মানুষের শরীরে অনেক রোগ আছে, কিন্তু ভয়ংকর একটি রোগ থাকে লুকিয়ে হৃদয়ের গভীরে—সেটি হলো হৃদয়ের কাঠিন্য, যাকে কোরআনে বলা হয়েছে ‘কসওয়াতুল কলব’।
এ রোগে কলব বা হৃদয় করুণা হারায়, আমল থেকে খুশু-খুজু মুছে যায়। উপদেশ শুনলেও কানে যায় না, নসিহত গ্রহণ করে না, সত্য-মিথ্যা চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আল্লাহ বলেছেন, “তারপর তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, যা পাথরের মতো, বরং তার চেয়েও কঠিন।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ৭৪)
এখানে পাথরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, কারণ পাথর থেকে নদী বের হয়, গাছ গজায়, কিন্তু কাঠিন হৃদয় থেকে কোনো কল্যাণ বের হয় না।
তারপর তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, যা পাথরের মতো, বরং তার চেয়েও কঠিন।কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ৭৪এ রোগ নতুন নয়। পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যেও ছিল। ইহুদি-খ্রিস্টানরা দীর্ঘদিন ইমান ও আমলের পরও হৃদয় কঠিন করে ফেলেছিল। সুরা হাদিদে (আয়াত: ১৬) আল্লাহ বলেন, “যারা ইমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনো সময় আসেনি যে, আল্লাহর জিকিরে ও সত্য কোরআনে তাদের হৃদয় নরম হবে? তারা যেন পূর্ববর্তী কিতাবিদের মতো না হয়, যাদের ওপর দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে এবং তাদের অনেকে ফাসিক।”
আরও পড়ুনইমান: শক্তি ও শান্তির রহস্য০২ অক্টোবর ২০২৫অর্থাৎ দীর্ঘদিন আমল না করলে, জিকির থেকে দূরে থাকলে হৃদয় পাথর হয়ে যায়।
ইসলাম এ রোগের চিকিৎসায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী (সা.
আবার বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদের শরীর বা চেহারার দিকে তাকান না, বরং তোমাদের হৃদয় ও আমলের দিকে তাকান।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৪)
হৃদয় ভালো থাকলে জীবন সুন্দর হয়। মানুষ দয়া করে, সত্য কথা বলে, ইবাদতে আনন্দ পায়, আল্লাহর সঙ্গে মুহাব্বত অনুভব করে। দুনিয়ার ঝকঝকে জিনিস তার চোখে ম্লান হয়ে যায়। সে যেন দুনিয়ার বাগানে জান্নাতের সুঘ্রাণ পায়।
শোনো, শরীরে একটি গোশতের টুকরা আছে। সেটি ভালো হলে পুরো শরীর ভালো হয়, খারাপ হলে পুরো শরীর খারাপ হয়। সেটি হলো হৃদয়।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২কিন্তু হৃদয় কঠিন হলে? সব উল্টে যায়। নামাজে খুশু থাকে না, কোরআন শুনে চোখে পানি আসে না, পাপ করতে ভয় হয় না। মানুষ অন্যায় করে, অধিকার হরণ করে, মা-বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে—এবং এসবে তার হৃদয় কাঁপে না।
আজকের সমাজে এ রোগের লক্ষণ স্পষ্ট। নামাজে মন বসে না। কোরআন তেলাওয়াত শুনে হৃদয় নরম হয় না। হালাল-হারামের ভয় থাকে না। মা-বাবার অবাধ্যতা, আত্মীয়তা ছিন্ন করা, মানুষের সঙ্গে রুক্ষ আচরণ—সবই হৃদয়ের কাঠিন্যের চিহ্ন। এটি কেয়ামতের আলামতও। নবীজি (সা.) বলেছেন, “মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যা উঠিয়ে নেওয়া হবে, তা হলো খুশু বা খোদাভীতি।” (আত-তাবারানি, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ২৯৫)
আরও পড়ুনমৃত্যুকে স্মরণ: কঠিন হৃদয় নরম করার একটি উপায়২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫তাহলে কী করে হৃদয় কঠিন হয়? কয়েকটি বড় কারণ জানাচ্ছি:
১. আল্লাহর জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। “যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরায়, তার জীবন সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং কেয়ামতে আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাব।” (সুরা ত্বহা, আয়াত: ১২৪)
নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে আল্লাহর জিকির করে আর যে করে না, তার উদাহরণ জীবিত ও মৃতের মতো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪০৭)
২. ফরজ আমল ছেড়ে দেওয়া, আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করা। ইহুদিরা ওয়াদা ভেঙে হৃদয় কঠিন করে ফেলেছিল। (সুরা মায়িদা, আয়াত: ১৩)
ফরজ নামাজ, রোজা, জাকাত ছেড়ে দিলে হৃদয়ে পাথর জমে।
৩. পাপাচার করা। “না, বরং তারা যা উপার্জন করেছে, তা তাদের হৃদয়ে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে।” (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত: ১৪)
হাদিসে আছে, “বান্দা যখন গুনাহ করে, তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে। তওবা করলে মুছে যায়, না করলে বাড়তে থাকে।” (তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৩৪; নাসায়ি, হাদিস: ৪৬৬৮; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২৪৪)
