বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা লক্ষ্মীপুর। প্রাকৃতিক সম্পদ, মানবসম্পদ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এটি একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল। প্রতিবছর এখান থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন—চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চাকরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, আজও লক্ষ্মীপুর-ঢাকা সরাসরি রুটে কোনো উন্নত মানের এসি বাস সার্ভিস নেই। এমনকি নির্ভরযোগ্য নন-এসি পরিবহন ব্যবস্থাও একেবারে সীমিত। এটি কেবল দুঃখজনক নয়, বরং দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা এবং নীতিগত অবহেলার একটি বড় উদাহরণ।

বর্তমানে এই রুটে যে বাসগুলো চলাচল করছে, সেগুলোর অধিকাংশই পুরোনো ও অপ্রতিসম যানবাহন। এসব বাসে যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক ভ্রমণের ন্যূনতম সুযোগও নেই। আসনবিন্যাসের দুরবস্থা, গরমে হাঁসফাঁস পরিবেশ, যাত্রাপথে দীর্ঘ সময় ধরে থেমে থেমে যাত্রী তোলা কিংবা দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছানো—এসবই যেন এই রুটের যাত্রীদের নিত্য সঙ্গী। নারী, শিশু কিংবা অসুস্থ যাত্রীর জন্য এই যাত্রা একধরনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়।

লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি মূলত পাকা এবং বেশির ভাগ অংশে চার লেনে সম্প্রসারিত। কুমিল্লা হয়ে ঢাকা পৌঁছানো যায় তুলনামূলকভাবে কম সময়ে। এমন সড়কপথে উন্নত মানের বাস সার্ভিস চালু না হওয়া নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আশপাশের জেলা যেমন—ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা ময়মনসিংহে শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ, গ্রিনলাইনসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন কোম্পানিগুলোর এসি ও আধুনিক বাস চলাচল করে। অথচ লক্ষ্মীপুর এখনো এই সেবার বাইরে রয়ে গেছে।

প্রশ্ন জাগে—এই রুটে কি যাত্রী কম? বাস্তবতা হলো, লক্ষ্মীপুর একটি প্রবাসীপ্রধান জেলা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মরত। তাঁরা ছুটি কাটাতে দেশে ফিরে ঢাকায় নামেন এবং সেখান থেকে লক্ষ্মীপুরে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া ঢাকায় লক্ষ্মীপুর জেলার হাজারো শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। অর্থাৎ, যাত্রীস্রোত আছে, চাহিদাও প্রবল। অভাব শুধু আধুনিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের।

বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভাষ্যমতে, তারা এই রুটে উন্নত বাস সার্ভিস চালুর আগ্রহ প্রকাশ করলেও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহল ও পরিবহন–সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে উদ্যোগগুলো বারবার আটকে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত লোকাল বাস মালিকদের একটি চক্র নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই নতুন ও উন্নত সার্ভিসকে প্রতিযোগিতার বাইরে রাখতে চায়।

আরও দুঃখজনক হলো, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও এখনো দৃশ্যমান কোনো কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ যাতায়াত নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। শুধু সড়ক নির্মাণই নয়, তা কতটা জনবান্ধবভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটাও উন্নয়নের একটি বড় সূচক।

লক্ষ্মীপুরবাসী আর কত দিন এই অব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে চলবে? সম্ভাবনাময় একটি জেলার মানুষকে দিনের পর দিন কেন কষ্টকর ভ্রমণের মুখোমুখি হতে হবে? এখনই সময়—এই রুটে উন্নত ও আরামদায়ক পরিবহন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরবাসীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। দেরি হলে শুধু জনগণ নয়, পিছিয়ে পড়বে পুরো একটি অঞ্চল—তার সম্ভাবনা, অর্থনীতি ও উন্নয়নের স্বপ্ন।

মো.

শিহাব উদ্দিন
চর লরেন্স, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: লক ষ ম প র পর বহন এই র ট র একট ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

দাম্পত্য–জীবনে মতভেদ হলে ইসলামের নির্দেশনা

আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে একটি হলো—তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২১)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, দাম্পত্য জীবন মানে একজন আরেকজনের মধ্যে শান্তি খোঁজা, একে অপরকে ভালোবাসা ও দয়া দেখানো। সম্মান, বোঝাপড়া, সহানুভূতি—এই গুণগুলো ছাড়া সম্পর্ক টিকে থাকে না।

নরম স্বভাব যা কিছুতেই থাকবে, তা তাকে সুন্দর করে তোলে, আর যখনই তা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তা কুৎসিত হয়ে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৯৪

এক দম্পতির স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁর স্বামী প্রতিটি বিষয়কে ‘ধর্মীয় দায়িত্ব’ বলে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো শুধু আল্লাহর সামনে দায়িত্ব পালন করছি, তুমি মানো বা না মানো, সেটা তোমার ব্যাপার।’

