উপদেষ্টা আসিফের যোগসাজশে নগর ভবনে হামলা: ইশরাক হোসেন
Published: 25th, June 2025 GMT
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে শ্রমিক দল নেতাদের একাংশের ওপর স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, এতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সম্পৃক্ততা আছে কি না সেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত সাপেক্ষে বলতে পারবেন। কারণ প্রমাণিত ছাড়া আমরা কাউকে অভিযুক্ত করতে পারি না। তবে যার নেতৃত্ব হামলা হয়েছে তার সঙ্গে উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
আজ বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলে ঢাকাবাসীর চলমান আন্দোলন, সেবা কার্যক্রম ব্যাহত করতে পরিকল্পিত হামলা এবং ঢাকাবাসীর আন্দোলন নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের অবমাননাকর দাবি ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা ইশরাকের পাশে সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের সেরা কাউন্সিলর পদক পাওয়া ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বাদল সরকার উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে নগর ভবনে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান প্রিন্স ও একাংশের সভাপতি আরিফ চৌধুরীর পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহতদের দেখতে গিয়ে ইশরাক হোসেন হামলার জন্য প্রিন্স ও ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া রুবেলকে দায়ী করে তাদের ফ্যাসিবাদের দোসর অ্যাখ্যা দেন। তাদেরকে আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগী ও উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ দাবি করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘সোমবারের হামলা হয়েছে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের প্ররোচনায়। তাদের মূল হোতা ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া রুবেল। রুবেল একদিনও আন্দোলনে ছিলেন না। তিনি এনসিপিতে যোগদান করবেন কিংবা করেছেন। তারাই আন্দোলনের একপর্যায়ে গোলযোগ সৃষ্টি করেন। এই ষড়যন্ত্র না থামালে পুনরায় আন্দোলন শুরু হলে সেটা নগর ভবনের গণ্ডি পেরিয়ে রাজপথে বের হবে।’
হামলাকারী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া রুবেল ও আরিফুজ্জামান প্রিন্স বিএনপি সমর্থিত সংগঠনের পদধারী নেতা হয়েও কিভাবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোনর ও উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ হিসেবে কাজ করছেন সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে ইশরাক বলেন, ‘ডিএসসিসিতে আরিফ চৌধুরী ও বেলায়েত বাবু শ্রমিক দলের নেতৃত্বে আছেন। এর বাইরে কেউ যদি নিজেদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের দাবি করেন, তবে তাদেরকে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। তারা বর্তমান উপদেষ্টার প্ররোচনায় আমাদের আন্দোলনে সবচেয়ে পরিচিত মুখদের ওপর নির্মম হামলা করেছেন। তাদের আচরণই বলে দেয় তারা দোসর, না আমাদের সমর্থক।’
সংবাদ সম্মেলনে বাদল সরকারকে তার পাশে বসানোর বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে আসিফ মাহমুদ বলেছেন, বিএনপির এক নেতার প্ররোচনায় নগর ভবনের আন্দোলন হয়েছে। এই কথায় নগরবাসীকে হেয় করা হয়েছে। আসিফ আরও বলেছেন, ইশরাককে কেউ মিসগাইড করেছে। এই বক্তব্যে তিনি আমাকে চরম অবমাননা করেছেন। এই বক্তব্যের জন্য তাকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ ড এসস স ইশর ক হ স ন সরক র উপদ ষ ট ইশর ক হ স ন উপদ ষ ট র নগর ভবন ড এসস স কর ছ ন র ঘন ষ ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
সন্দেশ
বেলা আড়াইটার দিকে অফিস থেকে বের হয়েই আমি ফোন অফ করে দিলাম। বুঝতে পারছি যে আগামী মাস দুয়েকের মধ্যেই আমার চাকরি চলে যাবে। যাওয়ারই কথা। কাউকে পাগল সন্দেহ করতে শুরু করলে কোনো অফিসই তাকে আর রাখে না।
প্রতি সপ্তাহের সোমবার আর বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা পার হলেই, আমার অফিস থেকে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা আমার সিনিয়ররা প্রথম প্রথম অগ্রাহ্য করলেও, পরে নড়েচড়ে বসেছে। শুরুতে তারা মনে করেছে আমি কোনো গোপন অপরাধ বা মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়েছি। এখন তাদের অনুমান, আমার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে।
আমার স্ত্রীর সন্দেহ অবশ্য অন্য কিছু।
শেষ নভেম্বরের, মানে অগ্রহায়ণের এই পড়ন্ত দুপুরে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে এসে একাই দুটি সিটের টিকিট কেটে জামালপুরের বাসে উঠে বসলাম। জানালার সিটে বসেছি। হাইওয়ের পাশে নবান্নের শেষে পড়ে থাকা শূন্য ধানক্ষেত, হেমন্তের বিকেল এবং কুয়াশার দূরবর্তী চিহ্ন পার হয়ে বাস যখন হামিদপুরের দিকে ছুটছে, তখন প্রথমবার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ভাবছিলাম।
‘আপনি বলছেন আপনি ময়রা না?’
