভিত্তিতে একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তা রূপরেখা’ তৈরি করতে হবে, যেটা শুধু সরকারের নয়, বরং জাতির রূপরেখা হবে। এই রূপরেখার ভিত্তিতে আমরা সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারব, আমাদের আন্তর্জাতিক অবস্থান জোরদার করতে পারব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নিরাপদ রাষ্ট্র উপহার দিতে পারব।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ক অবস থ ন প রস ত ত র জন ত ক ক টন ত ক দ র বলত ইসর য় ল ক শলগত দ র বল আম দ র আজক র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় বাধা
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে। ১৯৪৫ সালের পর জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তার এ অবস্থান শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সম্পর্ককেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত স্বীকৃতি, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে পদক্ষেপ না নেওয়া, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সহায়তা করা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একগুঁয়ে ও বেপরোয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ নীতি।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অবস্থান
২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে ‘সদস্যবহির্ভূত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা ভেটো দিয়ে থামায়।
পরবর্তী মাসে (মে ২০২৪) সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাব ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ‘পূর্ণ সদস্য হওয়ার যোগ্য’ হিসেবে বিবেচনা ও নিরাপত্তা পরিষদকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহী হতে বলে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৪৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ এখনো হয়নি ফিলিস্তিনের। চলতি সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চলেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এতে খুশি নয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি: ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’
বিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’ ফিলিস্তিন–ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়ার মূল কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রশাসন মূলত এই নীতিকে সমর্থন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বলে এসেছে যে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে, একতরফা বা আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে নয়।
১৯৪৮ সালে দখলদার ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ ও ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তি—সব মিলিয়ে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ রূপরেখা তৈরি হয়েছে।
মার্কিন প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দাবি, একতরফাভাবে স্বীকৃতি শান্তি আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, ‘উগ্রপন্থী’ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করতে পারে এবং সীমান্ত, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে।
ফিলিস্তিনি জনগণও সমান অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের যোগ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিন নীতি প্রায়ই তার ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক দিয়ে প্রভাবিত। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র সেনা সাহায্য, উন্নত অস্ত্র সরবরাহ, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে দেশটিকে।
এই সমর্থনের মধ্যে শুধু মার্কিন অস্ত্র বিক্রি নয়; ইসরায়েলকে সাইবার নিরাপত্তা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশলীয় পরামর্শ প্রদানও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, একতরফা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইসরায়েলের সঙ্গে এ কৌশলগত জোটে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ লক্ষণ তৈরি হতে পারে। ইসরায়েলপন্থী লবিগুলো, যেমন ‘এআইপিএসি’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখে।
ফিলিস্তিন সরকারের সক্ষমতা
যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করে। দেশটির যুক্তি, ফাতাহ (পশ্চিম তীর) ও হামাসের (গাজা) মধ্যে বিভাজন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত নয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে মনে করে।
গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রশাসনিক অচলাবস্থা, মানবিক সংকট, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের অভাব—এসবও ফিলিস্তিনকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হতে ব্যর্থ করবে বলে বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ফিলিস্তিনের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা চ্যালেঞ্জপূর্ণ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে।আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের প্রভাব
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ২০২৪-এর পরামর্শমূলক রায় হলো, ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি অঞ্চল (গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম) দখল করা অবৈধ। ইসরায়েলকে দ্রুত এ দখল ছাড়তে হবে। আবার দখলকৃত স্থানে ইহুদি বসতি নির্মাণ, এর সম্প্রসারণ ও শিক্ষানীতি বৈধ নয়।
এদিকে ২০১৫ সালে রোম সনদে স্বাক্ষর করেছে ফিলিস্তিন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের এখতিয়ার দিয়েছে।
এসব আইনি ভিত্তি শক্তিশালী হলেও ফিলিস্তিনকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাধা এখনো রয়ে গেছে।
ইসরায়েলের দখলকৃত জেরুজালেমে বিশ্ব মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল–আকসা