কিন্তু স্ত্রী এতে আহত হন, কারণ এতে তিনি বোঝেন—স্বামী আসলে তাঁর অনুভূতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ইসলাম শিক্ষা দেয়—পরামর্শ যেন হয় কোমল ভাষায়, স্নেহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, নরম স্বভাব যা কিছুতেই থাকবে, তা তাকে সুন্দর করে তোলে, আর যখনই তা থেকে তুলে নেওয়া হয়, তা কুৎসিত হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৯৪)

অন্য হাদিসে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে উত্তম।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৮৯৫)

আরও পড়ুনআয়েশা (রা.) রাগ করলে নবীজি (সা.) কী করতেন১২ জুন ২০২৫পরামর্শ ও সমাধান কী হতে পারে?

এমন পরিস্থিতি প্রায় দম্পতির মধ্যেই হয়। তাই একে জটিল করে দেখা উচিত নয়। পারস্পরিক কল্যাণ ভাবনার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কয়েকটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার:

আপনি যদি স্ত্রী হন, তবে শান্তভাবে বলুন—’আমি তোমার কথা শুনতে চাই, কিন্তু আমাকেও কথা বলতে দাও।’

১. আলোচনার পথ খোলা রাখা

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মতভেদ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হয় যখন একপক্ষ সবসময় আদেশ করে আর অন্য পক্ষ কথা বলার সুযোগই পায় না। ভালোবাসার সম্পর্কে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি যদি স্ত্রী হন, তবে শান্তভাবে বলুন—’আমি তোমার কথা শুনতে চাই, কিন্তু আমাকেও কথা বলতে দাও।’ আর যদি স্বামী হন, তাহলে বুঝুন—আপনার স্ত্রীর মন খুলে কথা বলার প্রয়োজন আছে। আপনি তাঁর মালিক নন, বরং তাঁর সঙ্গী।

২. ‘পরামর্শ’ আর ‘নিয়ন্ত্রণ’ এক নয়

অনেকে পরামর্শের নামে স্ত্রীকে চাপে ফেলেন। সেটা ঠিক না। পরামর্শ তখনই কাজে আসে, যখন তা ভালোবাসা আর সম্মানের সঙ্গে দেওয়া হয়। কাউকে সম্মান করা মানে এই নয় যে তাঁর সব কথা মানতেই হবে। ইসলাম আমাদের চিন্তা ও বিচারবোধ দিয়েই সম্মানিত করেছে।

৩. বড় সিদ্ধান্তগুলো একসঙ্গে নিন

বিয়ের আগে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না—যেমন: পোশাক, হিজাব বা নিকাব নিয়ে মতভেদ, সন্তান পালনের পদ্ধতি, সামাজিক আচার ইত্যাদি। এসব নিয়ে খোলামেলা আলাপ করুন। একসাথে বসে ঠিক করুন—কোন বিষয়গুলো তোমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনগুলোতে একে অপরকে ছাড় দেওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন২৫ জুন ২০২৫

৪. সমঝোতা ও সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করুন

আপনার স্বামী যদি বলে, ‘আমি তো দায়িত্ব পালন করে দিচ্ছি, তুমি মানো বা না মানো সেটা তোমার ব্যাপার’, তখন আপনি বলতে পারেন: ‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি দায়িত্ব পালন করছেন। আমিও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই চিন্তা করি। আসুন আমরা একসাথে বুঝে নেই কী করলে আল্লাহ বেশি খুশি হবেন, আর আমাদের সম্পর্কটাও সুন্দর থাকবে।’

তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে উত্তম।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,৮৯৫

৫. একান্ত প্রয়োজনে পারিবারিক পরামর্শ নিন

দাম্পত্যে কিছু সমস্যা এমন হয় যা বাইরের একজন বোঝাতে পারলে দুজনেই স্বস্তি পায়। একজন বিশ্বস্ত ইসলামিক কাউন্সেলর বা বুঝদার অভিভাবকের সহায়তা নিতে পারেন। বিয়ে মানে শুধু দায়িত্ব নয়, বরং একে অপরের অন্তরকে জানার, বোঝার এবং নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার সম্পর্ক।

মতভেদ থাকবেই। কিন্তু সেটা যেন ভালোবাসা ও সম্মানের ভিতরে থেকে সমাধান হয়। কারও মুখ বন্ধ করে দিয়ে, কাউকে নিচু দেখিয়ে কোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একসাথে বসে কথা বলুন, ভুল বুঝলে ক্ষমা চান, একজন আরেকজনের হৃদয় খোলার সুযোগ তৈরি করুন।

আল্লাহ আমাদের সকলকে শান্তিপূর্ণ, ভালোবাসাময় দাম্পত্য জীবন গঠনের তাওফিক দিন।

আরও পড়ুনকোরআনের আয়াত ও দাম্পত্য সম্পর্কে সমঝোতা১৪ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