: নাহ। মিষ্টি বানাইতে পারি না তো আমি।
‘আপনার পেশা কী তাহলে? কী করেন?’
: ছুতার বোঝেন?
‘কাঠমিস্ত্রি?’
: হু। কাঠের কাজ পারি আমি। অর্ডারে মানুষের জন্য কাঠের জিনিস বানাই।
‘আচ্ছা। আমাকে বলা হয়েছিল যে আপনি মিষ্টি বিক্রেতা। সে কারণেই আসা এখানে, আপনার কাছে। ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে আমাকে?’
: না। তথ্যে ভুল নাই।
‘তাহলে?’
উনি কিছু একটা বলতে গিয়েও থামলেন। চোখ ছোট ছোট হয়ে এল তার, যেন কিছু চিন্তা করছেন। বা হয়তো কোনো গোপন দ্বিধা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। বারান্দায় বসেছিলাম আমরা। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসায় তার মুখের অভিব্যক্তি ভালো করে তখন আর পড়তেও পারছি না। ঘরের ভেতরে থালাবাসন নাড়াচাড়ার শব্দ আসছিল। আমি কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকার পরে তিনি আস্তে আস্তে বললেন: শুধু সন্দেশ বিক্রি করি আমি। তা–ও সপ্তাহে দুই দিন। সোমবার আর বৃহস্পতিবার, হামিদপুর হাটে। ময়রা বলা যাবে না, ওনারা আলাদা। আমি খুব ভালো পারিও না।
‘আপনার সন্দেশ তো শেষ হয়ে যায়। চাহিদা অনেক শুনেছি।’
: হাটে যেসব জিনিস ওঠে, কিছুই থাকে না, সবই বেচা হয়। আমারটা একটু আগে শেষ হয়।
‘আপনার সন্দেশে বিশেষ কিছু নাই, আপনি বলছেন?’
