মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে খরচ কত, নিহত হয়েছে কত মানুষ
Published: 25th, June 2025 GMT
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের, যা আরও একদফা বিস্তার লাভ করল এ সপ্তাহে ইরানের অন্তত তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় দেশটির বিমান হামলার মধ্য দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইনের ব্রিফিং অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমান ইরানের ফর্দো ও নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় অন্তত ১৪টি বাংকার-বিধ্বংসী বোমা ফেলেছে। একেকটি বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমানের দাম প্রায় ২১০ কোটি ডলার। যে বোমাগুলো নিক্ষেপ করা হয়েছে, সেগুলোর দামও কয়েক কোটি ডলার।
বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে সামরিক খাতে অনেক বেশি ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র একা যে ব্যয় করে, তালিকার পরবর্তী নয়টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়েও তা বেশি।ইরানে গত শনিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অভিযানে ১২৫টির বেশি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ছিল বোমারু বিমান, জঙ্গি বিমান, জ্বালানিবাহী ট্যাংকার, নজরদারি উড়োজাহাজ এবং সহায়তাকারী ইউনিট বহনকারী উড়োজাহাজ। প্রতিটি উড়োজাহাজ মোতায়েন ও পরিচালনা করতে খরচ হয়েছে কোটি কোটি ডলার।
বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে সামরিক খাতে অনেক বেশি ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র একা যে ব্যয় করে, তালিকার পরবর্তী নয়টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়েও তা বেশি। যুক্তরাষ্ট্র সামরিক খাতে চীনের চেয়ে প্রায় তিন গুণ এবং রাশিয়ার চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি ব্যয় করে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক খাতে ৯৯ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে, যা মোট বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের ৩৭ শতাংশের সমান।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধগুলোয় প্রাণহানি
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধগুলোয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং অন্যান্য ৯/১১–পরবর্তী সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রায় ৯ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এ প্রাণহানির দায় সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের।
ওপরের তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা সরাসরি যুদ্ধ বা সংঘাতে নিহত হয়েছেন। যুদ্ধের কারণে পরোক্ষ মৃত্যু এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অনাহারে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে বা যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট নানা রোগে আরও অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬ থেকে ৩৮ লাখ। সরাসরি ও পরোক্ষ মিলিয়ে মোট মৃত্যু ৪৫ থেকে ৪৭ লাখ। মৃত্যুর এ মিছিল এখনো থামেনি, প্রতিনিয়ত সংখ্যা বাড়ছে।
এ সময়ে যুদ্ধে মার্কিন সামরিক বাহিনীর অন্তত ৩০ হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে অন্তত ৭ হাজার ৫২ জন মার্কিন সেনা, ৮ হাজার ১৮৯ জন ভাড়াটে সেনাসদস্য এবং ১৪ হাজার ৮৭৪ জন মিত্রসেনা।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৯ সাল থেকে মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করে হিসাব করলে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি সহায়তা গ্রহণকারী দেশ হিসেবে অন্তত ২৫ হাজার ১২০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে।আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি
টুইন টাওয়ারে হামলার পর প্রতিশোধ নিতে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় তারা বলেছিল, আল-কায়েদাকে ধ্বংস করতে এবং তালেবানকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে তারা ওই অভিযান পরিচালনা করছে।
এর দুই বছরের কম সময় পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাকে সামরিক অভিযান শুরু করে। তাদের অভিযানের লক্ষ্য ছিল ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) ধ্বংস করা এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছর ধরে যুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সামরিক অভিযানে পরিণত হয়েছে। এই যুদ্ধে সরাসরি প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয় প্রাণহানিও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত ৫ লাখ ৫৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের অর্থনৈতিক ব্যয়