হৃদয় কঠিন হলে? সব উল্টে যায়। নামাজে খুশু থাকে না, কোরআন শুনে চোখে পানি আসে না, পাপ করতে ভয় হয় না। মানুষ অন্যায় করে, অধিকার হরণ করে, মা-বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে—এবং এসবে তার হৃদয় কাঁপে না।প্রকাশ্যে গুনাহ করলে আরও ক্ষতি। নবীজি (সা.) বলেছেন, “আমার উম্মতের সবাই ক্ষমাপ্রাপ্ত, কিন্তু যারা প্রকাশ্যে গুনাহ করে (তারা নয়)।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৯০)
৪. ধর্মীয় জ্ঞান না থাকা। “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা আলেম, তারাই তাঁকে ভয় করে।” (সুরা ফাতির, আয়াত: ২৮)
ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে হৃদয় নরম হয় না।
৫. খেয়াল-খুশির পেছনে ছোটা। “তারা যখন সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, আল্লাহ তাদের হৃদয় বিচ্যুত করে দেন।” (সুরা সাফ, আয়াত: ৫)
৬. বিদআতি বই পড়া, তাদের সঙ্গ গ্রহণ করা। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন, “ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি হৃদয় কঠিন করে, শত্রুতা বাড়ায়।” (আল-উম্ম, ১/২৩৭, দারুল মা'রিফাহ, বৈরুত, ১৯৯০)
৭. ‘মুবাহ’ জিনিসে অতিরিক্ত মগ্ন হওয়া। বেশি খাওয়া, বেশি দেখা, বেশি হাসা—এসব হৃদয়কে ভারী করে। হাদিসে আছে, “অতিরিক্ত হাসি হৃদয় মেরে ফেলে।” (তিরমিজি, হাদিস: ২৩০৫)
৮. হারাম খাওয়া। নবীজি (সা.) বলেছেন, “এক ব্যক্তি ধুলোমাখা, চুল উসকোখুসকো, দূর ভ্রমণ করে, হাত তুলে বলে, ‘ইয়া রব, ইয়া রব,’ কিন্তু তার খাবার হারাম, পোশাক হারাম, হারাম দিয়ে বেড়ে উঠেছে সে—তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৫)
হৃদয় নরম রাখার উপায় কী? জিকির করা, কোরআন পড়া, তওবা করা, ফরজ পালন করা, ধর্ম শেখা, সৎ সঙ্গী রাখা, হারাম থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ আমাদের হৃদয় নরম করুন, জিকিরে ভরিয়ে দিন, পাপ থেকে বাঁচান। তিনি দোয়া শোনেন, কবুল করেন।
আরও পড়ুনমানুষের ‘কলব’ কেন বদলে যায়২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র আল ল হ বল ছ ন ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
পটুয়াখালীতে ধরা পড়ল বিরল সামুদ্রিক মাছ, এক লাখ টাকায়ও বিক্রি করলেন না জেলে
পটুয়াখালীর কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে এক জেলের জালে ২১ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের একটি কালো পোয়া মাছ ধরা পড়েছে।
জেলে আবদুল মান্নান বলেন, এফবি ভাই ভাই ট্রলারে করে তিন দিন আগে তাঁরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। তিনি জাল ফেললে অন্য মাছের সঙ্গে এই মাছ উঠে আসে।
আজ শনিবার সকালে মাছটি মহিপুর মৎস্যবন্দরের ফয়সাল ফিশ আড়তে বিক্রির জন্য আনা হয়। এ সময় মাছটি একনজর দেখতে মানুষের ভিড় জমে যায়। সচরাচর এ ধরনের মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ফয়সাল ফিশ আড়তের ব্যবসায়ী রাজু মিয়া জানান, মাছটি ডাকের মাধ্যমে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। তবে বেশি দামের আশায় মাছটি বিক্রি না করে চট্টগ্রামে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। মাছটির বায়ুথলির অনেক দাম বলে তিনি শুনেছেন। সে কারণে চট্টগ্রামে নিয়ে মাছটি ভালো দামে বিক্রির আশা তাঁর।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মহিপুর বন্দরে আজ এমন এক মাছ উঠেছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। সকালে খবর শুনে তিনি দেখতে এসেছেন।
উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশ। তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোফিশ বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার গবেষণা সহকারী বখতিয়ার রহমান বলেন, কালো পোয়া একটি বিরল সামুদ্রিক মাছ। এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫০–১৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয় এবং ওজন ১০–২৫ কেজি হলেও কখনো কখনো ৫০ কেজির বেশি হতে পারে। কক্সবাজার, মহেশখালী, সেন্ট মার্টিন, পটুয়াখালী ও বরিশাল উপকূলে এ মাছ দেখা যায়। কাদামাটি বা বালুময় তলদেশে এরা বসবাস করে এবং ছোট মাছ, চিংড়ি ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে।
কলাপাড়া উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা প্রথম আলোকে বলেন, মাছটির এয়ার ব্লাডার (বায়ুথলি) আন্তর্জাতিক বাজারে অত্যন্ত দামি। একে ব্ল্যাক স্পটেড ক্রোকারও বলা হয়। সরকার ঘোষিত মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সুফলেই এখন জেলেরা এমন বড় ও দুষ্প্রাপ্য মাছ ধরতে পারছেন। এতে জেলেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।