উনি গলা থেকে তার লাল রঙের হরতন ইশকাপন মাফলার খুলে কোলের ওপর রাখলেন। বাঁ হাতের তর্জনীর আংটিটা দুইবার আলগা করে আবার শক্ত করে আঙুলে পরলেন। আমি বুঝলাম উনি ভেতরে ভেতরে অস্থিরতাটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না আংটির পাথরটা কী। খেয়াল করলাম তার হাতে আরও দুইটা আংটি। একটায় পাথর আছে, আরেকটা সাধারণ তামার।
: দেখেন, কোনো একটা জিনিসের স্বাদ সবার কাছে তো এক রকম হয় না। একেকজনের অভিজ্ঞতা একেক রকম। দশজনে কোনো একটা ঘটনা ঘটতে দেখলে, আপনি জিগাবেন তো দশজন দশ রকমভাবে বলবে।
‘তা ঠিক। চাইলেই আপনার বানানো সন্দেশ খাওয়ার তো কোনো সুযোগ নাই, যা বুঝলাম।’
: সময়মতো আসতে হবে, হাটের দিন।
‘হু। চাইলে কি কেউ সব সন্দেশ কিনে নিতে পারবে? আমি যদি চাই।’
: নাহ। একজনরে একটার বেশি দেই না।
শেষের কথাটা খুব কঠিন স্বরে বললেন উনি। বুঝলাম আর বেশি কিছু বলতে চান না। কথা আগানোর ব্যাপারে আর আগ্রহ নাই তার। উনি সাবধানী হয়ে গেছেন।
ঠিক ওই মুহূর্তে বাড়ির পেছনের দিকের কোথাও থেকে এমন এক গা হিম করা আওয়াজ এল হঠাৎ করে, আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। তীব্র ধাতব বিষণ্ন আওয়াজ। টক...। এরপর একটু বিরতি দিয়ে একটানা আবার। টক...টক। মনে হচ্ছিল কোনো একটা প্রাণী প্রচণ্ড ভয় এবং যন্ত্রণায়, গলা দিয়ে নয়, তার পাকস্থলীর গহিন থেকে উঠে আসছে এই আওয়াজ। আমার মনে পড়ল কয়েক বছর আগে একবার এই ডাক শুনেছিলাম।
এক রাতে সুন্দরবনের গহিনে, লোকালয় থেকে সত্তর-আশি কিলোমিটার দূরে আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়েছিল। বুড়িগোয়ালিনী, আড়পাঙ্গাশিয়া আর শিবসার মোহনা থেকে একটু দূরে। ভয়ানক সেই রাতে, যখন কুয়াশা আকাশ আর নদীর পানি মিলে সবদিক এক অলৌকিক সাদা রঙে আচ্ছন্ন, মনে হচ্ছিল অসীম মহাশূন্যের কোথাও আমাদের নৌকা স্থির হয়ে আছে। দুপুর রাতে, জঙ্গলের কোথাও থেকে তিনবার ভেসে এসেছিল এই ডাক।
তবে তখন এত ভয় লাগেনি, যেমন এখন লাগল। মনে হচ্ছিল, এই জগৎ নয়, পরকালের কোথাও থেকে ভেসে এল এই আওয়াজ। আমাকে অন্যমনস্ক হতে দেখে উনি বললেন,
: পাখি। আতশ পাখি।
‘রাতচরার ডাক। আতশ বলেন আপনারা?’
: হু
আমি বুঝলাম যে কাজে এসেছিলাম সেটা হওয়ার আর আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। যা বলার উনি বলেছেন, যত জিজ্ঞাসাই করি। এর বেশি কিছু উনি আর জানাবেন না। আর কেনই বা সেটা করবেন! কোনো কারণ নেই।
উনি আর কিছু বললেন না। বোঝা যায়, কোনো কিছু নিয়ে অনুরোধ করা বা দ্বিতীয়বার বলা তার স্বভাবে নাই। আমি উঠে পড়লাম। মনে মনে আশা করেছিলাম উনি আমাকে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবেন। কিন্তু বসে রইলেন ওভাবেই। পেছন থেকে শুধু বললেন: সামনে ভ্যান পাওয়া যাবে। হামিদপুর বাজারে ঢাকার বাস পাবেন। কিন্তু সেখানে যাইতে টাইম বেশি লাগবে। আর এইদিকে পেছনের দিকে ব্রাহ্মণ শাসন বাজার থিকাও পাবেন বাস। ভ্যানওয়ালারে ব্রাহ্মণ শাসন বাজারে নিয়ে যাইতে বলবেন।