যুক্তরাষ্ট্র দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে আনুমানিক ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের (ডিওডি) ব্যয় ২ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার, হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ব্যয় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার এবং ডিওডির মৌলিক বাজেট বৃদ্ধি করতে আরও ৮৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সাবেক সেনাদের চিকিৎসা খাতে ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার এবং যুদ্ধের খরচ মেটাতে নেওয়া ঋণের সুদ বাবদ অতিরিক্ত ১ লাখ কোটি ডলার ব্যয়।
যুক্তরাষ্ট্র এখনো নিজের যুদ্ধের খরচ বহন করে চলেছে
ইতিমধ্যে ব্যয় হওয়া ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের পাশাপাশি আগামী ৩০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধফেরত সাবেক সেনাদের দেখভালের জন্য আরও অন্তত ২ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর ফলে ২০০১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট যুদ্ধ ব্যয় আনুমানিক ৮ লাখ কোটি ডলারে দাঁড়াচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৯ সাল থেকে মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করে হিসাব করলে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি সহায়তা গ্রহণকারী দেশ হিসেবে অন্তত ২৫ হাজার ১২০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে।
আরও পড়ুনইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস হয়নি, কয়েক মাস পিছিয়েছে মাত্র২ ঘণ্টা আগেএক দশকব্যাপী একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতিবছর ৩৮০ কোটি ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এই চুক্তি ২০২৮ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এই অর্থের বেশির ভাগই বরাদ্দ করা হয়েছে বিদেশি সামরিক সহায়তা হিসেবে।
তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অতিরিক্ত ১ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যা এক বছরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সহায়তার রেকর্ড।
আরও পড়ুনইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন পক্ষেরই বিজয় দাবি ১৪ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র স আফগ ন স ত ন ২০০১ স ল ইসর য় ল অন য য
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমার খেজুরবাগানের এখন যে অবস্থা, তাতে চৌদ্দ পুরুষ বসে খেতে পারবে’
সৌদি আরবে খেজুরবাগানে কাজ করতে গিয়ে কিছু বীজ দেশে আনেন আবদুল মোতালেব নামের এক ব্যক্তি। এরপর নিজের একটি খেজুরবাগান তৈরির কাজ শুরু করেন। হতাশা কাটিয়ে কয়েক বছর পর সফলতার দেখা পান। বর্তমানে তাঁর খেজুরবাগান থেকে বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি আয় হচ্ছে বলে দাবি করেছেন। মোতালেবের দেখাদেখি স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন খেজুর চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
আবদুল মোতালেব ময়মনসিংহের ভালুকার উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। সেখানে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিন বছর খেজুরবাগানে কাজ করেছেন। ২০০১ সালের শেষ দিকে নিজে খেজুর চাষের পরিকল্পনা দেশে ফেরেন। এ সময় উন্নত জাতের খেজুরের প্রায় ৩৫ কেজি বীজ নিয়ে আসেন। বাড়ির আঙিনায় ৭০ শতাংশ জমিতে রোপণ করে ২৭৫টি চারা। বর্তমানে মোতালেবের ৭ বিঘা খেজুরবাগানে প্রায় ৩ হাজারের বেশি খেজুরগাছ আছে। এগুলোর মধ্যে সৌদি আরবের আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের দেখা মেলে।
গত বুধবার মোতালেবের খেজুরবাগানে গিয়ে দেখা যায়, বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে নানা জাতের খেজুর। মোতালেব জানান, আজোয়া খেজুর ৩ হাজার টাকা, শুক্কারি এক হাজার, আম্বার আড়াই হাজার, লিপজেল সাড়ে ৪ হাজার ও মরিয়ম খেজুর ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এ ছাড়া বিক্রি হয় খেজুরের চারাও। কাটিং করা প্রতিটি চারা ১৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এ ছাড়া বীজ থেকে তৈরি চারা ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন।
আবদুল মোতালেব বলেন, ‘আমি পড়ালেখা করি নাই। দেশেও কৃষিকাজ করি এবং সৌদি আরবে গিয়ে আমি কৃষিকাজ পাই। সেখানে খেজুরবাগানে কাজ করে খেজুর খেয়ে মনে হলো, যদি দেশে একবার এই খেজুর চাষ করতে পারি তাহলে জীবন সার্থক, আর বিদেশে যেতে হবে না। ২০০১ সালে বাড়িতে আসার সময় ৩৫ কেজি বীজ নিয়ে আসি, সেখান থেকে মাত্র ২৭৫টি গাছ তৈরি করা হয়। দীর্ঘ ১৮ বছর গবেষণা করে ৭টি মাতৃগাছ পাই, বাকিগুলো সব পুরুষ গাছ। পুরুষ গাছগুলো কেটে মাতৃগাছগুলো থেকে কাটিং করে চারা উৎপাদন শুরু করি। এখন আমার বাগানের যে অবস্থা, তাতে আমার পরবর্তী চৌদ্দ পুরুষ বসে খাবে, আমার সন্তানদের আর কষ্ট করতে হবে না। বাগানে এখন শুধু মাতৃ গাছ আছে। আমাদের বাগানে উৎপাদিত খেজুর পুরোপুরি সৌদি আরবের সঙ্গে স্বাদে-গন্ধে মেলে।’
বাগানটিতে সৌদি আরবের আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের দেখা মেলে