তার কোনো কথাই আমার অবিশ্বাস করার মতো মনে হয়নি। মনে হয়নি কোনো ধরনের বুজরুকি তার ভেতরে আছে। তবে বুঝতে পারছিলাম যে সন্দেশ বিক্রি করা নিছক শখের ব্যাপার নয় তার। শুধু সন্দেশ বিক্রি করার জন্য সন্দেশ বিক্রি করেন না তিনি। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। শুধু আমি যেটা অনুমান করছিলাম তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।
বাস থেকে আমি যখন হামিদপুর হাটে নামলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা।
হাটের ভেতর প্রথম প্রথম তার সন্দেশের দোকান খুঁজে পেতে সময় লাগত। এখন খুঁজতে হয় না, চোখ বন্ধ করেও বের করে ফেলতে পারব। হাটের যেদিকটায় মসলার হাট, সেদিকটাতে একটা জিলাপির দোকানের পাশে তিনি বসেন। ওদিকটাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেশিনে ভাঙানো মসলার তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। তার সামনে মুখ কাটা এক পুরোনো টিনের ভেতরে থাকে সন্দেশ। আমি জানি এর মধ্যে একটা বা একাধিক অলৌকিক সন্দেশ আছে। তারা নিজে নিজেই এক মহাজাগতিক খেলা, খেলার উপাদান।
আমি সামনে দাঁড়ানো মাত্রই টিনের ভেতর থেকে একটা সন্দেশ বের করে কাগজে মুড়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন উনি। আমি হাতে নিয়ে তিরিশ টাকা দিলাম তাকে।
আমি থাকা অবস্থায়ই আরও দু-তিনজন ক্রেতা এসে সন্দেশ নিল।
এই সন্দেশ দেখতে নিতান্তই সাধারণ। গ্রামের কোনো নবিশ কারিগরের হাতে তৈরি হলে যেমন হওয়ার কথা ঠিক তেমনই। চ্যাপটা আকৃতির। বোঝা যায় যে বানানোর সময় হাতের আঙুল ব্যবহার করা হয়েছে।
আমি কোনা ভেঙে সন্দেশ মুখে দিলাম। প্রতিবারের মতো ওই একই স্বাদ, যেরকম হওয়ার কথা। অবশ্যই আহামরি কিছু নয়, খুবই আটপৌরে ধরনের স্বাদ।
তবে সেদিনের মতো কিছু ঘটবে এ রকম আশা আমার খুব একটা ছিল না।
মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়েছে যে, সেদিনের ওই ঘটনা নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন ছিল। সেদিন আমার এক কলিগের গ্রামের বাড়িতে রাতে খাওয়া শেষে আমাকে দেওয়া সন্দেশ মুখে দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যা ঘটল সেটা হয়তো হ্যালুসিনেশনই। কিন্তু আমার এই জীবনের এত দিনে কেন হয়নি সেটা। এ রকম স্মৃতি আমার আসলে নাই। আমার জীবনে এ রকম কিছু ঘটেইনি! তাহলে একবারও কেন ওই স্মৃতি মনে আসেনি, সেদিন যেভাবে এল! এবং হ্যালুসিনেশনে কেন আমি ওই ঘটনাটাই দেখলাম! দেখলাম যে, নয় বছরের আমি জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, আমার দৃষ্টি জানালার ভেতরে। ভয়ে আর তীব্র আতঙ্কে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি যদি ওই দিন ওই সন্দেশ পুরো খেয়ে ফেলতাম তাহলে কী ঘটত! আবার যদি ওই দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে এই হ্যালুসিনেশন কি আমার স্মৃতির অন্ধকারের সেই একই জায়গায় ল্যান্ড করবে! একই ঘটনাই দেখব? নাকি এটা হ্যালুসিনেশনের চেয়ে বেশি কিছু ছিল!
হ্যালুসিনেশন নিয়ে আমার কিছু উপলব্ধি ঘটেছে এর মধ্যে। আমাদের অভিজ্ঞতার পুরোটাই আসলে হ্যালুসিনেশন। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের যে চেতনা, সেটা পুরোপুরি স্বচ্ছ একটা জিনিস। তবে সেই চেতনা বা কনসাসনেস হলো বাস্তবতাকে দেখার একটা জানালা শুধু, সেই চেতনা দিয়ে সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে দেখা যায় না। স্বাভাবিক চেতনা দিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়, সেটা নিয়ন্ত্রিত হ্যালুসিনেশন। চেতনা মুক্ত বা স্বাধীন হয়ে গেলে যে হ্যালুসিনেশন হয়, সেটা আরও বড় বাস্তবতা।
প্রতিবার এখান থেকে সন্দেশ খেয়ে যাওয়ার পরে সারা রাত আমার উদ্ভ্রান্ত কাটে। সমস্ত রাত আমি পায়চারি করে কাটাই। প্রথম প্রথম আমার স্ত্রী ব্যাপারটা মানতে পারত না, চিৎকার করত। এখন সে ব্যাপারটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, প্রতি সোমবার আর বৃহস্পতিবারে আমি ফোন বন্ধ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরে, মাঝরাতের আগে আগে ঘরে ফিরব এবং সারা রাত না ঘুমিয়ে কী যেন চিন্তা করব। এবং একসময় আমার চোখ লাল হয়ে যাবে। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি উত্তর দিতে পারব না, এবং আমাকে দেখে মনে হবে আমি আসলে কিছুই শুনিনি।
এখন সে আর কিছুই বলে না। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে আমাকে অন্ধকারে পায়চারি করতে দেখে প্রচণ্ড গ্লানি আর হতাশা নিয়ে আমার দিকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে যায়।
অফিসেও আমাকে প্রায় একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। মাস তিনেক হলো আমাকে আর নতুন কোনো কাজ দেওয়া হচ্ছে না। অফিসের সবাই আমার সঙ্গে কাজের ব্যাপারে ইন্টারঅ্যাকশন কমিয়ে দিয়েছে। আমার বসও আমাকে এখন এড়িয়ে চলতে চায়।
এর মধ্যে আমি ভাবি, সামান্য এক সন্দেশ কীভাবে আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা দখল করে ফেলল। কীভাবে একটা সন্দেশ ও তার বিক্রেতা আমার বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল! র্যান্ডম সিলেকশনে কোনো এক বিশেষ সন্দেশ খাওয়ার মাধ্যমে আমার কনসাসনেসের কোনো এক প্রান্তের এক অন্ধকার ঘরের দরজা খুলে একটা ঘটনার স্মৃতি উদ্ধার ছাড়া আমার চিন্তায় এখন আর কিছুই কাজ করে না।
গত এক বছরে সপ্তাহে দুই দিন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার, ঢাকা শহর থেকে দূরে এক মফস্সলের হাটের এক সন্দেশ বিক্রেতার কাছে থেকে, যে সন্দেশ বিক্রেতার উদ্দেশ্য অজ্ঞাত কিছু মানুষকে তাদের অস্তিত্বের ভেতরের কোনো এক গোপন বাস্তবতার মুখোমুখি করিয়ে দিয়ে মজা দেখা, শুধু একটামাত্র সন্দেশ খাওয়ার জন্য ছুটে যাওয়া ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই ঘটেনি বলতে গেলে। আমি এই লুপে আটকা পড়ে গেছি।
আমি দূর থেকে তার দিকে নজর রাখছিলাম। বিক্রিবাট্টা শেষ করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি কথা বলার জন্য তার দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি জিজ্ঞাসা করলেন: সন্দেশ ভালো ছিল আজ?
‘ভালো ছিল। মানে অন্যান্য দিনের মতোই।’
: আচ্ছা।
‘একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। এই প্রশ্নের উত্তর অন্তত দিয়েন।’
হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। বললেন: চেষ্টা করি। কী জিজ্ঞাসা আপনার?
‘আপনি প্রথম কবে এই হাটে সন্দেশ বিক্রি করা শুরু করলেন?’
: বছর চারের মতন।
‘এর আগে ফুলটাইম শুধু ছুতারের কাজই করতেন? কাঠের কাজ?’
: মাঝখানে ঢাকায় ছিলাম কয় বছর। ফিরা আসার পরে শুরু করছি।
আমি বেশ অবাক হলাম। এই তথ্য জানতাম না।
‘ঢাকায় ছিলেন? কী করতেন সেখানে?’
: এক বয়স্ক লোকের দেখাশোনা করতাম। ওনার ছেলেমেয়েরা সব বিদেশে থাকত।
আমি আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘উনি কি কেমিস্ট বা ফার্মাসিস্ট ছিলেন?’
যেন অসাবধানে এক বিশাল ভুল করে বসেছেন, এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন।
: তা বলতে পারি না।
আমি ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে উঠছি তখন। বিষয়টা সম্ভবত উনি টের পাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করলাম,
‘প্রতি হাটবারে যে আপনি এক শ পিস সন্দেশ বানান, এর মধ্যে ওই ধরনের সন্দেশ কয়টা থাকে? সত্য কথা বলবেন।’
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি উত্তর দিলেন: সাতটা।
‘আপনি কি আলাদাভাবে বুঝতে পারেন, কোন সাতটা?’
: নাহ। চিহ্ন রাখা হয় না কোনো।
‘কখনো কেউ এসে আপনাকে বলেছে কি না যে সন্দেশ খাওয়ার পরে অন্য রকম কিছু ঘটেছে তাদের?’
: কী বলবে!
‘অস্বাভাবিক কোনো কিছুর কথা!’
: বলছে। কেউ কেউ আসে।
‘কেমন ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলে? কী দেখতে পায় তারা?’
: সেটা আমি আপনারে বলব না। সেদিন তো বললাম আপনাকে, একেকজনের অভিজ্ঞতা একেক রকম। তবে যে পায়, তার ওপরে দুই দিন কাজ করে জিনিসটা।
হাটের ভেতর দিয়ে আমার পাশাপাশি হাঁটছিলেন। হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। অন্ধকারের মধ্যেও আমি টের পেলাম তীব্র ব্যাকুলতা তার চোখে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কী দেখছেন?
‘একটা বাড়িতে, জানালার বাইরে আমি দাঁড়ানো। নয় বছর বয়সের আমি।’
: তারপরে?
‘তারপরে আর কিছু দেখিনি। ওই বাড়ির কথা বলি। ওই বাড়িতে আমার বয়সী ছেলেটার সঙ্গে খেলতে যেতাম। ওর বাবা বিদেশে না অন্য কোথায় থাকত। ওর একটা সৎভাই ছিল ১০-১২ বছর বয়সের। আমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে খেলতে চাইত। আমাকে আদর করত। আর ওর এক মামা না কে জানি থাকত ওই বাড়িতে। টিনশেড বাড়ি, বারান্দা আছে। সামনে বিশাল উঠান, উঠানে একটা গন্ধরাজ গাছ। আমার ধারণা ওই বাড়িতে ওই দিন ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছিল। আমার সামনে ঘটনাটা ঘটে। কিন্তু আমার কিছু মনে নেই।’
আমি অন্ধকারের মধ্যেই টের পেলাম ওনার চেহারায় তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল। তার এই চেহারা দেখে আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। বললাম, ‘সেদিন ওই বাড়িতে এই সন্দেশ মুখে দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে আমার ওই স্মৃতি প্রায় ফিরে আসে। আমি ওই ঘটনার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। জানালার শিক ধরে দাঁড়ানো আমি। ভয়ে আর আতঙ্কে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ওই দিনের পর থেকে আমি আসলে আর স্বাভাবিক নাই, আমি ওই ঘটনার সুরাহা করতে চাই, কী হয়েছিল আমার সামনে। আপনি কি আমার জন্য একটা সন্দেশ আলাদা করে রাখতে পারেন না?’
হাঁটতে হাঁটতে ততক্ষণে আমরা হাটের বাইরে চলে এসেছি, রাস্তার কাছে।
: নাহ।
‘কোনোভাবে?’
উনি খুব শান্ত এবং ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিলেন: আপনি কি সেই ঘটনা পাল্টাইতে পারবেন?
এই প্রশ্ন আশা করিনি আমি। বললাম, ‘না!’
আমাকে পেছনে রেখে উনি সামনে এগিয়ে গেলেন। পেছনের দিকে ঘাড় না ঘুরিয়েই বললেন: তাইলে নিয়মের বাইরে যাব না আমি।
আমি রাস্তা পার হয়ে বাসের জন্য দাঁড়ালাম। সোমবারে আমাকে আবার আসতে হবে এখানে, একটা সন্দেশের জন্য।